দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না

লাভ করছে ৩৭ দেশ

গরমে আরামের জন্য দরজা-জানালা খোলা রেখে রুমে এসি চালালে কি লাভ হয়? ঘর তো ঠান্ডা হবে না, মাঝখান থেকে কেবল বিদ্যুতের খরচ হবে। দেশের বাণিজ্যের অবস্থাটাও ঠিক যেন তেমন। রফতানিতে যত আয়, তার চেয়ে ব্যয় বেশি! আয়ের ৮০ শতাংশই ছিদ্রপথে চলে যাচ্ছে বিদেশে।

সরকারি স্তরে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নিলেও ঠেকানো যাচ্ছে না অর্থ পাচার। আর যাবে বা কী করে, সর্ষের মধ্যে যে ভূত! রফতানি সংস্থার মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে পাচারের পথ চওড়া করছেন ব্যাংক ও শুল্ক বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা। এতে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে শীর্ণ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মিলেছে এ তথ্য। 

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন মতে, প্রধানত ১০টি দেশ অর্থ পাচারের বড় গন্তব্যস্থান। দেশগুলো হলো- সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড।

অন্য একটি তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ভোগ করছে ৩৭টি দেশ। তার মধ্যে- ভারত, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন ও জাপান। সুযোগ বুঝে সেই কালো টাকা আত্মসাতের খেলায় নেমেছে- ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়া, তুরস্ক, বেলারুশ ও মরিশাস। মূলত কয়েকটি মাধ্যমে টাকা পাচার হয়। এর মধ্যে বাণিজ্য কারসাজি বা আমদানিতে বেশি (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও ভিআইপি ব্যবসা অন্যতম। সম্প্রতি দেশ থেকে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার তথ্যও মিলেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, প্রতি বছর দেশে গড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে; কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে, দেশ থেকে গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাচার রোধে বিভিন্ন কথা বলা হলেও, বাস্তবে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। তাছাড়া পাচারের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী জড়িত থাকায়, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। 

মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বিদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। কানাডায় রয়েছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা ‘বেগমপাড়া’। দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের পাচার করা টাকা দিয়ে গড়ে উঠেছে সেই ‘স্বর্গরাজ্য’। এ ছাড়া ব্রিটেন, হংকং, সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকেও বাংলাদেশিদের বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে।

জিএফআইর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ সালে পাচার হয় ৪২৬ কোটি ডলার। একই ধারায় ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি, ২০০৯ সালে ৫১০ কোটি, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি, ২০১২ সালে ৭২২ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি, ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি এবং ২০১৫ সালে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়। এরপর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানিয়ে সংস্থাটি বলেছিল, বিগত বছরগুলোতে অর্থ পাচারের ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে।

তবে আগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংস্থাটি জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। সে হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। আর ১০ বছরে পাচার হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। 

সুইস ব্যাংক তার আমানতের সর্বশেষ তথ্য গত জুনে প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ডের এই ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশের অবস্থান। অথচ বাংলাদেশি আইনে কোনো নাগরিকের বিদেশি ব্যাংকে আমানত রাখার সুযোগ নেই।

অভিযোগ রয়েছে, অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত কতিপয় সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা। সাম্প্রতিক সময়ে এদের বেশ কিছু নামও প্রকাশিত হয়েছে। 

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের অধীনে তদন্তাধীন আটটি অর্থ পাচার মামলার তথ্য সম্প্রতি হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে। তাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ মোট ছয়টি দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে সাতটি মামলায় পাচারকৃত মোট অর্থের পরিমাণ ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৬ টাকা। এসব অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে আছে- যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ও ক্যাসিনোকাণ্ডের মূলহোতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বহিষ্কৃত কমিশনার মোমিনুল হক সাঈদ, রাজীব হোসেন রানা, জামাল ভাটারা, শরিফুল ইসলাম, আওলাদ হোসেন, শাজাহান বাবলু, নাজমুল আবেদীন, সোহেলা আবেদীন, একেএম জাহিদ হোসেন, এ অ্যান্ড বি আটারওয়্যার অ্যান্ড নর্ম আউটফিট অ্যান্ড একসেসরিস লিমিটেড, সিইপিজেড-চিটাগাংয়ের। তবে সম্রাট ও আরমানের বিরুদ্ধে করা মামলায় সবচেয়ে বেশি ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচারের তথ্য রয়েছে। সব মামলা তদন্তাধীন এবং পাচারকৃত টাকা উদ্ধারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের তথ্যও রয়েছে সিআইডির প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, রিজার্ভ চুরির ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপাইনে এবং ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় পাচার করা হয়। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৩ কোটি সাড়ে ৪ লাখ ডলারের মতো। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ অনুযায়ী সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবিরের স্বাক্ষরে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে। মূলত বিদেশে কারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের বিষয়ে হাইকোর্ট জানতে চেয়েছিল।

এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস বলেন, ‘প্রতিবেদনটি খুবই সংক্ষিপ্ত। এতে অর্থ পাচারের সার্বিক চিত্র ওঠে আসেনি। তাছাড়া প্রতিবেদনে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা পুরনো। এসব তথ্য সবারই জানা।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অর্থনীতির ওপর যে বিশাল চাপ, তার অন্যতম কারণ অর্থ পাচার এবং সবক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব কাজ করছে। আর যে প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়, তার সঙ্গে সরকার বা রাজনৈতিক মহলের একটি অংশ জড়িত। এখানে হাত দিতে যাবে কে? তাই তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে হয়।’ 

এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘অর্থ পাচাররোধে কঠোর আইন আছে। যারা অর্থ পাচারে জড়িত তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত বা দ্বিগুণ জরিমানা করারও আইন আছে। অথচ এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।’

জিএফআইর তথ্য মতে, দেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচারের শিকার। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার ধারণা অর্থ পাচারের ৯০ ভাগই দুর্নীতির টাকা। বাকি ১০ ভাগ চলে যায় বিনিয়োগ পরিবেশ দুর্বলতার কারণে। এর মধ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তা এবং অনাস্থাও রয়েছে। এসব কারণে আংশিক বৈধ টাকা চলে যাচ্ছে অবৈধ ঠিকানায়। মূলত দেশে দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে বিদেশে টাকা পাচার রোধ করা যাবে না। আবার নিয়ম-কানুনের ফাঁকফোকরের কারণেও দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার বাড়ছে।’

টাকা পাচারের আরও একটি বড় মাধ্যম হলো রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়)। একটি চক্র বিদেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। অনেকে আবার বিদেশে সম্পদ গড়ছেন, জমা রাখছেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।

একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। মূলত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চলে দোকান বা ‘সেবা’ খুলে বসেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা, যাদের বেশিরভাগই ভারতীয়। তারা প্রবাসীর কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে দেশে পাঠায় বাংলাদেশি টাকা। এতে করে রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমে কমছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //