খামারের সাপ দেখাচ্ছে ‘মণি’র স্বপ্ন

‘বাবুরাম সাপুড়ে, কোথা যাস বাপুরে? আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা’- ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ালে নিশ্চয়ই মনে পড়বে সাপুড়ের সেই সাপ খেলা। রঙচঙে পোশাক পরা, হাতে লাল কাপড়ে বাঁধা বিন, মাথায় পাগড়ি, কাঁধে ঝোলার মধ্যে বেতের ঝুড়ি থেকে বের করত বড় বড় ‘বিষাক্ত’ যত সাপ। সে বেলায় ভয় পেলেও এখন জানা যায়, ভয়ের কিছু নেই- এ সাপের দাঁত নেই, নখ নেই, এমনকি ছোটে না সে হাঁটে না, কাউকে সে কাটে না। করেও না ফোঁস ফাঁস, ঢুঁশঢাঁশ মারে না, নেই তার উৎপাত। কেবলই বাপুরাম সাপুড়ের বিন ও ডুগডুগির ইশারায় সাপগুলো নরে-চরে, খেলা করে। 

তাই অনেকেরই ধারণা সাপকে বশে আনা একমাত্র সাপুড়ের-ই কাজ। এরা মাটির গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারে কোথায় কোন সাপ আছে। বিষাদাঁত ভেঙে অনায়াসেই পুরে নিতে পারে ঝুলিতে। যদিও এখন আর সেই আলখাল্লা পরা সাপুড়ের দেখা মেলে না। ছোটদের বইয়ের পাতা থেকেও হারাতে বসেছে সুকুমার রায়ের ‘বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে’ ছড়াটি। 

এদিকে ক্রমেই প্রতিকূল হচ্ছে পরিবেশ। ঝোপ-ঝাড়, চাষের ক্ষেত নির্বিচারে ধ্বংস করে মাথা তুলছে বাড়িঘর। যার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলার মাঠ-ঘাটের চিরচেনা সেই সর্পকুলকেও। নিজ ভিটেমাটি থেকে উৎখাতের পাশাপাশি টান পড়ছে তাদের খাদ্যসম্ভারে। আবার চাষে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের বিষ খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে তাদেরও নিয়মিত হজম করতে হচ্ছে। এর রেশ গিয়ে পড়ছে প্রজননচক্রে। 

আবার সাপ নিয়ে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের যা জ্ঞান, তা এসেছে সাপুড়েদের থেকে। ফলে এ নিয়ে রয়েছে নানা প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অমূলক ধারণা। অনেকেই মনে করেন, সাপ একবার কারও দ্বারা আক্রান্ত হলে সে আক্রমণকারীকে চিনে রাখে এবং রাতে এসে কামড়ে দিয়ে যায়। এ ছাড়াও দেশের প্রায় সব সাপকেই বিষধর বলে ধরে নেওয়া হয়। আর এসব ভুল ধারণা থেকে সাপ দেখলেই হত্যায় মেতে ওঠে মানুষ। সব মিলিয়ে জীবনের অসম লড়াইয়ে এই সরীসৃপরা আজ হারতে বসেছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। অথচ মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তৈরির অন্যতম উপাদন সাপের বিষ।

ওষুধের পাশাপাশি গবেষণার কাজেও ব্যবহার করা হয় সাপের বিষ। আবার মাদকেও এখন সাপের বিষ মেশানো হচ্ছে। তাই সোনার চেয়েও এর দাম বেশি বিশ্ববাজারে, এক লিটার প্রায় চার কোটি টাকা। এ যেন সাপের মাথায় সত্যিকারের ‘মণি’। অসম্ভব লাভজনক হওয়ায় দেশের অনেক এলাকাতেই এখন বাণিজ্যিকভাবে সাপ চাষ হচ্ছে। 

যদিও বন বিভাগ বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত সাপের খামারের কোনো লাইসেন্স দেয়া হয়নি। ফলে যারা এ ধরনের খামার করেছেন তা অবৈধ। এদিকে আইনগত এমন জটিলতায় হাতের কাছে থেকেও দেশের খামারে উৎপাদিত সাপের বিষ ব্যবহার করতে পারছে না ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাধ্য হয়ে তাই বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা পণ্যটি বিদেশ থেকে আমদানি করেন। আর দেশের মূল্যবান এ সম্পদ পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চলে যাচ্ছে সাপের চামড়া-মাংসও।

‘রসুন’ বুনে সবুর

পটুয়াখালী সদর উপজেলার নন্দীপাড়া গ্রামের আবদুর রাজ্জাক এইচএসসি পাস করেই পাড়ি জমান সৌদি আরবে। চাকরি নেন সেখানকার একটি স্টুডিওতে। অবসরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাপ ধরা ও পালনের পদ্ধতি দেখেই সময় কাটত তার। এক সময় সাপের প্রেমে পড়ে যান, এদের নিয়েই ঘর-বসতির পরিকল্পনা সাজান। ২০০০ সালে নিজ বাড়ির সামনে প্রায় দুই একর জমিতে গড়ে তোলেন সাপের খামার। একটি গোখরা আর ২৪টি ডিম নিয়ে যাত্রা তার ‘বাংলাদেশ স্নেক ভেনম’। এখন প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার বিষ উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন তরুণ এই উদ্যোক্তা। 

যদিও এখন পর্যন্ত সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় বিষ উৎপাদনসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারছেন না দীর্ঘ দুই দশকেও। এখন বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ আছে কয়েকশ; কিন্তু খামার থেকে কোনো আয় না হওয়ায় কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না আবদুর রাজ্জাক। আবার না পারছেন সাপগুলোর খাবার জোগাতে, না পারছেন ছেড়ে দিতে।

আবদুর রাজ্জাক জানান, ২০০৮ সালে সরকার বেসরকারিভাবে সাপের বাণিজ্যিক খামার স্থাপনের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রবাসী এই তরুণ খামারটি গড়ে তোলেন। এরপর ২০১২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদফতরের বরিশাল কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক তা পরিদর্শন করে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। সে অনুযায়ী নিবন্ধনের জন্য ওই বছরের ৭ নভেম্বর প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন আবদুর রাজ্জাক। আবেদন জানান বন বিভাগেও। বিষ সংগ্রহের জন্য ঘুরেছেন সরকারের বিভিন্ন দফতরে; কিন্তু লাভ হয়নি কোনো কিছুতেই। 

ক্ষোভ প্রকাশ করে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘বিদেশে উপার্জিত অর্থের পুরোটাই এই খামারে বিনিয়োগ করেছি। বেশ কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছে প্রতিদিন। কোনো আয় না হলেও দীর্ঘ ২০ বছর ধরে খরচ টেনে যাচ্ছি। অথচ আমার উদ্যোগে খুশি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। এরপরও কী কারণে অনুমোদন প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ফাইলবন্দি হয়ে আছে, তার কিছুই জানি না।’ 

আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে বরিশাল, রাজশাহী, ফরিদপুরসহ বেশ কিছু জায়গায় অনেকেই সাপ পালন শুরু করেছিলেন। এখন সবারই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই উদ্যোগ।

আর কত দেরি পাঞ্জেরী

বেসরকারিভাবে সাপের চাষ উদ্বুদ্ধ করতে অবশ্য বিধিমালা নিয়ে কাজ করছে বন অধিদফতর। ‘সাপের খামার ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৯’ শিরোনামে ওই পরিকল্পনাটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটির চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেই বাণিজ্যিকভাবে সাপ চাষের দায়িত্ব পাবেন উদ্যোক্তারা। তখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে সাপের বিষ, চামড়া ও মাংস রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বিধিমালা তৈরির অগ্রগতি প্রসঙ্গে বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে জানান, সাপ চাষে সরকারও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে বিধিমালা চূড়ান্তে কিছুটা সময় লাগছে। সবার মতামত নিয়ে দ্রুত সেটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো সম্ভব হবে।

এদিকে বন অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘সাপের খামার ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৯’-এ বলা হয়, কোনো খামারি এই বিধিমালার অধীন লাইসেন্স না নিয়ে সাপের খামার স্থাপন ও পরিচালনা এবং সাপ ও সাপজাত পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবেন না। তাছাড়া আগে থেকেই কোনো ব্যক্তি সাপ লালন-পালন, খামার স্থাপন বা আমদানি-রফতানি পরিচালনা করে থাকলে; তাকে বিধিমালা কার্যকরের ৬০ দিন অর্থাৎ, দুই মাসের মধ্যে লাইসেন্স নিতে হবে। আর খামার স্থাপনের জন্য কমপক্ষে দুই একর নিজস্ব মালিকানাধীন বা দীর্ঘমেয়াদি (কমপক্ষে ৩৩ বছর) ইজারাকৃত জমি থাকতে হবে। অবশ্যই সেই জমি হতে হবে বন্যামুক্ত। সরকার নিয়ন্ত্রিত বনাঞ্চলের কমপক্ষে দুই কিলোমিটার এবং জনবসতির ৫০০ মিটার দূরে সাপের খামার স্থাপন করতে হবে। কোনো শিল্প কারখানা এলাকার এক বর্গকিলোমিটারের আশপাশেও সাপ পালা যাবে না। আবার খামারে দক্ষ জনবলের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সড়ক যোগাযোগের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। খামার ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার থাকতে হবে প্রাণিবিদ্যা বা বনবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। তবে বিদেশ থেকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য। খামার তদারকি ও সাপ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন সাপুড়েরা।

আশার আলো

২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে রাজশাহীতে একটি এলাকায় একই প্রজাতির সাপে কাটায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ২০ জন। এর কারণ হিসেবে প্রতিষেধক অ্যান্টিভেনম যথাযথ কাজ না করাকেই দায়ী করেন চিকিৎসকরা। 

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অঞ্চলভেদে সাপ যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি বিষের মাত্রাতেও থাকে তারতম্য। তাই প্রতিষেধকের কার্যকারিতা নিশ্চিতের জন্য স্থানীয় সাপের বিষ দিয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশেই সাপে কাটার প্রতিষেধক তৈরির লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পোষা হচ্ছে নয় প্রজাতির ১২০টি সাপ। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

প্রকল্পের কো-ইনভেস্টিগেটর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, ‘সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা তুলনামূলক ব্যয়বহুল। প্রতি বছর সরকারকে এ খাতে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। আমদানি নির্ভরতা কমানো ও প্রতিষেধক যেন শতভাগ কার্যকর হয়, সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) শাখার পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনমের চাহিদা রয়েছে। চাহিদার ভিত্তিতে প্রত্যেক বিভাগীয় হাসপাতালে বছরে ৫০০ ভায়াল, প্রত্যেক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০০ ভায়াল ও প্রত্যেক সদর হাসপাতালে ৫০ ভায়াল অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়। দেশে অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণা সফল হলে বাইরে থেকে আর এই প্রতিষেধক আনতে হবে না। সাপের বিষের প্রতিষেধক দেশেই অনেক সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যাবে তখন।’

সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ এবং বাঘ ও সাপ গবেষক খসরু চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে আবহাওয়ার যে প্রকৃতি, তাতে এ দেশে সরীসৃপজাতীয় শীতল রক্তের প্রাণীদের জীবনযাপনের জন্য একেবারে উপযুক্ত বলা যেতে পারে। বছরে মাত্র চার মাস হালকা শীতকাল, বাকি আট মাস গরমকাল- তারও অধিকাংশ সময় বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এ দেশে নানা জাতের গাছপালা জন্মায়, রয়েছে হাজারো প্রজাতির কীটপতঙ্গ। এমন পরিবেশ সাপের বসবাস ও বিকাশের জন্য আদর্শ।’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //