প্রণোদনা যাচ্ছে কার পকেটে

করোনাভাইরাসে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় বিভিন্ন খাতে এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এই প্যাকেজের মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। 

পৃথক শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য রয়েছে পৃথক তহবিল; কিন্তু প্রণোদনার বিতরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। কারা পাচ্ছে প্রণোদনার অর্থ? বড় শিল্পপতিদের প্রণোদনা দিতে ব্যাপক আগ্রহী ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে ছোট ব্যবসায়ী, কৃষক ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ঘোষিত প্যাকেজের বাস্তবায়নে অনেকখানি পিছিয়ে গুলো। 

এতে প্রণোদনার তহবিলের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে যেমন সংশয় তৈরি হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের গতিও কমেছে। 

প্রণোদনার প্যাকেজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও বড় দুটি প্যাকেজ হলো- বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ। এটি পরে দু’দফায় বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আরেকটি হলো- কটেজ, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল। দুটি প্যাকেজই গত এপ্রিলে ঘোষণা করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভর্তুকি সুদে ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বড় উদ্যোক্তারা সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে এবং ছোট উদ্যোক্তারা ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই প্যাকেজের আওতায় মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ২৭ হাজার সিএমএসএমই প্রতিষ্ঠান এই ঋণ পেয়েছে। গত ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সব অর্থ বিতরণের নির্দেশনা ছিল; কিন্তু এই সময়ে সিএমএসএমই খাতে মোট বরাদ্দের ৩৫ শতাংশ অনুমোদন করেছে ব্যাংকগুলো আর বিতরণ করেছে মাত্র ২৮ শতাংশ। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ বিতরণের সময়সীমা আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। 

  • বৃহৎ শিল্পের প্রণোদনা প্রায় শতভাগ বিতরণ
  • ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের বিতরণ মাত্র ২৮ শতাংশ
  • শর্তের বেড়াজালে আটকা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা

প্রথমে প্রণোদনার ২০ হাজার কোটি টাকাই ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করতে বলা হয়েছিল; কিন্তু ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কথা ভেবে পরবর্তী সময় তহবিলের ১০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন করার ঘোষণা দেয়া হয়। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে অগ্রাধিকার দিতে শুরুতেই ব্যাংকের ধরন অনুযায়ী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু শুরুতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে কোনোক্রমেই গতি আসছিল না। ঋণ বিতরণ বাড়াতে গত ২১ জুন মাসিকভিত্তির পরিবর্তে পাক্ষিক ভিত্তিতে ঋণ বিতরণের তথ্য জানাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় গত জুলাই ও আগস্টে ঋণ বিতরণের টার্গেটের সীমা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও সিএমএসএমই ঋণ বিতরণে কাক্ষিত গতি আসেনি।

গত মাসের প্রথমদিকে ঋণ বিতরণে আগ্রহ না দেখানো ২৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া কম ঋণ বিতরণ করা আরো ২৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে চিঠি পাঠানো হয়। এরপর গত ২১ অক্টোবর সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া গতিশীল করতে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দিয়ে আরো একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব নির্দেশনা সত্ত্বেও এখনো সাতটি ব্যাংক এক পয়সাও বিতরণ করেনি। 

বাস্তবতার কারণেই সিএমএসএমই ও কৃষি খাতের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি- মন্তব্য করে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কিছু কঠিন শর্তের কারণে সিএমএসএমই খাতের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ধীরগতি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি শর্তগুলোতে কিছু ছাড় দিয়েছে। করোনাভাইরাসের মধ্যেই দেশের বড় অংশজুড়ে বন্যা নেমে এসেছে। পরিস্থিতির কারণেই গ্রাহকদের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি ব্যাংকগুলো সব প্যাকেজ বাস্তবায়নে তৎপরতা বাড়িয়েছে।’

অন্যদিকে, বিপরীত চিত্র বড় শিল্পপতিদের প্যাকেজে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যারা প্রভাব খাটিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, সময়মতো পরিশোধ না করে খেলাপি হয়েছেন, পেয়েছেন নিত্যনতুন সুবিধা, তারাই পাচ্ছেন প্রণোদনার অর্থ। বিভিন্ন ব্যাংক, বেক্সিমকো, এস আলম, থার্মেক্স, মায়শা ও নাভানা গ্রুপসহ বিভিন্ন খেলাপি প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ নিয়েছে। 

ব্যাংক খাত থেকে ইতিমধ্যে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি গ্রুপ। সরকারি চার ব্যাংক থেকে মাত্র ৬৯ গ্রাহক নিয়েছেন ৫৯ হাজার কোটি টাকা। তারা কখনোই ব্যাংকের টাকা ফেরত দেননি। খেলাপি হয়ে নিয়েছেন পুনর্গঠন, বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল, গণছাড়, সুদ মওকুফসহ নানা সুবিধা। করোনাকালীন ক্ষতি কাটাতে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থও তারাই নিচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ বাড়িয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা করার পর প্রায় শতভাগ বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। এখন আবার বিতরণের জন্য ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সার্বিকভাবে ছোট উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা বেশি দেয়া প্রয়োজন ছিল; কিন্তু ব্যাংকগুলো সে পথে হাঁটেনি। বড়রা বেশি পাওয়ায় রফতানিমুখী শিল্প সচল হতে সহজ হবে; কিন্তু রফতানি বাড়বে কি-না, তা নির্ভর করছে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ওপর। কারণ সেখানে সংক্রমণ বাড়ছে। বড়দের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের শঙ্কা থাকলেও শিল্প কারখানা চালু হলে কর্মসংস্থানে সহায়ক হবে।’

বিভিন্ন ব্যাংকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেক খেলাপি গ্রাহকই সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পকেটে ভরছেন। ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে আসলামুল হকের মায়িশা গ্রুপ ঋণ নিয়েছে দুই হাজার ২০৯ কোটি টাকা। দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ ঋণগ্রহীতা বেক্সিমকো গ্রুপ। এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল করে। গ্রুপটি আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ‘সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিটে’র বেশি প্রণোদনা দাবি করে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত দাবি অনুমোদন না করে সীমার মধ্যেই অনুমোদন করেছে। 

জনতা ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাইনপুকুর গার্মেন্টস ৪৫ কোটি, বেক্সটেক্স ৪৫ কোটি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ৪৫ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস ১ ও ২-এর নামে ৮০ কোটি টাকা প্রণোদনা পাচ্ছে। সোনালী ব্যাংক থেকে গুলশান স্পিনিং মিলস সাড়ে সাত কোটি ও গুলশান স্পিনিং মিলসের ১, ২ ও রোটর নামে ১৬ কোটি টাকা প্রণোদনা নিয়েছে। ব্যাংক খাতের আলোচিত গ্রুপ থার্মেক্স। বিভিন্ন সময়ে খেলাপি হওয়া এ গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঋণখেলাপিদের প্রণোদনার অর্থ না দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। যেসব গ্রাহকের ঋণ ফেরত দেওয়ার ইতিহাস খারাপ, ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি, নানা সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন- তাদের প্রণোদনার টাকা দেয়া উচিত হবে না। এতে প্রণোদনার অর্থের অপচয় হবে। ব্যাংকিং খাতে নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়বে। অন্যদিকে যে উদ্দেশ্যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে সেটি সফল হবে না এবং প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই ঋণ-শৃঙ্খলা ও বিধিবদ্ধ নিয়মনীতি মেনেই প্রণোদনা দেয়া উচিত।

একক গ্রাহককে অতিরিক্ত ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই না করেছে। একক ঋণগ্রহীতাকে অধিক ঋণ দেয়ার কারণে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, একটি প্রতিবেদনে সেই বিষয়ে সতর্ক করা হয়। 

আর্থিক স্থিতিশীলতা শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ১২ ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়বে। আর শীর্ষ সাত ঋণগ্রহীতা অর্থ ফেরত না দিলে সংকটে পড়বে ২০ ব্যাংক; কিন্তু এ ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই বড় বড় ঋণগ্রহীতার প্রণোদনার অনুমোদন দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //