বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় সাধারণের নাভিশ্বাস

লাগামহীন দেশের বাজার ব্যবস্থা। আকাশছোঁয়া অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম। নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বাজারে থরে থরে সাজানো নতুন পুরাতন হরেক রকমের সবজি; কিন্তু তা ছুঁয়ে দেখার জো নেই। অধিকাংশ পণ্যের গায়ে যেন আগুন, তাতে হাত দেওয়া যাবে না! রাজধানীর বাজারগুলোতে সব রকমের সবজি আছে, পণ্যের সরবরাহও ঠিকঠাক আছে, কোথাও ঘাটতিও নেই। তাহলে দাম কেন এত বেশি- এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সবার জানা, আবার অজানাও। একটিই উত্তর- সিন্ডিকেট।

সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা হয় ঢাকায় বসবাসকারী হাবিবুর রহমান মামুনের। গত সপ্তাহে মামুন তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায় গিয়েছিলেন। ঢাকা এবং সাতক্ষীরার বাজারে নিত্যপণ্যের দামের তফাৎ নিয়ে তিনি বলেন, ‘সাতক্ষীরার বড় বাজারে বেগুনের কেজি শুনলাম ৩৫ টাকা, ঢাকা এসে কিনছি তা ৮০ টাকায়। চালের দামেও একই অবস্থা। আবার খোঁজ নিয়ে জানলাম, যে চাষি এই সবজি উৎপাদন করছে তিনি বিক্রি করছেন হয়তো কেজিপ্রতি ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকা।’ মফস্বল সাতক্ষীরা আর ঢাকা এক না হলেও দামের পার্থক্য এতটা কীভাবে হয়! সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের দ্রব্যমূল্যের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী সিন্ডিকেট ও প্রশাসনের গাফিলতি, সর্বোপরি বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে চাল, আলু ও সবজিসহ অধিকাংশ পণ্য। শতকের ঘর পার হয়ে আছে শিম, টমেটো। আকাশ ছোঁয়া বেগুন, গাজর ও কাঁচামরিচের দাম। এদিকে চলতি সপ্তাহে দাম বেড়েছে শসা, পটোল, করলা, ঢেঁড়স, ঝিঙা, কাঁকরোলেরও। আগের মতো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে অন্য সবজি। বাজারে ৫০ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে কেবল মুলা ৪০ থেকে ৫০ এবং পেঁপে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি। লাউয়ের পিস ৭০ থেকে ৮০ টাকা, শীতের আগাম সবজি ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। এ ছাড়া কাঁচামরিচের কেজি ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা। আর আলুর দাম তো রেকর্ড করেছে। স্মরণকালের সেরা দাম বাজার ভেদে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যের সরবরাহ কমছে। বন্যায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে দাম বাড়ছে। তবে ভোক্তাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছেন। মজুদ পর্যাপ্ত থাকলেও কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ক্রেতাদের পকেট কাটছেন। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ব্যবসায়ীরা কারসাজির মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়ায়। যতদিন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না হবে, ততদিন বাজারে এই অনিয়ম হতে থাকবে। এমনিতেই করোনাকালে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় মাছ-মাংস কেনার সামর্থ্য নেই অনেকের। সবজিতে ভরসা ছিল বেশিরভাগ পরিবারের। এখন সেই সবজির দামই ভোগাচ্ছে। একে একে ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে গেছে সব তরকারির দাম। বাজারে ৬০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজি। গত দুই মাস ধরে রাজধানীর বাজারে দামের উত্তাপ বইছে। তবে কিছুদিন ধরে তা অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গরিবের খাবার আলুর দাম সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। সবজির অস্বাভাবিক দাম ভোগাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণির ভোক্তাকে। সবজির এমন দামে ভোক্তা যেমন ঠকছেন, তেমনি ঠকছেন কৃষকও। তবে পোয়া বারো মধ্যস্বত্বভোগীদের। রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজার এবং বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কৃষকের কাছ থেকে হাতবদলে ভোক্তার কাছে সবজি পৌঁছতে দাম কয়েকগুণ বাড়ে। হাতবদলের এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ঠকছেন কৃষক। মাঠ থেকে কম দামে সবজি কিনে খুচরা বাজারে কয়েকগুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে। সেই দামেই সবজি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ভোক্তারা। 

বিভিন্ন জেলার সবজি ব্যাপারীরা বলছেন, যে সময় ফলন ওঠার কথা সেই সময় এসব অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি হওয়ায় সবজির ক্ষেতের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। যার প্রভাব দামেও পড়েছে। তবে কৃষকরা বলছেন, মাঠে সবজির দাম কমলেও বাজারে বাড়ছে অনেক বেশি। বৃষ্টিতে ফলন কমে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে রয়েছেন কৃষকরা।

রামপুরা ওয়াপদা রোডের বেসরকারি চাকরিজীবী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাজারে প্রচুর সবজি, শীতের আগাম সবজিও বেড়েছে। অথচ দোকানিরা বলছে, সবজির সরবরাহ নাকি কম, তাই দামও বেশি। আসলে বেশি লাভের আশায় বন্যা-বৃষ্টির অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। আর পকেট কাটছেন আমাদের। বাজারে আলুর দাম এতটা বাড়ার পেছনে কারণ কি কেউ বলতে পারবে? বাঙালি কখনো এতদামে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ কিংবা আলু কিনে খায়নি। এটি বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা।’

হাতবদল হয়ে দাম কিভাবে কয়েকগুণ বাড়ছে, তা দেখে নেওয়া যাক- একটি সবজি বিক্রি করে কৃষক পাচ্ছেন এক দাম, মফস্বলে বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে, আর তা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত ধরে রাজধানীতে এসে বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে। গত ১৭ তারিখের চিত্র- পাবনা শহর ও বিভিন্ন হাটের বাজারদর একটু জেনে নেওয়া যাক। কৃষকরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন প্রতি কেজি পেঁপে ১৫ থেকে ২০ টাকা, পটোল ৩০ থেকে ৪০, বেগুন ৪০, মুলা ২০ থেকে ২২, বরবটি ৫৫ থেকে ৬০, শিম ৪০ থেকে ৫০, করলা ৪০, ঝিঙা ২৫ এবং কাঁকরোল ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। অথচ রাজধানীর পাইকারি বাজারে পরদিন প্রতি কেজি শিম ১০০ টাকা, বেগুন ৭০ থেকে ৯০, পেঁপে ৩০ থেকে ৩২, পটোল ৫৫ থেকে ৬০, বরবটি ৬০ থেকে ৬৫, করলা ৬৫ থেকে ৭০, ঝিঙা ৬০ থেকে ৬২ এবং কাঁকরোল ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। একইদিন রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি শিম বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়, পেঁপে ৪০ থেকে ৫০, পটোল ৮০, মুলা প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০, বরবটি ৮০ থেকে ৯০, ঝিঙা ৭০ এবং কাঁকরোল ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। যশোরে দেশের সবজির অন্যতম বৃহৎ বাজার সাতমাইল হাট। গত শনিবার এই হাটে পাইকারিতে বেশিরভাগ সবজি বিক্রি হয়েছে ঢাকার পাইকারির প্রায় অর্ধেক দামে। এদিন পাইকারি দরে প্রতি কেজি শিম ৪৫ থেকে ৬০ টাকা, বেগুন ৪৫ থেকে ৫০, পেঁপে ২০, পটোল ৪০ থেকে ৪৫, বরবটি ৪০ থেকে ৪৫, করলা ৫০ থেকে ৫৫, টমেটো ৫০, মুলা ২৫, কাঁচামরিচ ১৫০ এবং লাউ মানভেদে ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হয়। যশোর সদরের সবজি চাষি রফিকুল বলেন, ‘প্রতিদিন শহরের ব্যাপারীরা এখানকার ক্ষেত থেকে এক হাজার ৫০০ থেকে শুরু করে এক হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে শিম কিনে নিয়ে যায় শহরে। এতে প্রতি কেজির দাম পড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আমরা চাইলেও এর চেয়ে বেশি দাম পাই না। অথচ যশোর শহরের সবজির বাজারেই প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে।’

দাম বাড়ার পেছনে কারও কারসাজি নেই বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাপারী, আড়তদার ও পাইকাররা। তাদের মতে, সবজি কাঁচা পণ্য হওয়ায় মজুদ করা সম্ভব নয়। তবে কৃষকের কাছ থেকে খুচরা বাজারে পৌঁছাতে কয়েক হাতবদল হওয়ায় দাম বেড়ে যায়। মূলত বৃষ্টি-বন্যায় এবার সবজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে বলে দাবি তাদের। কাওরান বাজারের সবজি সরবরাহকারী পাইকারি ম্যানেজার বলরামচন্দ্র দাস বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় সবজি আনতে আগে ট্রাক ভাড়া লাগত ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা; কিন্তু এখন ভাড়া নিচ্ছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শ্রমিক খরচসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। তার ওপর সবজি আনার পথে বিপুল পরিমাণ সবজি নষ্ট হয়। সব মিলিয়ে সবজির দাম বাড়লেও খুব বেশি লাভ করতে পারছি না আমরা।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এবার গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তিন লাখ ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে। সেখানে এবার তিন লাখ ৪৫ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অন্তত ১০২ শতাংশ বেশি। বৃষ্টিপাত হলেও সরবরাহ ঘাটতি তীব্র হওয়ার কথা নয়। সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয়। সরকার চালসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা মানছেন না ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকার কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা লুটছে। মাঠে কৃষক থেকে বাজারে ভোক্তা উভয়ে ঠকছেন। হাতবদলের সংখ্যা কমাতে হবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল খুচরা বাজার অথবা ভোক্তার কাছে সরাসরি বিক্রি করতে পারলে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা করতে পারত না।’

এ ছাড়া কৃষকপর্যায় থেকে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরকারের মনিটরিং বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা আরও সহজতর ও সহজলভ্য করার তাগিদ দেন তিনি। গোলাম রহমান আরও বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে যখন সবার আয় কমেছে, তখন সব জিনিসের দাম বেড়েছে। এটি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। অতি মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ যদি সরবরাহ কম দেখিয়ে দাম বাড়ায়, তাহলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবে আইন যদি না থাকে, আইনের যথাযথ ব্যবহার যদি না হয়, বা বিচার ব্যবস্থায় যদি দীর্ঘসূত্রতা থাকে, তাহলে কারসাজিকারীদের দৌরাত্ম্য আরও বাড়বে। এতে দুর্ভোগের শিকার হতে হবে সাধারণ মানুষকে।”

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //