বিদায় মানে প্রস্থান নয়

ইরফান খান, যার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি শুধু মন জয় করা বাজারি অভিনেতা ছিলেন না; বরং প্রতিটি চরিত্র তিনি নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। দর্শককে ওই চরিত্র নিয়ে ভাবতে বাধ্য করতেন।

অভিনয় মানে যে নাচন-কুর্দন নয়; বলিউডে ইরফানের মতো আর দু-চারজনই শুধু আছেন, যারা সেটি কাজের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন। যখন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে পতিত হচ্ছেন একের পর এক বলিউড অভিনেতা; তখন এমন একজন সমাজ সচেতন অভিনেতার চলে যাওয়া অবশ্যই এক বড় আঘাত!

বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যুতে তিনি মতামত রেখেছেন। গত ২৯ এপ্রিল মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালে তার পাশেই ছিলেন স্ত্রী সুতপা সিকদার এবং দুই ছেলে।

ক্ষণজন্মা এ অভিনেতার প্রয়াণ কখনোই কাম্য হতে পারে না। যদিও বছর দুয়েক আগে যখন নিওরোএন্ডোক্রাইন টিউমার নামক বিরল রোগ ধরা পড়েছিল, তখনই ধারণা করা হচ্ছিল, সময় হয়তো ফুরিয়ে আসছে। এর পরেও শারীরিক সীমাবদ্ধতা ও তীব্র যন্ত্রণা এড়িয়ে ইরফান কাজ করে গেছেন; অসাধারণ অভিনয়ে রূপালি জগতের চরিত্রগুলোকে বাস্তবে টেনে নামিয়েছেন। আমরা ভেবেছিলাম, আরো কিছু সময় হয়তো তিনি পাবেন, হয়তো আরো অনেকটা দেয়ার ছিলো তার- এই আক্ষেপ থেকেই যাবে!

১৯৬৭ সালের ৭ জানুয়ারি রাজস্থানে জন্ম ইরফানের। ক্রিকেটও ভালোই খেলতেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট সি কে নায়ডু ট্রফিতে অনূর্ধ্ব ২৩ ক্যাটাগরিতে খেলার সুযোগ পান। তবে অর্থাভাবে শেষ পর্যন্ত সে পথে পা বাড়ানো হয়নি।
 
অভিনয়ে ইরফানের আগ্রহ জন্মে তার এক মামার মধ্য দিয়ে; যিনি যোধপুরে মঞ্চ নাটকে কাজ করতেন। ইরফান জয়পুরে মঞ্চ নাটকে কাজ করা শুরু করেন, বেশ নামও করেন। জয়পুর থেকেই মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৮৪ সালে পেয়ে যান ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় (এনএসডি) পড়ার জন্য স্কলারশিপ। চলে যান দিল্লিতে।

এরপর ১৯৮৭ সালে পাড়ি জমান স্বপ্নের নগরী মুম্বাইয়ে। সেখানে তিনি এয়ার কন্ডিশনার মেরামতের কাজ শুরু করেন জীবিকার তাগিদে, আর এই সূত্র ধরেই আইডল বলিউড স্টার রাজেশ খান্নার বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যান তিনি।

পরে এক সাক্ষাৎকারে রাজেশ খান্না সম্পর্কে ইরফান বলেন, তিনি হলেন বলিউডের প্রকৃত অভিনেতা। তারকা খ্যাতির কারণে অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে, যা রাজেশ খান্না কখনোই করেননি।

ইরফান খান এ কথাগুলো ধারণ করতেন বলেই তার অভিনয়ে দর্শকরা শুধু মুগ্ধই হননি, বাস্তবতায় আচ্ছন্ন হয়েছেন।

শুরুর দিকে মুম্বাইয়ে মূলত মঞ্চে অভিনয় করতেন ইরফান। এর পাশাপাশি ‘চাণক্য’, ‘সারা জাঁহা হামারা’, ‘বনেগি আপনি বাত’ ও ‘চন্দ্রকান্তা’র মতো টেলিভিশন সিরিয়ালেও অভিনয় করেছেন। দূরদর্শনে প্রচারিত ‘লাল ঘাস পার নীলে ঘোড়ে’ নাটকে তিনি ‘লেনিন’ চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি উর্দু বিপ্লবী কবি মহিউদ্দিন মাখদুমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘ক্যাহকাশান’ নাটকে।

১৯৮৮ সালে মীরা নায়ারের ‘সালাম বোম্বে’ সিনেমায় অতিথি শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় দিয়ে বলিউডে যাত্রা শুরু হয় ইরফান খানের। ১৯৯০ সালে ‘এক ডক্টর কি মৌত’ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। এরপর ২০০১ সালে পটপরিবর্তন ঘটে লন্ডনের পরিচালক আসিফ কাপাডিয়ার হাত ধরে। আসিফের ইতিহাসভিত্তিক ‘দ্য ওয়ারিয়র’ সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যায় তাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে সিনেমাটি প্রশংসিত হয়। এই সিনেমার হাত ধরেই চলচ্চিত্র মহলে পরিচিতি পান ইরফান।

২০০৩ সালে শেকসপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ অবলম্বনে ‘মকবুল’ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ইরফান। ২০০৫ সালে ‘রোগ’ সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে দেখা যায় তাকে। এরপর বলিউডে একের পর এক সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

২০০৭ সালে বক্স অফিসে হিট করে তার অভিনীত ছবি ‘দ্য নেইমসেক’ ও ‘লাইফ ইন আ... মেট্রো’ ছবি দুটি। ‘লাইফ ইন আ... মেট্রো’ ছবিতে সেরা পার্শ্ব চরিত্রের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন ইরফান। ২০১২ সালে ‘পান সিং তোমার’ ছবিতে অসামান্য অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

বলিউডের সীমানা ছাড়িয়ে ইরফান নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। কাজ করেছেন একাধিক নামী পরিচালকের সঙ্গে। ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’, ‘লাইফ অব পাই’, ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’, ‘দ্য আমেজিং স্পাইডারম্যান’-এর মতো হলিউডি ছবিতেও অভিনয় করেছেন ইরফান। অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ ছবিতে।

তিনি মুগ্ধ করা অভিনয় করেছেন ‘তালওয়ার’, ‘হিন্দি মিডিয়াম’, ‘কারিব কারিব সিঙ্গেল’, ‘ইংরেজি মিডিয়াম’-এর মতো ছবিতে। তবে ইরফানের কথা আলোচিত হলে ‘লাঞ্চ বক্স’ ছবির নাম আসবেই। ২০১৩ সালের ওই ছবিটি ছিল তার অভিনীত অন্যসব সিনেমা থেকে সেরা- এটি লেখকের ব্যক্তিগত মত। এক বাক্যে বলে দেয়া যায় ছবির পরতে পরতে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে।

ছবিতে নগর জীবনের যে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে, তা কাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে। এতে একদিকে যেমন নগরের মধ্য শ্রেণির জীবনযাত্রার একটি চিত্র উঠে এসেছে, তেমনি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রকাশ পেয়েছে প্রগাঢ়ভাবে- মানুষের আবেগ-অনুভূতি বয়সের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না।

একে বন্দি করে রাখতে বাধ্য করে সমাজ বাস্তবতা, যা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। নাগরিক চাকচিক্য, বা কথিত স্ট্যাটাসের মাঝেও নারী অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপরই নির্ভরশীল। আবার বয়সের বিস্তর পার্থক্য, শারীরিক নৈকট্য না থাকলেও যে সুতীব্র ভালোবাসা থাকতে পারে শুধু চিরকূটে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে- এই সত্যকেই সামনে নিয়ে এসেছেন পরিচালক রিতেশ বাত্রা। নগর জীবনের এসব টানাপড়েন অসাধারণ মুন্সিয়ানায় প্রকাশ করেছে ‘লাঞ্চ বক্স’। ইরফান খানের অভিনয়ে একটিবারও মনে হয়নি যে এটি কোনো কাল্পনিক চরিত্র, বা ওই চরিত্রের মানুষটি তিনি নন।

নাসিরউদ্দিন শাহের পর ইরফান খান, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বা আমির খানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যাদের অভিনয়ে ছবির চরিত্রের সমাজ বাস্তবতা এতোটা প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপিত হয় যে, ওই চরিত্রটিই দর্শকের মনে স্থান করে নেয়। তবে এর মাঝে ইরফান খান অনন্য এ কারণেই যে, তিনি যতটা না শব্দের জাল বুনে চরিত্রকে উন্মোচন করেন, তার চেয়ে বেশি সংলাপ লেখা থাকে তার চোখে। চোখের ভাষায় সংলাপ বলার এ অভিব্যক্তি তাকে নিয়ে গেছে এক নতুন উচ্চতায়। যেখানে ইরফান মানুষের মনে রয়ে যাবেন। বেঁচে থাকবেন তার কাজের মাঝে।
বিদায়, প্রিয় অভিনেতা! এ বিদায় মানে প্রস্থান নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //