বাংলাদেশ ব্যাংকের ফ্রেমওয়ার্ক

খেলাপি ঋণ কমাতে বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টকে অপসারণ

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমানো, মূলধন বৃদ্ধি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন ফ্রেমওয়ার্ক জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় প্রয়োজনে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট অপসারণ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ, ডিভিডেন্ট প্রদান ও নতুন শাখা খোলা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রোম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ শীর্ষক ওই ফ্রেমওয়ার্ক জারি করেছে। 

বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। নীতিমালা অনুসারে, ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চার ভাগে ভাগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি এবং ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের অনুপাত (সিআরএআর) সাড়ে ১২ শতাংশের কম, সেগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হবে। ব্যাংকগুলোর ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের মার্চ থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হবে। 

নীতিমালা অনুযায়ী, মূলত পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে শ্রেণি নির্ধারণ করা হবে। সেগুলো হলো ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার হার (সিআরএআর), টিয়ার-১ ক্যাপিটাল রেশিও বা মূলধন অনুপাত, কমন ইক্যুইটি টিয়ার-১ (সিইটি১)রেশিও, নিট খেলাপি ঋণ এবং করপোরেট গভর্ন্যান্স বা সুশাসন। দেশে ব্যবসারত সব ধরনের দেশি ও বিদেশি ব্যাংকের শাখার ওপর পিসিএ নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। পাঁচ সূচকে লাগাতার পতন হলে সব শ্রেণির ব্যাংককে ‘অনিরাপদ’ ও ‘আর্থিকভাবে অস্বাস্থ্যকর বা দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরপর দুই ক্যাটাগরিতে অবনতি হলে সবচেয়ে ‘দুর্বল’ ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। দুর্বলতা কাটিয়ে ব্যাংকের মানোন্নয়নে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে কোনো ব্যাংককে একীভূত করার মতো পদক্ষেপও নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নীতিমালা অনুসারে, যদি টানা ছয় মাস কোনো ব্যাংকের সিআরএআর সাড়ে ১২ শতাংশ ও প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৫-৮ শতাংশের মধ্যে থাকে, সেটি ক্যাটাগরি-১-এ পড়বে। এই শ্রেণির ব্যাংক তার শেয়ারধারীদের কোনো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারবে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে বোনাস শেয়ার বণ্টন করতে পারবে। এসব ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ এক বছরে ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। পরিচালন খরচ আগের বছরের চেয়ে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ বাড়ানো যাবে।

টানা ১২ মাস যেসব ব্যাংকের সিআরএআর ৮-১০ শতাংশ এবং খেলাপি ঋণ ৮-১১ শতাংশের মধ্যে থাকে, সেগুলো ক্যাটাগরি-২-এ পড়বে। এই ব্যাংকগুলো কোনো লভ্যাংশ দিতে পারবে না। এই ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় আগের বছরের চেয়ে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বাড়ানো যাবে।

যেসব ব্যাংকের সিআরএআর ৫-৮ শতাংশ এবং খেলাপি ঋণ ১১-১৪ শতাংশের মধ্যে থাকবে, টানা ১৮ মাস সেগুলো ক্যাটাগরি-৩-এ পড়বে। এই শ্রেণির ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে কোনো ধরনের নতুন লেনদেনে জড়াতে পারবে না। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া দেশে বা বিদেশে নতুন শাখা, উপশাখা বা সহায়ক সংস্থাও খুলতে পারবে না। 

টানা ২৪ মাস যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ শতাংশের ওপরে থাকবে ও সিআরএআর ৫ শতাংশের নিচে নামবে, সেগুলো সবচেয়ে খারাপ ধাপ বা ক্যাটাগরি-৪ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এসব ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ৩৬ ধরনের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কঠোরতার প্রথমেই বলা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে বোর্ডকে অপসারণ করা হবে। পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ, দৈনন্দিন খরচের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। নির্বাহী কর্মকর্তাদের বেতন ও বোনাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন শাখা, উপশাখা ও সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান চালু করা যাবে না। ব্যাংক সব ধরনের কর্মকা-ের ওপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে এখন বড় সমস্যা সুশাসনের অভাব। সুশাসনের ঘাটতি মেটাতে পারলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকার, গ্রাহক ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারল্য সংকট, ঋণের গুণগত মান, খেলাপি ঋণ, পরিচালকদের বেপরোয়া ঋণগ্রহণ এসব সমস্যা সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে কমে যেতে বাধ্য।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান সমস্যার মূলে রয়েছে খেলাপি ঋণ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। খেলাপি কারণে ব্যাংকের টাকা যাচ্ছে। আবার খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন করতে গিয়ে আয় কমে যাচ্ছে। আয় কমে যাওয়ায় মূলধন বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ায় ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অনুসারে মুলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। খেলাপি ঋণের জন্য এককভাবে ব্যাংক দায়ী নয়। অনেক প্রভাবশালী গ্রাহক রয়েছেন তারা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। 

একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নতুন ফ্রেমওয়ার্ক করে খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলছেন । কিন্তু আমরা বহু আগে থেকে চেষ্টা করছি খেলাপি ঋণ কমানোর। আদায়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায় করতে রাষ্ট্রীয় এবং আইনগত যে সহযোগিতা সেটি পেতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে আইনের ফাঁদে আটকে দিচ্ছে খেলাপিরা। এখন সেই প্রভাবশালীদের অর্থ ফেরত না দেওয়ার শাস্তি ব্যাংকগুলোর ঘাড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে পরিচালকদের, ম্যানেজমেন্টকে বহিষ্কার করতে পারবেন, জেলে পাঠাতে পারবেন। কিন্তু খেলাপিরা যেন ঋণ ফেরত দেয় সেই উদ্যোগ কে নেবে?

ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ সরকারি ব্যাংকগুলোর। সরকারি খাতের ৮টি ব্যাংকের মধ্যে প্রতিটির খেলাপি ঋণের হার ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই খেলাপি ঋণের জন্য বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ, ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। ঐতিহ্যগতভাবে প্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য আগে থেকেই যথেষ্ট আইনি কাঠামো বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ হয় না। আগের আইন বাস্তবায়ন করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে কয়েকটি ব্যাংক দখল করে অন্য একটি গ্রুপের হাতে তুলে দিয়েছে স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। ওই সব ব্যাংকে বছরের পর বছর কোনো ধরনের আইন মানা হচ্ছে না। কিন্তু সেখানে নির্বিকার রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //