বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৮৮০ কোটি টাকা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতার প্রভাবে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কিছুটা কমে এসেছে। তবে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি কমেনি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানির ক্ষেত্রে নানা শর্ত ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও তা অনেক বেশি স্ফীত হয়েছে। 

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বিওপির ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার তা এ বছরের এপ্রিল শেষে ছাড়িয়েছে ৮৮০ কোটি বা ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এদিকে দিন যত যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও ততই ক্ষয় হচ্ছে। ৭ জুন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২২ সালের একই দিন রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। 

আমদানি দায়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য অব্যাহতভাবে রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়তে হয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোর আমদানির ঋণপত্র (এলসি) দায় পরিশোধ স্বাভাবিক হয়নি। জ্বালানি তেল ও সারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের এলসি দায়ও পরিশোধ করা যাচ্ছে না যথাসময়ে। 

এদিকে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে বাকিতে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার সতর্কবার্তা দিয়েছে। এর আগে কয়লার বিল বকেয়া পড়ার কারণে প্রায় এক মাসের মতো বন্ধ ছিল রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। একই কারণে চলতি মাসে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে কেবল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই বকেয়ার পরিমাণ ২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানির পরিমাণ কমেছে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল মেয়াদে দেশের মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৬৮ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ৫৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। সে হিসাবে আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশের রফতানি আয়ে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ কারণে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি বেশ কমে এসেছে। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ ঘাটতির পরিমাণ কমেছে ১১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। 

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মতে, দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক ভারসাম্য ফিরতে অনেক সময় লাগবে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু আমদানি কমিয়ে অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফেরানো সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ানো সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে রেমিট্যান্স প্রবাহে যে পতন দেখা যাচ্ছে, সেটি অস্বাভাবিক। ডলারের দর নিয়ে চাপাচাপি ও অস্পষ্টতার কারণে হুন্ডি তৎপরতা উৎসাহিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স দেশের রেটিং কমিয়ে দেয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যের সংকট আরো বাড়বে। পাশাপাশি স্বল্প সুদে ঋণপ্রাপ্তির উৎসগুলোও সংকুচিত হয়ে আসবে।’

বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরজুড়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পার করেছে বাংলাদেশ। রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতিতে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের বিওপির ঘাটতিও ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এলসির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সংকটের পাশাপাশি এলসি খোলার শর্ত কঠোর করায় আমদানির পরিমাণ ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ কমে এসেছে।

অর্থবছরের শুরুতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে যে উচ্চপ্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছিল, সেটি ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল মেয়াদে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। আর রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। সর্বশেষ মে মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার উৎসগুলো সংকুচিত হয়ে আসায় দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে উদ্বৃত্ত ছিল ১১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এ হিসাবে ২১৬ কোটি ডলার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। 

বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটের মধ্যেই গত মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়ে দিয়েছে মুডি’স। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে। এর পর থেকে বিদেশী ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা স্থগিত কিংবা কমিয়ে দিতে শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //