২০০ বছরের পুরনো মহুয়া

দশ বছরের বেশি বাঁচে না কোনো চারা

মহুয়া গাছ বাংলাদেশে একেবারে বিলুপ্তপ্রায় না হলেও খুব কমই এর দেখা মেলে। তবে শতাব্দীপ্রাচীন বা তারও অধিক বয়সী মহুয়ার খোঁজ পাওয়া যায় কেবল চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মিঠানালা গ্রামে।

সঠিক বয়স নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও স্থানীয় কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, প্রায় দুশ বছর আগে মিঠানালা গ্রামে নন্দ কুমার রক্ষিত নামে এক ব্যবসায়ী বাস করতেন। ব্যবসায়ের পাশাপাশি এই অঞ্চলের জমিদারও ছিলেন তিনি। তৎকালীন বার্মা অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমারে বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত ছিল তার, সেখান থেকে শখের বশে এই মহুয়াগাছটি এনে নিজ গ্রামের পুকুরপাড়ে রোপণ করেন। দেশভাগ-পরবর্তীকালে নন্দ কুমার রক্ষিতের বংশধররা দেশত্যাগ করার ফলে এই গল্প সম্পর্কে বিশদভাবে আর কিছু জানা যায় না। গাছটিকে ঘিরে বহু কিংবদন্তির প্রচলন রয়েছে। 

বলা হয়ে থাকে এ গাছে এক দিনে ফুল আসে এবং দিনেই তা ফলে রূপান্তর হয়ে পেকে যায়। সেই ফল মানত করে খেলে মনোবাসনাপূর্ণ হয়! তবে স্থানীয় প্রবীণ আনোয়ার হোসেন বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত বলে মত দিলেন। তিনি জানালেন, ফাল্গুনের শেষে এ গাছে ফুল আসে, চৈত্র মাস জুড়ে গাছে সে ফুল থাকে। বৈশাখের শুরুতে ফল ধরতে শুরু করে এবং মাসের শেষ দিকে পেকে যায়। এ ফল প্রচণ্ড মিষ্টি হয়। ফলটির আকার ও রঙ অনেকটা জলপাইয়ের মতো, ওপরে পুরু চামড়ায় মোড়ানো এবং ভেতরে থাকে লম্বাটে একটি বীজ। পুরু চামড়ার সঙ্গে শাঁস লেগে থাকে, চামড়া বাদ দিয়ে শাঁসটি খেতে হয়। এ ফল এতটাই মিষ্টি যে ৪-৫টির বেশি খাওয়া যায় না। 

আনোয়ার হোসেন আরও জানালেন, গাছটিকে মহুয়া এবং মধুকা বলে ডাকা হয়। আর আমাদের স্থানীয় ভাষায় ‘হানজ ফলগাছ’ নামে ডাকা হয়। এখন গাছের কাণ্ডে ফুল এসেছে, এরপর ওপরের কাণ্ডে এমন ফুল আবার এসে ফল ধরবে। গাছটি বিরল হলেও দেশের বেশ কিছু জায়গায় দেখেছি। যেমন ঢাকা চিড়িয়াখানা ও রমনা পার্কে এ গাছ দেখেছি। তবে এটি যে প্রাচীন গাছ এবং দুইশ বছরেরও বেশি বয়স তা অনেকটা নিশ্চিত। আমার দাদা ১০০ বছর বয়সে মারা গেছেন, তিনি তার শৈশবে বর্তমান অবস্থায় গাছটিকে দেখেছেন। আমিও এভাবেই গাছটিকে দেখে আসছি শৈশব থেকে। ২০০০ সালে রাশিয়া থেকে একদল গবেষক এসেছিল, তারা প্রায় এক সপ্তাহ গ্রামে অবস্থান করেছিলেন। এখনো বছরের বিভিন্ন সময় নানা দেশ থেকে পর্যটক, গবেষক আসেন, তারা তাদের মতো কাজ করেন আবার চলেও যান। 

কলমপদ্ধতিতে এই মহুয়া গাছটির কোনো চারা হয় না। এমনকি বীজ থেকে চারা হলেও দুয়েক বছর, খুব বেশি হলে ১০ কি ১২ বছর পর গাছগুলো মারা যায়। এ গ্রামের অনেকেই বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেছেন গাছ বড় করতে, অবাক করা বিষয় হলো, তাদের কেউই সফল হতে পারেননি। এক পর্যায়ে সবাই এ চেষ্টা বাদ দিয়েছেন। তাদেরই একজন আশি বছর বয়সী মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। ২০০৫ সালে তিনি একটি চারা তৈরি করে রোপণ করেন। কিন্তু অনেক পরিচর্যা করেও গাছটি তিনি বাঁচাতে পারেননি। খোরশেদ আলম খানিকটা আক্ষেপের সুরে বললেন, বৃষ্টির পানি জমে গাছের গোড়া নষ্ট করে ফেলবে, এই ভয়ে গছের শেকড় ঘরের ভেতর দিয়েছিলাম, তার পরও মারা গেল। 

পার্শ্ববর্তী দুর্গাপুর গ্রামের অধিবাসী ড. নিজাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে পড়াশোনা শেষ করে ডাক বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। মিঠানালার এ মহুয়া গাছটিকে দীর্ঘদিন ধরে দেখছেন তিনি। ড. নিজাম বললেন, এ গাছটিকে একটা সময় পর্যন্ত মহুয়া হিসেবে চিহ্নিত করতে আমি সন্দিহান ছিলাম। কারণ এই গাছের ফুল ও ফল মহুয়া গাছের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের একাধিক গবেষক থেকে জানতে পারি যে, এটি মহুয়া গাছেরই আরেকটি জাত। এ গাছটির বয়স নির্ণয় সম্ভব হয়নি, কারণ বয়স নির্ণয় করতে গেলে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে তাতে এ গাছটি মারাও যেতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কর্মরত আমার একজন বন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছি, তারা যাতে গাছটি নিয়ে বিশদ গবেষণা করেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //