শহীদ বুদ্ধিজীবী ও রাজাকারের তালিকা কতদূর

বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করতে পারেনি কোনো সরকার। অথচ বিজয়ের পথে পথে মিশে আছে তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। 

অন্যদিকে  বর্তমান সরকারের আমলে রাজাকারের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তালিকায় কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে আসায় এটি নিয়ে চরম বিতর্ক হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে এ তালিকা প্রত্যাহার করা হয়। এরপর একটি নীতিমালার ভিত্তিতে রাজাকারের নির্ভুল তালিকার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংসদীয় উপ-কমিটি করা হয়। সেটিও আর হালে পানি পায়নি। পরে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ সংশোধনের মাধ্যমে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তালিকা আর করা যায়নি। এরই মধ্যে সরকারের মেয়াদও শেষ হয়েছে। চলছে নির্বাচনকালীন সরকার। তাই রাজাকারের তালিকা আপাতত আর হচ্ছে না বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

শহীদ বৃদ্ধিজীবীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা কতদূর?

২০২০ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই বছরের ২৫ মার্চ প্রথম দফায় তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু এতদিনেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে না পারায় বিভিন্ন সময়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানেরা।

এর আগে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রথম সভায় প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রথম তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথম দফার তালিকায় স্থান পায় ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম। যদিও চলতি বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা পূর্ণাঙ্গ করার আশাবাদের কথা জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। কিন্তু প্রাথমিক তালিকা প্রকাশের আড়াই বছর পার হলেও এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমার কাছে এ মুহূর্তে কোনো আপডেট নেই। আমরা এটি নিয়ে বসব, পরে আপডেট জানাতে পারব।’

গত ১১ ডিসেম্বর এ বিষয়ে বৈঠকে বসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ১৩ ডিসেম্বর আরেকটি বৈঠক হবে। সেই বৈঠকের পর এ বিষয়ে অগ্রগতি জানা যাবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তখনকার সচিব তপন কান্তি ঘোষকে এ কমিটির সভাপতি করা হয়। মন্ত্রণালয়ের তখনকার অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল হক ভূঞাকে কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়। উপসচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত কমিটিতে সদস্য-সচিব হন। কিন্তু ২০২১ সালের ৩০ মে তপন কান্তি ঘোষকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। অন্য কর্মকর্তারাও বদলি হন।

কমিটিতে গবেষক সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ।       

বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির (বীর প্রতীক)।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এ বিষয়ে অগ্রগতি আমার জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করা মুশকিল, তারা কোনো একটি বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। কর্মকর্তারা বদলি হয়ে যান, কাজ এগোয় না।’

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানাসহ মতামতের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে। কমিটিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদদের মধ্যে কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন সেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেও বলা হয়। বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ, পত্রিকা কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে। একই সঙ্গে কমিটিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থা/জেলা/উপজেলা ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত ব্যক্তি/ব্যক্তিদের আবেদন যাচাই-বাছাই ও শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করতে বলা হয়।

কমিটি নির্ধারিত শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যে সকল সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক সঙ্গীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

পরে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কমিটির প্রথম সভায় প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ১৯৭২ সালে এক হাজার ৭০ জন শহীদের তালিকা, পরবর্তী সময়ে ডাক বিভাগ ১৫২ জন শহীদের ডাকটিকিট প্রকাশ করে সেই তালিকাও অনুমোদন দেওয়া হয় ওই সভায়।

রাজাকারের তালিকা আপাতত হচ্ছে না

রাজাকারের তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা আপাতত হচ্ছে না। কী প্রক্রিয়ায় তালিকা হবে, সেটি এখনো ঠিক করা যায়নি। এটি যেনতেনভাবে করাও যাবে না। কারণ কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসলে আমরা যেন আমাদের অবস্থানে ঠিক থাকতে পারি।’ তিনি বলেন, সরকারের এই মেয়াদে আর হচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে যদি ক্ষমতায় আসি তখন হয়তো দেখা যাবে।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ঘোষিত তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুসহ রাজশাহীর আরও দুই ব্যক্তির নাম রয়েছে ওই তালিকায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা শুরু হয়।

বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকা স্থগিত করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট থেকে তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

এ দিকে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চলে আসায় তখন দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘এ তালিকা আমরা প্রণয়ন করিনি, প্রকাশ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা যা পেয়েছি তাই হুবহু প্রকাশ করেছি’।

পরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের তালিকা করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর মন্ত্রিসভা বৈঠকের অনুমোদন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর গত ৭ সেপ্টেম্বর নতুন ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’-এর গেজেট জারি করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, রাজাকারের তালিকা করতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় উপ-কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোরাম পূর্ণ না হওয়ায় তারা মিটিংয়েই বসতে পারছিলেন না। শেষে চলতি বছরের এপ্রিলে নতুন সংসদীয় সাব-কমিটি গঠন করা হয়। আগের মতো নতুন সাব কমিটিতেও শাজাহান খান আহ্বায়ক হন। এর অন্য দুই সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //