কৃষিতে শিল্পায়ন কতদূর

এক বছরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা সেতুর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কৃষকরা এখন উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ঢাকায় এনে বিক্রি করছেন। এতে বাজারজাত যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি কৃষক পাচ্ছেন ন্যায্যমূল্য। কিন্তু পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি বিষয়ক শিল্প গড়ার স্বপ্ন এখনো অধরা। উদ্যোক্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুতে যোগাযোগ সহজ হলেও শিল্প কারখানা তৈরির মতো সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। বিদ্যুতের লোডশেডিং, নাজুক অভ্যন্তরীণ সড়ক, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ও সংরক্ষণাগার না থাকা, প্রণোদনার অভাবসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় আটকে আছে শিল্পায়নের স্বপ্ন। 

শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, সারা দেশেই একই অবস্থা। কৃষিতে বছর বছর উৎপাদন বেড়েছে; বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মাছ, ফল, সবজি ও বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটলেও কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। রপ্তানি প্রক্রিয়া, বাণিজ্যিকীকরণ ও বহুমুখীকরণও জোর পাচ্ছে না। নেই পর্যাপ্ত প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ। সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ নষ্টও হচ্ছে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছেন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছর বছর কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়লেও সমন্বয়হীনতায় এ কার্যক্রমে গতি আসছে না। 

কৃষির শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে জোর দেওয়া, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তার মধ্যে সমন্বয়, পরিবহনে টোল চার্জ কমানো, সরকারি নজরদারি বাড়ানো, প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং কৃষিপণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের ওপর জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণও কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশফেরত শ্রমিক ও কাজ হারানো মানুষকে কৃষিতে টানা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার যে স্টার্টআপ তহবিল আছে, সেখান থেকে এ নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করা যেতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশে রয়েছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বছরে উৎপাদন হয় এক কোটি ৬০ লাখ টন। সবজি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, মান নিয়ে কড়াকড়ির কারণে ২০১৭ সালের মার্চে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সবজি রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হওয়ায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পান রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইইউ। অবশ্য গত ২৬ মে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ইউরোপে পুনরায় পান রপ্তানি শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘পান নিয়ে আমাদের একটা সমস্যা ছিল, সেটা কাটিয়ে এখন ইইউয়ের বিভিন্ন দেশে আমরা রপ্তানি করতে পারছি। কিন্তু যুক্তরাজ্যে এখনো পান রপ্তানির অনুমতি পাওয়া যায়নি। অথচ যুক্তরাজ্যেই এই পণ্যের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ রপ্তানি হয়। শুধু পান নয়, বেশিরভাগ সবজির রপ্তানি গন্তব্যই যুক্তরাজ্য।’

গুণগত মানের পণ্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ লাইনে ঘাটতিসহ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষমতা না থাকায় রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে কৃষিপণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের অর্থবছর থেকে রপ্তানি আয় কম হয়েছে ২৭.৪৭ শতাংশ। এ সময় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩৯ কোটি ৪১ লাখ ডলার, আয় হয়েছে মাত্র ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৯.৫৩ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের আয় ছিল ১১৬ কোটি ডলার। তবে এদিকে চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) আগের অর্থবছর থেকে ৩৩ শতাংশ কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৩.৪৫ কোটি ডলার।

আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। ৫০ বছরে আলু উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১১ গুণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে গত অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ২ লাখ টন। কিন্তু রপ্তানিযোগ্য আলুর অভাব, পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার না থাকা এবং প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা না থাকায় আলুর দাম পাচ্ছেন না কৃষক। আলু বিক্রি করতে না পেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পচে নষ্টও হচ্ছে। সরকারের পরামর্শে এবার কৃষকরা প্রচুর ব্রোকলি উৎপাদন করেও দাম না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে তা গরুকে খাওয়ানো হয়েছে। ফল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০-১১ শতাংশ হারে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় ও আমে সপ্তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। তবে এ অর্জনের উল্লেখযোগ্য অংশই বিফলে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশে এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৪ লাখ ৫০ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আম উৎপাদিত হয় ১২ লাখ ২২ হাজার টন। বিএফভিএপিইএ জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩১ টন আম রপ্তানি হয়। পরের বছর বেড়ে ৩০৮ টনে দাঁড়ায়। গতবার করোনা ভাইরাসের কারণে আম রপ্তানি হয় ২৭৮ টন। চলতি বছর ৯০০ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রপ্তানিকারকদের। অথচ পাকিস্তানে মাত্র ৮ লাখ টন আম উৎপাদন হলেও তারা মধ্যপ্রাচ্যে এক লাখ টন আম রপ্তানি করে। এদেশে আম চাষের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও এ খাতটি শিল্প হিসেবে দাঁড়ায়নি। আমের বহুমাত্রিক বাণিজ্যিকীকরণেও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। অথচ পাশের দেশ ভারতে আমের মৌসুমে জুসসহ বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। অধিক উৎপাদনের ফলে রাজধানীর ফুটপাতে মাত্র ২০০ টাকা কেজিতেও ড্রাগন ফল বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টিগুণ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ বলেন, বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ফলের চাষ হওয়া এলাকাতে অত্যাধুনিক ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ভিএইচটিপি) বাস্তবায়নে পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। এ প্ল্যান্টের আওতায় নিরাপদ পদ্ধতিতে যে কোনো ফল সংগ্রহ ও গ্রেডিং করে আয়োডাইজড পানিতে ধোয়া হবে। তারপর নির্দিষ্ট ফলের জন্য উপযুক্ত ও সহনীয় তাপমাত্রায় বাষ্পীয় প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে প্যাকেটজাত করে রাখা হবে কুলিং সিস্টেমে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ফলের রপ্তানি বাড়াতে চলতি মাসে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। রপ্তানির জন্য উৎপাদিত শস্যের গুণগত মানের অভাব, নিরাপদ শস্য উৎপাদনের অভাব, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার, চুক্তিভিত্তিক কৃষক না থাকা, অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি না থাকা, তদারকি ও মান সনদের দুষ্প্রাপ্যতা, রপ্তানির জন্য বিশেষ অঞ্চল না থাকাসহ ২০ ধরনের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে তারা।

ঢাকার শ্যামপুরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশে ফাইটোস্যানিটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’-এর অধীনে এক একরের একটি প্লটের ৬০ শতাংশ জমির ওপর সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউস করা হয়। তবে এটি তেমন কাজে আসছে না বলে অভিযোগ করেন ফল ও সবজি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিএফভিএপিইএর সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ। তিনি বলেন, শ্যামপুর থেকে বিমানবন্দরে যেতে যানজটের কারণে ৫-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ভারত সবজি রপ্তানির জন্য আলাদা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) করেছে। এ দেশে কৃষি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের জন্য বড় জায়গা নির্বাচন করা যায়। কৃষকরা সেখানে চাষ করবেন। ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে কিনে নেবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক প্যাকেজিং হাউস স্থাপনে পূর্বাচলে ২ একর জমি কৃষি মন্ত্রণালয়কে দিয়েছেন। সেখানে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক প্যাকেজিং হাউস এবং অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, জাপানে একটা ফুলকপি কোন কৃষক উৎপাদন করছেন, তাও পণ্যের গায়ে লেখা থাকে। বর্তমানে ভারতেও পল্লী জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষক সমবায়ের উপকারভোগী। বাংলাদেশেও কৃষক-ক্রেতা মিলে এমন সেতুবন্ধ তৈরি করা দরকার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //