সরকারি চাকরির আবেদনে ভ্যাট আরোপ

সরকারি চাকরির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে চাকরিপ্রার্থীদের আবেদন ফির ওপর কমিশন ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করেছে সরকার। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে আবেদন ফি গ্রহণ করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে আবেদন ফির ১০ শতাংশ কমিশন বাবদ এবং কমিশনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এর আগে আবেদন ফির ওপর ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়ার বিধান থাকলেও এর ওপর কোনো ভ্যাট ছিলো না।

নতুন করে এই ভ্যাট আরোপকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ, চাকরিপ্রত্যাশী ও ছাত্রনেতারা। তাদের ভাষ্য, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় চাকরি পাওয়া ‘সোনার হরিণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পড়ালেখা শেষ করে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরি না পেয়ে করুণ জীবন পার করছেন। নতুন করে আবেদনের সঙ্গে এই ভ্যাট আরোপ তাদের জীবনকে অভিশপ্ত করে তুলবে। তাই তারা এই ভ্যাট প্রত্যাহার, কর্মক্ষেত্রের সুযোগ বাড়ানোসহ কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জানান। তারা এও বলেন, সরকারের আয়ের নানা পথ আছে। সরকারি চাকরির আবেদন থেকে ভ্যাট নেওয়া অমানবিক।

গত ২৪ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ চাকরির আবেদন মাসুলের সঙ্গে ভ্যাটের হার বসিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ফলে একই বিষয়ে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনটি বাতিল হয়ে গেছে। সংশোধিত

বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, টেলিটকের মাধ্যমে আবেদন ফি ২০০ টাকা প্রদেয় হলে, চাকরিপ্রার্থীকে ১০ শতাংশ কমিশন হিসাবে অতিরিক্ত ২০ টাকা এবং কমিশনের ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে আরও ৩ টাকা দিতে হবে। এর অর্থ, চাকরিপ্রার্থীকে ২০০ টাকার আবেদন ফির সঙ্গে অতিরিক্ত ২৩ টাকা দিতে হবে।

তবে বিভিন্ন গ্রেডে সরকারি চাকরির আবেদন ফি অপরিবর্তিত রয়েছে। এগুলো হলো- ৯ম গ্রেড এবং তদূর্ধ্ব (নন-ক্যাডার) ৬০০ টাকা, ১০ম গ্রেড ৫০০ টাকা, ১১তম ও ১২তম গ্রেড ৩০০ টাকা, ১৩তম থেকে ১৬তম গ্রেড ২০০ টাকা এবং ১৭তম থেকে ২০তম গ্রেড ১০০ টাকা।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারের আয়ের অনেক উৎস রয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের সরকারি চাকরির আবেদন থেকে ভ্যাট না নিয়ে মানবিক আচরণ করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, সরকার বিভিন্নভাবে করজাল বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি এড়ানো গেলে ভালো হতো। বেকার বা চাকরিপ্রত্যাশী মানুষদের কর থেকে রেহাই দেওয়া যেত, তারা তো মাসুল দিচ্ছেনই, মূসক না নিলেও চলত।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, সব দেশেই সরকারি চাকরিতে আবেদনের জন্য নামমাত্র ফি নেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশে চাকরির আবেদন ফির পরিমাণ অনেক বেশি। এটি কমানো উচিত। আর চাকরির ফির সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত করা অযৌক্তিক। কারণ চাকরিতে যারা আবেদন করেন তাদের সবাই বেকার। বেকারদের কাছ থেকে সরকারের লাভ করার যুক্তি আসে না।

চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি আন্দোলনের আহ্বায়ক শরিফুল হাসান শুভ জানান, আমরা সবাই জানি সাধারণত আয়ের উৎস থেকে ভ্যাট বসানো হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন বেকার শিক্ষার্থীদের আয়ের উৎস কোথায়? তারা বেকার বিধায় চাকরিতে আবেদন করছে। এক্ষেত্রে তাদের আবেদনের উপর ভ্যাট বসানো হলো! এটা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। আমরা তো বেকার ভাতাও চাচ্ছি না। এরপরও কেন উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা অবিলম্বে এই ভ্যাটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানাই।

চাকরি আবেদনে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন ফির ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায়ের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী ও যুব মৈত্রী। পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠন দুটি এ কথা জানায়। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীল বলেন, প্রতি ঘরে একজন করে চাকরি দেওয়ার অঙ্গীকার করে ২০০৮ সালে যুব সমাজের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে গত চৌদ্দ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-যুব সমাজকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করছে। সরকারি চাকরিতে আবেদন ফি ও ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুব সমাজ রাজপথে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসেব মতে, (চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিক) দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ। এই বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ আর আট লাখ ৩০ হাজার নারী। বেকারত্বের এই হিসাব করা হয় আইএলওর সংজ্ঞা ধরে। আর তা হলো ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি শেষের সাত দিনে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ না পান তাহলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। যদি সর্বনিম্ন এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান তাহলে তাকে আর বেকার বলা হয় না। এ প্রসঙ্গে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. এ কে এস মুরশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, মাসে একদিন কয়েক ঘণ্টা কাজ পেলেই তাকে আর বেকার বলা হয় না। এই পদ্ধতিতে বেকার হিসাব করলে বেকারের সংখ্যা তো কম হবেই। বিবিএস যেভাবে জরিপ করে তাতে তো দেশে এখন বেকার নেই বললেই চলে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিবিএসের জরিপ অনেকটা অনুমাননির্ভর। বাংলাদেশে খাতভিত্তিক কর্মসংস্থানের কোনো শ্রম জরিপ নেই। আমরা করোনার সময় দেখেছি বেকারত্ব বেড়েছে। পরে সেটা কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও ইউক্রেন যুদ্ধ ও মন্দা পরিস্থিতির কারণে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আর এখন যে বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাতে ভবিষ্যতে আরও বেকারত্ব বাড়বে।” 

বিবিএসের ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা তিন কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১ জন। যা মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণের।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিন শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //