ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর হচ্ছে

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন আরও কঠোর করতে চায় সরকার। এ জন্য আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।

‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’-এর সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তি ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটের ৫০ ভাগ স্থানের পরিবর্তে ৯০ ভাগ স্থান জুড়ে ধূমপানে সৃষ্ট ক্ষতি সম্পর্কে, রঙিন ছবি ও লেখা সংবলিত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কবাণী বাংলায় মুদ্রণ করতে হবে। 

এছাড়া ভ্রাম্যমাণ দোকান বা ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করার বিধানও সংশোধিত আইনে রাখা হচ্ছে। সামাজিক কাজের নামে তামাক কোম্পানির তৎপরতা বন্ধের বিধান যুক্ত হচ্ছে সংশোধিত আইনে।

একই সঙ্গে আইন সংশোধন করে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, খাবার দোকান, কফি হাউসের সঙ্গে চায়ের দোকানকেও পাবলিক প্লেসের আওতায় আনা হচ্ছে। পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্টকৃত কোনো এলাকাও বাতিল করা হচ্ছে। পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে সিগারেটের সঙ্গে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারেও আসছে নিষেধাজ্ঞা।

সংশোধিত আইনের খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে উত্থাপনের আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের খসড়াটি পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে মন্ত্রিসভা বিভাগের এ সংক্রান্ত কমিটি।

খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ভ্রাম্যমাণ দোকানে বা ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না। এটি করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করলে জরিমানা দ্বিগুণ হবে।

বর্তমান আইন অনুযায়ী, পাবলিক প্লেস এবং পরিবহনে ধূমপানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই বিধান অমান্য করলে তিনশ টাকা অর্থদণ্ড এবং একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করলে দ্বিগুণ হারে দণ্ডিত হবেন। এটি সংশোধন করে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের সঙ্গে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না এমন বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। খসড়ায় এই বিধান অমান্যের সাজা ৩০০ টাকার পরিবর্তে দুই হাজার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বর্তমান আইনে পাবলিক প্লেস হিসেবে যতগুলো স্থানের উল্লেখ রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে নতুন করে বেশকিছু স্থাপনা ও জায়গাকে পাবলিক প্লেস হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব হয়েছে। এর মধ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভবন, হোটেল, যে কোনো ধরেনের রেস্টেুরেন্ট, খাবার দোকান, কফি হাউস, চায়ের দোকানও রয়েছে।

আগের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল, ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন ও প্ল্যাটফর্ম, বাস টার্নিমাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, হোটেল, যে কোনো ধরেনের রেস্টুরেন্ট, খাবার দোকান, কফি হাউস, চায়ের দোকান এবং উল্লিখিত পাবলিক প্লেসগুলোর প্রাঙ্গণ, কমিউনিটি সেন্টারসহ যে কোনো ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানস্থল, পাবলিক টয়লেট, শিশু পার্ক, মেলা, পাবলিক পরিবহনে আরোহণের উদ্দেশ্যে যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারিসহ সেবাগ্রহণের জন্য মানুষের সারি অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দিয়ে সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোনো বা সকল স্থানকে পাবলিক প্লেস হিসেবে রাখা হয়েছে।

সংশোধিত খসড়ায় পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট ‘ধূমপান এলাকা’ বিলুপ্তির প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ সংক্রান্ত কমিটি বলেছে, ধূমপান এলাকা বিলুপ্তির বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কোনো ব্যক্তি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না। লাইসেন্স ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দণ্ড দ্বিগুণ হবে।

“ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে নিকোটিনযুক্ত বা নিকোটিন ছাড়া ফ্লেভারযুক্ত পদার্থকে উত্তপ্ত করে ধোঁয়া, বাষ্প বা অ্যারোসল তৈরি করে এবং শ্বাসের সঙ্গে মুখে টেনে গ্রহণ করা হয় এমন ইলেকট্রনিক বা ই-সিগারেট, ই-হুঁকা ও এ ধরনের ডিভাইস পাবলিক প্লেসে ব্যবহার করা যাবে না।”

খসড়ায় ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার, হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্টস বা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্টস যে নামেই অভিহিত হোক না কেন এসবের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, কেনাবেচা ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন অমান্য করে এসব করলে তিন মাসের কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে দ্বিগুণ। আর কোনো কোম্পানি এসব অপরাধ করলে ওই কোম্পানির মালামাল জব্দ করে কোম্পানির মালিক, ব্যবস্থাপক বা সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিকে ছয় মাসের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে এবং ওই কোম্পানির তামাক উৎপাদন ও বিক্রির লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম যেমন-ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ব্যবহার করতে পারবেন না। আইন অমান্য করে এসব ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে মিষ্টিদ্রব্য, মসলা, রং, সুগন্ধি, আসক্তিমূলক দ্রব্য বা কোনো মিশ্রণ যুক্ত করা যাবে না। এটি করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। প্রস্তাবিত আইনে আরও বলা হয়, কোনো প্রেক্ষাগৃহ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ইন্টারনেট মাধ্যম, ওয়েবসাইট, ওয়েব পেজ, ইলেকট্রনিক মেইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। এছাড়া ক্রেতার কাছে বিক্রির সময় ছাড়া বিক্রয়স্থলে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য বা এর মোড়ক বা প্যাকেট দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হবে।

সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির নামে কোনো তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। একই সঙ্গে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান বা কর্মসূচিতে আর্থিক বা অন্য কোনো সহায়তা দিতে পারবে না বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাহেদা পারভীন জানান, সংশোধিত ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের খসড়ার ওপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে খসড়াটি চূড়ান্ত করবে।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমান সময়ের আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটিতে সংশোধন আনা হচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। সেটিকে সামনে রেখে আইনটি আরও কঠোর করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি কমিটি সংশোধনগুলো নিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। আমরা সেগুলো দেখছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //