সব ভবনের বীমা বাধ্যতামূলক হচ্ছে

প্রায়ই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। কিন্তু এসব ভবনে বীমা না থাকায় ভবন মালিক বা ক্ষতিগ্রস্তরা কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পান না। ফলে ভবনে আগুনের ঘটনায় কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অথচ এসব ভবন বীমার আওতায় থাকলে তার ক্ষতিপূরণ পেতেন ভবন মালিক বা ক্ষতিগ্রস্তরা।

এছাড়া ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিশাল এলাকা ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ও বেসরকারি ভবন বাধ্যতামূলকভাবে বীমার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বহুতল ভবন বীমার আওতায় আনতে দীর্ঘদিন ধরে বীমা সংশ্লিষ্টরা দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে ২০১৭ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আগুন লাগার পর এ দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। এরপর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগলে এ দাবি আরও জোরদার হয়।

এর আগেও সরকারি বহুতল ভবন বীমার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। এখন নতুন করে আবার এ বিষয়টিতে জোর দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আইডিআরএ ভবন নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়গুলোকে এ বিষয়ে চিঠি দেখার অনুরোধ জানান। এ পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ১৮ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

রাজধানীতে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়ে থাকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক); যা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন। এছাড়া খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (খুউক), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ভবনের অনুমতি দিয়ে থাকে। সিটি করপোরেশন রয়েছে ১২টি এবং পৌরসভা রয়েছে ৩২৯টি। যেসব সিটি বা পৌরসভা এলাকায় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নেই, সেখানে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা সেই অনুমোদন দিয়ে থাকে; যা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ভবনের বীমা নিয়ে এখনো কোনো অ্যানালাইসিসে (বিশ্লেষণ) আমরা যাইনি। এটা বড় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সব দিক বিচার বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কী করা যায় সেজন‌্য ইতোমধ্যে পৌরসভার মেয়র ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও গণপূর্ত সচিবের কাছে লেখা চিঠিতে বলা হয়, দেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ক্রমান্বয়ে বহুতল ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ভবনগুলোর ঝুঁকির আশঙ্কাও বেড়ে যায়। বেশকিছু ভবনে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হতে অগ্নিকাণ্ডের কারণে সম্পদ ও   জান-মালের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডে সম্পদ ও প্রাণহানির আশঙ্কা সব সময়েই হয়ে থাকে। 

ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিশাল এলাকা ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ ধরনের বিশাল ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি মোকাবিলায় বীমা খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

এতে আরও বলা হয়, দেশের সব ভবন/বহুতল ভবনের মালিকরা অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বীমার আওতায় থাকার ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। 

এদিকে সরকারি-বেসরকারি ভবনের বীমা বাধ্যতামূলক হলে বীমা কোম্পানি, সরকার ও ভবন মালিক সবাই লাভবান হবেন বলে মনে করছেন বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবনের বীমা বাধ্যতামূলক করা হলে সাধারণ বীমা খাতের ব্যবসা ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বীমার অবদান বাড়বে। সেই সঙ্গে বড় হবে বীমার বাজার। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং ভবনের ক্ষতি হলে মালিকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন।

বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেন, সরকারি-বেসরকারি ভবনের বীমা বাধ্যতামূলক করা হলে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বড় অঙ্কে বেড়ে যাবে। আমার ধারণা সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। 

এর আগে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি আইডিআরএ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ভবনের ঝুঁকি নিরসনে চলমান বীমা পরিকল্পগুলো হচ্ছে-ফায়ার ইন্স্যুরেন্স, আর্থকোয়াক ইন্স্যুরেন্স, সাইক্লোন ইন্স্যুরেন্স, ফ্লাড ইন্স্যুরেন্স, অল রিস্ক ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি। দেশের সব ভবন বা বহুতল ভবনের মালিকরা অগ্নিকান্ড ও ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বীমার আওতায় থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ-আইসল্যান্ড, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ডের জুরিখের সুইস ক্যান্টন এবং তুরস্কে (পৌরসভার এরিয়ার মধ্যে) আর্থকোয়াক ইন্সুরেন্স বীমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, স্পেন ও চাইনিজ তাইপেও অগ্নি বীমা এবং ভূমিকম্প বীমা পরিকল্প চালু রয়েছে বলেও জানান আইআরডিএ।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত এ বিষয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন রয়েছে, সব প্রোপার্টি বীমার আওতায় আনার জন‌্য। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছিল। তারা সংশ্লিষ্টদের চিঠি পাঠানোর অনুরোধ জানায়। আমাদের বীমা আইনেও স্থাবর সম্পত্তি বীমা করার কথা বলা আছে।

তিনি আরও বলেন, বহুতল ও সাধারণ সব ধরনের ভবন বীমা করার কথাই বলা হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোও কিন্তু প্রকল্প চলাকালে বীমার আওতায় থাকে। এখন প্রিমিসেসের (অঙ্গন) বীমা আছে, বড় কোম্পানিগুলো তা করছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বীমার বিষয়টি দেখবে। কিন্তু যাদের ভবন তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অনুভব করতে হবে যে, আমার ভবনটির বীমা করতে হবে। সেজন‌্যই মূলত চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //