শর্তপূরণের বাজেটে স্বস্তি মিলবে কি

২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট। কিন্তু দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের অস্বস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের স্থবিরতা ও নিম্নগামিতা সামষ্টিক অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে স্বস্তি নেই জনজীবনেও। এবারের বাজেটের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএএমএফ) শর্তপূরণ। শর্তপূরণের নানা কৌশল ও কর্মসূচির ঘোষণা থাকছে বাজেটে। শর্তপূরণের কর্মসূচিগুলো জনজীবনে ও অর্থনীতিতে স্বস্তি আনতে পারবে কিনা এটিই দেখার বিষয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইএমএফের শর্তপূরণের পাশাপাশি অর্থনীতিকে গতিশীল এবং জনজীবনের দ্রব্যমূল্যের বোঝা কমাতে পৃথক কর্মসূচি বাজেটে রাখা উচিত। 

বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফ সাড়ে তিন বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফের চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তব্যে আইএমএফের বেশির ভাগই শর্ত বাস্তবায়ন করার ঘোষণা রয়েছে। 

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে অবশ্যই আইএমএফের পরামর্শগুলোর প্রতিফলন থাকবে। করণীয়গুলোর কিছু কিছু এরই মধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কিছু কিছু বাস্তবায়ন হবে আগামী বাজেটের এক বছরে। কিছু ভর্তুকি কমবে, তবে সব না। যেমন খাদ্য ভর্তুকি বাড়বে। এটা বাড়াতেই হবে।

বাজেটে করকাঠামো ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিশদ বর্ণনা থাকে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের মোটাদাগে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগ স্থবির রয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা, ডলার সংকটে শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে। পাশাপাশি জ্বালানি সংকটেও ভুগছে শিল্পকারখানা। তাতে কমেছে উৎপাদন। ক্রয়াদেশের অভাবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে পণ্য রপ্তানিও দেড় শতাংশ কমছে। অন্যদিকে সুদহার কম থাকার পরও বেসরকারি বিনিয়োগে নেই বড় কোনো সুখবর। দেশে বিনিয়োগ একেবারেই বাড়ছে না, তা নয়। তবে এ ক্ষেত্রে যে গতি দরকার, সেটা নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, এটি গত বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ১০ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। দেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার এখন ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। সাত বছর ধরেই বেসরকারি বিনিয়োগ প্রায় স্থবির হয়ে আছে। আগামী বছরের নতুন বাজেট করা হচ্ছে ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার। বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং বিনিয়োগ বাড়ানোই হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকেই অনেক ধরনের সমস্যা চলছে। যেমন বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয় কিংবা উপযুক্ত জমি পাওয়া যায় না। সরকার এর জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এক দরজায় সেবা (ওএসএস) চালু করেছে। এগুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কোনো উদ্যোগই চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি। এর সঙ্গে ডলার সংকট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি বিষফোড়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে ২৯০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আর গত বছর আসে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। তার মানে গত বছর ৫৫ কোটি ডলারের এফডিআই বেশি এসেছে। তবে মূলধন বা নতুন বিনিয়োগ কমেছে, বেড়েছে পুনর্বিনিয়োগ। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি, বরং গত এক বছরে তিনটি সূচকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত জরিপের তথ্যানুযায়ী, ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পাওয়া জটিল আকার ধারণ করেছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি আগের চেয়ে বেড়েছে। আবার কারখানা বা ব্যবসার জন্য জমি পাওয়াটাও আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে।

এসব বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, বর্তমানে জ্বালানি সংকটে দেশীয় শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহী হচ্ছেন। এ সমস্যা সমাধানে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। 

দেশের করব্যবস্থা নিয়ে মাশরুর রিয়াজ বলেন, কয়েক দফায় কমানোর পরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সার্বিক করের পরিমাণ অনেক বেশি। বাজেটে কর আরও কমানো দরকার। এ ছাড়া ভ্যাটের একাধিক হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি এ ব্যবস্থাকে আরও সহজ করা হলে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

অর্থনীতিতে চলমান সংকটের কারণে উৎপাদন কমেছে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে কমে গেছে। জ্বালানি সংকট ও পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বস্ত্র, তৈরি পোশাক, সিরামিক, ইস্পাতসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পকারখানার উৎপাদন কমেছে। তার মধ্যে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকে নতুন নিয়োগ বন্ধ। কোনো কোনো কারখানা কর্মী ছাঁটাইও করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমেছে। ফলে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ৮৩৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেড় শতাংশ কম। 

এদিকে দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গত মাসে প্রকাশিত জরিপের তথ্যানুযায়ী, বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার পুরুষ এবং ৯ লাখ ৪০ হাজার নারী। 

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। জ্বালানি সংকট ও দাম বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে পণ্যের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আইএমএফের চাপে বিভিন্ন খাত থেকে ভর্তুকি কমানো হবে, কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার করা হবে এবং প্রণোদনাও বাতিল বা কমানো হবে। আবার কর কাঠামো পরিবর্তনের ফলে অনেক পণ্যের বিভিন্ন পর্যায়ে কর, শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করা হবে। এতে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য আরেক দফা বেড়ে যেতে পারে। 

আইএমএফের শর্তে রাজস্ব সুবিধা কমানোয় পাউরুটি, বিস্কুট, সাবান, শ্যাম্পু, প্রক্রিয়াজাত খাবারের দাম বাড়বে। ভ্যাটের হার বাড়ানোয় মিষ্টির দামও বাড়বে। আমদানিকৃত প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে। আগামী অর্থবছরেও চেইন শপ থেকে পণ্য কিনতে হলে ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশের সঙ্গে আরও ৫ শতাংশ বাড়তি দিতে হবে ক্রেতাকে। চাল, ডাল, তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অন্যান্য শর্তপূরণ করতে গেলে এর প্রভাব এসব পণ্যেও পড়তে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //