তিতাসের গাফিলতি ও গ্যাস সরবরাহের দৈন্য ফুটে উঠেছে

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ও ঢাকায় গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার দৈন্যের কারণেই গ্যাস ছড়িয়েছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাইপ লাইনের হাজারো ছিদ্রই এই সংকটের মূল কারণ। ঢাকার অধিকাংশ পাইপলাইন ১৯৭৫ সালে বসানো, এগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এসব পাইপলাইন পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। 

তারা দাবি করেছেন আরেকটি বিকল্প ছিল নিয়মিত ছিদ্র মেরামত করা। সেই কাজটিও যথাযথভাবে করছে না তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। গ্যাসের উপস্থিতি টের পাওয়ার জন্য গ্যাসে ওডোরেন্ট নামে এক ধরনের গন্ধযুক্ত উপাদান মেশানোর কথা। এই উপাদানের কারণে গ্যাস ছড়িয়ে পড়লে গন্ধের কারণে যাতে সহজেই বুঝতে পারা যায়। পাইপলাইনের লিকেজ চিহ্নিত করার জন্য এই কাজটি বাধ্যতামূলক। কিন্তু তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এই কাজটি যথাযথভাবে পালন করছে না। যে কারণে সহজেই আড়ালে থেকে যাচ্ছে গ্যাস লাইনের লিকেজ।

পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, ১৯৯৩ সালে তিনি একবার এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখেছিলেন ওডোরেন্ট মেশানো হচ্ছে না। আবার সাম্প্রতিক সময়ে মগবাজারে বিস্ফোরণের যে ঘটনা ঘটেছে, সেটাও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্যাসে ওডোরেন্ট মেশানো হয়নি। তখন আমি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য ছিলাম। আমাদের টিম ওখানে গিয়েছিল। আমরা গ্যাসের গন্ধ পাইনি। এর অর্থ হচ্ছে ওডোরেন্ট মেশানো হচ্ছিল না। বিষয়টি নিয়ে তিতাসের সঙ্গে দফায় দফায় আমাদের আলোচনা হয়েছে। দেখা গেছে, তখন তিতাস ১৫ দিন ওডোরেন্ট মেশায়নি।

মকবুল-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি আমার বাসাতেও গ্যাসের চুলায় আগুন না দিয়ে চালু করে দেখেছি গন্ধ পাইনি। গ্যাসের গন্ধ পাওয়াটা নিরাপদ। তাহলে মানুষ সচেতন হতে পারে, গ্যাস কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায় না। এটা বিপজ্জনক।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে গন্ধ কিছুটা কমলেও লিকেজ বন্ধ হয়নি। অর্থাৎ ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে বড় ধরনেই ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ব্যাখ্যায় তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন, ওই ব্যাখ্যায় তারা লিকেজ অস্বীকার করে শুধু গ্যাসের চাপ বেশির কথা বলেছে। এতে প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করা হয়েছে। ভালো হয় সংকট স্বীকার করে ব্যবস্থা নিলে।

তিতাস সূত্র আরও বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাইপলাইনের বাস্তব অবস্থা জানতে একটি জরিপ করে তারা। ওই জরিপে তিতাসের ১৩ হাজার ৩২০ কিলোমিটার লাইনের মধ্যে ১ হাজার ৬৮২ কিলোমিটার লাইন বেছে নেওয়া হয়। জরিপে ৯ হাজার ৯২৬টি স্থানে লিকেজ পাওয়া যায়। তিতাস ওই ছিদ্রগুলো বন্ধও করে দেয়। কিন্তু এর বাইরেও ১১ হাজার ৬৩৮ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়ে গেছে, যেগুলোতে কোনো জরিপ করা হয়নি। সেগুলোতে কী পরিমাণ ছিদ্র রয়েছে, তা তিতাসের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

তিতাস কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, পাইপলাইন পরিবর্তন করার বিষয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। সেটি খুব বেশি দূর এগোয়নি। এর প্রধান কারণ এ খাতে যে পরিমাণ আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন তা তিতাসের কাছে ছিল না।

জ্বালানি বিষেজ্ঞদের কাছে প্রশ্ন ছিল ঈদের সময়ে হঠাৎ করে কেনো এই সংকট সামনে এলো। জবাবে বলেছেন, বিতরণ লাইনগুলো ৬০ পিএসআইতে (চাপ বর্গইঞ্চিতে) নকশা করা হয়। কিন্তু ঢাকায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় চাপ ২০ থেকে ২৫ পিএসআইর বেশি থাকে না। তাই ছিদ্র থাকলেও কম পরিমাণে গ্যাস ছড়িয়েছে কারণে বুঝতে পারা যায়নি। ঈদের ছুটিতে শিল্প কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যায়। ফলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। তিতাস কর্তৃপক্ষ ডিস্ট্রিক্ট রেগুলেশন স্টেশন (ডিআরএস) থেকে প্রেশার কমিয়ে দিলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ব্যাখ্যাতেও এটি স্বীকার করা হয়েছে। তারা ছিদ্রের কথা উল্লেখ না করলেও গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। এ জন্য টিবিএস এ সরবরাহ কমিয়ে দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা জানিয়েছে।

ঈদের পরদিন ২৩ এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকার রামপুরা, মালিবাগসহ অনেক এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকার মসজিদের মাইক থেকে সবাইকে আগুন জ্বালাতে নিষেধ করা হয়। সাধারণ মানুষের অনেকে আতঙ্কে রাস্তায় নেমে আসে। ফায়ার সার্ভিস নগরজুড়ে অগ্নিসতর্কতা জারি করে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সমস্যার সমাধানে কাজ চলার কথা জানিয়ে নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

গ্যাস সরবরাহে দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। ঢাকার প্রায় সব এলাকাতে তিতাসের পাইপলাইন জালের মতো ছড়িয়ে আছে। যথাযথ তদারকির অভাবে কোথাও কোথাও এসব পাইপলাইনের ওপর অবকাঠামোও গড়ে উঠছে। তিতাস অনেক ক্ষেত্রেই এ বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। নারায়ণগঞ্জে পাইপলাইনের ওপর মসজিদ গড়ে উঠলেও কেউ খেয়াল না করায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। আবার মগবাজারের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটলেও তাদের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কোনো ঘটনা ঘটলে দায়সারা গোছের বিবৃতি দিয়ে পার পেতে চায়। যে কারণে প্রকৃত ঘটনা থেকে যাচ্ছে আড়ালে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //