কাজ শুরুর আগেই ভাগবাটোয়ারা প্রকল্পের অর্থ

কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা-তিনটি নদ-নদীর ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ঘেরা খুলনার কয়রা উপজেলা। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে প্রতিবছরই প্লাবিত হয় ওই এলাকার হাজার হাজার বসতি। সুন্দরবন লাগোয়া উপকূলীয় এলাকায় এমনিতেই বৃষ্টি বেশি হয়। চারপাশে ফাঁকা জায়গা, নদ-নদীরও অভাব নেই। বঙ্গোপসাগর কাছে থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রাথমিক ধাক্কাটা সহ্য করতে হয় এ অঞ্চলকেই।

লোকালয়ে নোনাজল ঠেকাতে তাই স্থানে স্থানে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য বাঁধ। তবে প্রতিবছর বর্ষা এলেই এসব নদীরক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। কখনো আবার পানির চাপে দাঁড়াতেই পারে না। তখন জোড়াতালি দিয়ে চলে মেরামতি। বেশি দিন তা স্থায়ী হয় না। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ এলে দুর্বল বাঁধ ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মতো। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি।

বাড়িঘর হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয় হাজার হাজার মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ, সংস্কারের নামে লুটপাটের কারণেই বাঁধগুলোর এ পরিণতি। কাজ শুরুর আগেই ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায় প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থ। বাকি টাকায় যে কাজ হয় তার পুরোটাই লোক দেখানো।

খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন জানান, জরুরি কাজের নামে বিগত ১০ বছরে কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকারও বেশি। জোড়াতালিতে বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও রয়েছে অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। এ বছরও তা-ই হচ্ছে। বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। 

দরপত্র ছাড়াই সরকারি সংস্থাটি জরুরি সংস্কারের নামে কাজ দেয় পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। তারা আবার অর্ধেক মূল্যে স্থানীয় সাব-ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।  এভাবে কয়েক হাত ঘুরে প্রকল্পের মূল টাকার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ ব্যয় হয় বাঁধ মেরামতে। এমনকি লাভের আশায় অপ্রয়োজনীয় স্থানেও সংস্কার প্রকল্প নেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরেও বিভিন্ন স্থানে একইভাবে বাঁধ মেরামতের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। 

পাউবোর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনার কয়রা উপজেলার দুটি পোল্ডারে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ১৮টি স্থান নির্ধারণ করা হয়। এগুলো মেরামতের জন্য ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু কোনো দরপত্র ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ১২টি স্থানের কাজ পেয়েছেন যশোরের কেশবপুরের প্রতিষ্ঠান তানিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুল মতিন। বাকিগুলোর মধ্যে চারটি স্থানীয় ঠিকাদার মোজাফ্ফর হোসেন এবং দুটি স্থানের কাজ পান সিরাজউদ্দৌলা লিংকন ও খলিলুর রহমান নামে দুই ঠিকাদার।

সম্প্রতি ওইসব এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চোরামুখা এলাকার বেড়িবাঁধের চার স্থানের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবি, চারটি স্থানে ১ হাজার ২০ মিটার বাঁধে রিং-ডাইক ও অস্থায়ী ঢাল সংরক্ষণের কাজ করা হয়েছে।

এর জন্য বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ১৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। তবে ওই কাজ মাত্র ২০ লাখ টাকায় শেষ হয়েছে বলে জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রমিক সর্দাররা। চারটি স্থানের মধ্যে দুটিতে কোনো মাটির কাজই হয়নি। বালিভর্তি সামান্য কিছু জিও ব্যাগ বাঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

কাজের ঠিকাদার ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মোজাফ্ফর হোসেন এত কম টাকায় কাজ শেষ করার বিষয়ে বলেন, ‘পাউবো সব কাজই তো তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে করিয়েছে। আমি মাত্র চারটির কাজ পেয়েছি, তাও সাব-কন্ট্রাক্টে। সব ঘাপলা তো মূল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পরামর্শেই হয়েছে।’

স্থানীয়রা জানান, কয়েক দিন আগেই এখানে বাঁধ নির্মাণের কাজ হয়। নতুন করে কাজের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। মূলত টাকা লুটপাট করতেই নামসর্বস্ব এ কাজ দেখানো হয়েছে। 

এদিকে বনায়নের গাছ উপড়ে ফেলে কয়রা গ্রামের শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে এক্সকাভেটর দিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কারের অভিযোগ ওঠে। স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে যদিও সে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন ঠিকাদার। জানা যায়, এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য দরপত্র ছাড়াই সরাসরি ক্রয়পদ্ধতির মাধ্যমে বিপ্লব এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দেয় পাউবো।

তাদের হয়ে তত্ত্বাবধানে আছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য হরেন্দ্র নাথ সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজটি মূলত কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতা পেয়েছেন। তার অনুরোধে আমি দেখাশোনা করছি। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবির মুখে আপাতত কাজ বন্ধ আছে।’

খুলনার কয়রা উপজেলার বেড়িবাঁধ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের (পওর) দায়িত্বে রয়েছে সাতক্ষীরার পাউবো-২। ওই কার্যালয়ের কয়রা অঞ্চলটি দেখাশোনা করেন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সুমন শিকদার। তিনি বলেন, ‘আগের অর্থবছরের কাজগুলোয় প্রাক্কলন ও নকশায় ত্রুটি থাকতে পারে। চলমান অর্থবছরের কাজে ওই সমস্যা নেই। এখন যেভাবে নকশা ও প্রাক্কলন তৈরি হবে, তা বরাদ্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হবে।’

সারা দেশের উপকূলীয় বাঁধের চিত্রটা প্রায় কয়রার মতোই। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া নদীসংলগ্ন চাকলা গ্রামের সাদ্দাম হোসেন জানান, দুর্যোগের পর প্রতিবারই টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি ওঠে। প্রতিশ্রুতিও মেলে। কিন্তু এর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে উপকূল রক্ষায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ আর বাস্তবে রূপ পায় না। 

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১ ও ২-এর অধীনে বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ রয়েছে অন্তত ৩০ কিলোমিটার। যদিও এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি ছিল। অনেক এলাকার বাঁধ এরই মধ্যে সংস্কার করা হয়েছে এবং কিছু অংশের কাজ চলমান বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘জেলার ছয়টি উপজেলায় আমাদের অধীনে বেড়িবাঁধ রয়েছে ৩৭৯ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বা আংশিক ঝুঁকিপূর্ণ ২৫ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। কিছু এলাকায় সংস্কারের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে বর্ষার মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কার হয়ে যাবে।’

অন্যদিকে সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার জানান, তার কার্যালয়ের অধীনে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এর মধ্যে কয়েকটি পোল্ডারে প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কারকাজ চলছে।

উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার আইলাদুর্গত গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাকসুদুল আলম জানান, নদীবেষ্টিত তার ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া, দাতনেখালী, পার্শ্বেমারী, জেলেখালী ও গাবুরা এলাকায় খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ দীর্ঘদিন ধরেই মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় জনপদের মানুষের জানমাল রক্ষা করতে হলে নির্মাণ করতে হবে টেকসই বেড়িবাঁধ। 

বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাতে উঠে আসে স্থানীয় জনগণকে উপেক্ষা করে প্রভাবশালীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি; যেখানে প্রভাব খাটান মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, ক্ষমতাসীন দলের নেতা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা।

সবার সঙ্গেই ‘সুসম্পর্ক’ পাউবো কর্মকর্তাদের। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাঁধ নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এতে সাধারণ জনগণের ক্ষতি প্রশমনের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যটাই বেশি থাকে। এসব কাজে জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা বাড়বে। ঘন ঘন নিম্নচাপ আর জোয়ার-ভাটার খেলায় উপকূলে চলবে নোনাপানির আগ্রাসন। এ থেকে মুক্তির জন্য উঁচু ও মজবুত বাঁধই একমাত্র ভরসা।

উপকূল কিংবা নদীরক্ষা বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে দীর্ঘ ও কঠিন পথ। এর প্রস্তুতিও নিতে হবে ভেবেচিন্তে, সময় নিয়ে।

তাছাড়া বাঁধে সামাজিক বনায়ন করা হলে কিংবা ঘরবাড়ি তুললে সেটি অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে। কেননা নিজেদের স্বার্থেই এলাকাবাসী বেড়িবাঁধকে সুরক্ষিত রাখতে উদ্যোগী হয়। তাই যত বড় অঙ্কের অর্থই বরাদ্দ হোক সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া কাজ করলে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বরাদ্দ পাওয়া অর্থ সবই জলে যাবে।’


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //