সেন্টমার্টিনে চলছে অবাধ দখলদারি

বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে মাথা ভেসে থাকা এক দ্বীপের নাম সেন্ট মার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা বা দারুচিনির দ্বীপ। দেশের পূর্বের ইউনিয়ন এটি। স্থলভূমি থেকে নদী পাড়ি দিয়ে ৩৪ কিলোমিটার দূরে সাগরের মাঝে মাটি ও প্রাণের অস্তিত্বের সৌন্দর্য সহজেই অনুমেয়। তাই নীলজলের সৌন্দর্যের কারণে বহু আগে থেকেই সেন্টমার্টিন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।

কিন্তু পর্যটন আকর্ষণে কোনো কিছুই করা হয়নি এই দ্বীপে। উল্টো এখন এই দ্বীপের জমি দখল করে ব্যক্তিগত বাংলোবাড়ি বা অবৈধ রিসোর্ট করার মচ্ছব পড়েছে। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটির পুরো অংশজুড়েই সাক্ষী হয়ে আছে দখলদারিত্বের সাইনবোর্ড। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন আকর্ষণে যেভাবে দ্বীপটি সাজানো প্রয়োজন ছিল সেটি করা হয়নি। উল্টো দ্বীপের সৌন্দর্য নষ্টে চলছে দখলদারিত্ব। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশও। 

দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।

জরিপে দ্বীপটির নামকরণ করা হয় সাধু মার্টিনের নামানুসারে। শুরুতে এই দ্বীপকে প্রবাল দ্বীপ বলা হলেও এটি আসলে সাগরে ডুবে থাকা একটি পাহাড়ের চূড়া ও গায়ের উপর লেগে থাকা প্রবালের সঙ্গে বালি ও পলি জমে গড়ে ওঠা দ্বীপ। এখন এটিকে বলা হয় কোরাল অ্যাসোসিয়েটেড রকি আইল্যান্ড। 

পর্যটন মৌসুমে (অক্টোবর-মার্চ) প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার পর্যটক যান সেন্টমার্টিনে। টেকনাফের জাহাজঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের জেটিঘাট পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৪২ কিলোমিটার। 

এই দূরত্বের ২৫ কিলোমিটার নাফনদী এবং ১৭ কিলোমিটার খোলা সাগর। টেকনাফের জাহাজঘাট থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে নামতে হয় সেন্টমার্টিনে পূর্ব পাশে জেটি ঘাটে। ঘাট থেকে নেমে শুরুতেই বাজার এবং স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ও রিসোর্টগুলো চোখে পড়ে। পশ্চিম বরাবর হেঁটে গেলে দ্বীপের মধ্যবর্তী অঞ্চল পার হলে বসতি কিছুটা কমে আসে। খালি জায়গা পড়ে আছে।

সিমেন্টের তৈরি পিলার দিয়ে জমিগুলোর সীমানা চিহ্নিত করা রয়েছে। প্রায় প্রতিটি জমিতে লাগানো আছে সাইনবোর্ড। নাম ঠিকানাও দেওয়া আছে। প্রায় প্রতিটি সাইনবোর্ডের ভাষা একই রকম। ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক হয় কোনো সেনাকর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক, অ্যাডভোকেট, সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার।

রাজধানী ঢাকার প্রভাবশালীরা কীভাবে সেন্টমার্টিনে এত জমির মালিক হলো এমন প্রশ্নের জবাবে অটোচালক রায়হান জানান, সেন্টমার্টিনে জমির দাম টেকনাফের তুলনায়ও কয়েকগুণ বেশি। এখন যেসব জমি কেনাবেচা হয় তাতে স্থানীয়রা সুযোগ পাননা। কেননা বাইরের মানুষেরা এত বেশি দাম দিয়ে জমি কেনেন, যা স্থানীয়দের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখানে যে রিসোর্ট বা বাজার গড়ে উঠেছে তার মালিকও বাইরের মানুষেরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে যে অবৈধ হোটেল-রিসোর্ট আছে, গড়ে উঠছে, এটা প্রশাসনের কারও অজানা নয়। তারা এগুলো হতে দেয়, কারণ এর অবৈধ সুবিধাভোগী তারা। মাঝেমধ্যে যে অভিযান চলে, সেগুলো মূলত লোকদেখানো। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনকে রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। সেটা দেখা যাচ্ছে না।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহুতল ও একতলা মিলিয়ে সেখানে হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা ২৩০টির বেশি। এর মধ্যে গত দুই বছরে তৈরি হয়েছে অন্তত ১৩০টি। এখন নির্মাণকাজ চলছে ৩০টির বেশি রিসোর্ট ও কটেজের। পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, একটি পর্যটন স্থাপনা নির্মাণেও তাদের ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি।

অনুমোদনবিহীন এসব স্থাপনা পুরো সেন্টমার্টিনের পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. কাউসার আহাম্মদ, ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক মো. ইউসুফ গাজী ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তাহরিমা জান্নাতের এক গবেষণায় উঠে আসে, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছরে সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমেছে।

বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সাড়ে চার বর্গকিলোমিটার থেকে কমে নেমেছে তিন বর্গকিলোমিটারে। আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে। 

দখলের মচ্ছব চললেও পর্যটকবান্ধব কোনো কিছুই করা হয়নি এই দ্বীপে। আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রে সময় কাটানোর জন্য গেমস জোন, গ্যালারি, সিনেমা হল, ক্লাব কিছুই গড়ে ওঠেনি এই দ্বীপে। সময় কাটানোর মতো পর্যাপ্ত সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে এই দ্বীপ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব। 

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক (উপসচিব) রাহনুমা সালাম খান বলেন, পাথর ও সমুদ্র দেখতেই পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে আসে। কারণ এখানকার প্রধান আকর্ষণ পাথর, সঙ্গে সমুদ্র ভ্রমণ। সব জিনিসের দাম বেশি হলেও তারা আসে এখানে। অথচ এখানকার পরিবেশ খুবই নোংরা। এমন জায়গা নেই যে চিপসের প্যাকেট পড়ে নেই। অথচ পর্যটকদের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে চমৎকার পরিবেশ ও উন্নত সেবা।

তিনি বলেন, এই দ্বীপে গেমস জোন, থিয়েটার ও ক্লাব কিছুই গড়ে ওঠেনি। সেন্টমার্টিনে ঘোরার পর সময় কাটাতে পর্যটকদের রিলাক্স দরকার। এসবের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সহযোগিতা দরকার। সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। খুব শিগগির বড় পরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে। পর্যটন খাতকে শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব করার জন্য সরকার নীতিগত সহায়তা দেবে। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য শাহপরীর দ্বীপসহ সারা দেশের জন্য ১০টি ডিপিপি করা হয়েছে। যাতে পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করতে পারেন।

যত্রতত্র স্থাপনা, দখলদারিত্বের হাত থেকে সেন্টমার্টিনকে বাঁচানোর তাগিদ স্থানীয়দের। তাদের দাবি, দখলদারিত্ব যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে স্থানীয়দের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এখানকার জীবনমান উন্নয়নে সরকারেরও কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করাও এখানে কষ্টসাধ্য। 

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মুজিবুর রহমান বলেন, সেন্টমার্টিন অনেক ছোট জায়গা কিন্তু এর সংকট এখন বহুমুখী। স্থানীয়দের উপেক্ষা করে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি করলে তা টেকসই হবে না। স্থানীয়দের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে একটি মাত্র স্কুল আছে। কিন্তু রাস্তাঘাট না থাকার কারণে সেই স্কুলে যাওয়া অনেকের জন্য সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

এজন্য কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্থানীয় মানুষ এবং পর্যটকদের জন্য পানি শোধনাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। আর দ্বীপের চারপাশে ওয়াক ওয়ে নির্মাণ করা জরুরি। এটি হলে দ্বীপ রক্ষা পাবে এবং পর্যটকরা সহজে ভ্রমণ করতে পারবে। কেয়াবন ধ্বংসসহ পরিবেশ বিধ্বংসী যেসব কর্মকাণ্ড হচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করা জরুরি। 

ঘুরতে আসা কয়েকজন পর্যটন এই দ্বীপের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের দাবি, পর্যটকদের কাছে অসম্ভব প্রিয় সেন্টমার্টিনে রয়েছে নানামুখী সংকট। এই দ্বীপটি এখনো পর্যটকবান্ধব হয়ে ওঠেনি। সবকিছুর মূল্য অনেক বেশি। গাড়ি চলাচলের মতো উপযুক্ত রাস্তা নেই। মাত্র ৫-৬ কিলোমিটার যাওয়া আসা করতে ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়া লাগে। সরকার চাইলেই খুব সহজে এসব সংকটের সমাধান করা যায়। 

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল ভূঁইয়া বিপ্লব বলেন, থাইল্যান্ড, ভুটানের চেয়ে এই দ্বীপে আসতে পর্যটকদের খরচ বেশি হয়। ঝামেলারও শেষ নেই। কারণ এটি অপরিকল্পিত দ্বীপ। যে যেখানে পারছে ময়লা ফেলছে।

ট্যুরিজম হতে হবে পরিকল্পিত। সাইবেরীয় পাখি এদেশে আসছে। জাহাজে তাদের খাদ্য দেওয়া হচ্ছে। যা ঠিক না। এই ময়লা সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ময়লা কোরালের উপর পড়ে। খাদ্য তৈরি করতে না পারায় কোরাল মারা যায়। অন্য জায়গায় চলে যায়। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) সচিব মো. খুরশেদ আলম বলেন, গত ৫ দশকের বেশি সময়ে সমুদ্রসীমা জয়ের পর বাংলাদেশের আয়তন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও ২৪ ট্রিলিয়ন ডলারের সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের একার পক্ষে এ সম্পদ আহরণ করা সম্ভব নয়। পর্যটন শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার।

কিন্তু এজন্য স্থানীয় বাসিন্দা, বিনিয়োগকারী, পর্যটক ও বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করতে হবে। তাহলে সমুদ্র সম্পদের সঠিক ব্যবহার সম্ভব হবে এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্পের বিকাশ হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //