দ্বৈত নাগরিকত্ব বৃদ্ধি

অর্থপাচার বাড়াবে না তো?

জাহাজ ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন, জিবি হোসেন নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের পাশাপাশি কানাডারও নাগরিক তিনি। জাহাজ আমদানির কথা বলে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন। দুদকের অভিযোগ, এ ঋণের পুরোটাই তিনি হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন।

দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে এক শুনানিতে হাইকোর্ট প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘এ দেশটা কি হরিলুটের জায়গা? ছলেবলে কৌশলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমরা কি এটা মেনে নিতে পারি? আর উনি (জিবি হোসেন) তো দ্বৈত নাগরিক। এদের হার্ট তো দুই ভাগে বিভক্ত।’ 

কেবল জিবি হোসেনই নন, দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই বিদেশে টাকা পাচার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে শুধু পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমেই বছরে অর্থপাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। তবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে বিনিয়োগেরও সুযোগ রয়েছে। যদিও এ সুযোগ খুব কমই গ্রহণ করেন বাংলাদেশিরা।

এত সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলাদেশিদের জন্য দ্বৈত নাগরিকত্বের পরিসর আরও সম্প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আগে নিজ দেশের পাশাপাশি ৫৭ দেশের নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগ মিলত। সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও ৪৪টি দেশ। সব মিলিয়ে এখন এ সুবিধার আওতায় আসছে ১০১টি দেশ। অর্থাৎ এসব দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা কোনো বাংলাদেশি চাইলে দেশেও নাগরিকত্ব অব্যাহত রাখতে পারবেন। তবে সরকারি চাকরিতে থাকা ব্যক্তিরা এ সুযোগ নিতে পারবেন না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। 

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছে- কোনো বাংলাদেশি যদি বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তাহলে সে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চলমান রাখতে পারবে। কোন কোন দেশের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে, সেটি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর আগে ইউরোপ-আমেরিকাসহ মোট ৫৭টি দেশ ছিল। কানাডা, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো দেশ ছিল।’

মাহবুব হোসেন বলেন, ‘৫৭টি দেশের বাইরে সেই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চলমান রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে আরও ৪৪টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ১০১টি দেশ রাখা হয়েছে, যেটি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে। এসব দেশের নাগরিকরা চাইলে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে পারবেন। তালিকায় নতুন করে যুক্ত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি, আমেরিকা মহাদেশের ১২টি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১২টি এবং ওশেনিয়া মহাদেশের একটি দেশ রয়েছে।’

দ্বৈত নাগরিকত্ব সুবিধায় যুক্ত হওয়া আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি দেশ হলো মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, আলজেরিয়া, সুদান, মরক্কো, ঘানা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, তিউনিসিয়া, সিয়েরা লিয়ন, লিবিয়া, কঙ্গো, লাইবেরিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, ইরিত্রিয়া, গাম্বিয়া, বতসোয়ানা, মরিশাস। আমেরিকা মহাদেশের ১২টি দেশ হলো আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, সুরিনাম, পেরু, ইকুয়েডর, চিলি, উরুগুয়ে, গায়ানা। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ১২টি দেশ হলো কিউবা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, হাইতি, বাহামা, জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, ডমিনিকা, সেন্ট লুসিয়া, বার্বাডোজ, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইন, গ্রেনাডা এবং সেন্ট কিটস ও নেভিস। এছাড়া ওশেনিয়া মহাদেশের একমাত্র দেশ ফিজি।

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক অস্ট্রিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ইমিগ্রান্ট ইনভেস্ট’-এর তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৪৯ শতাংশ দেশ দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন দিয়ে থাকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ক্যারিবিয়া, তুরস্ক, স্পেন অন্যতম। এসব দেশে অভিবাসীরা মূলত উন্নত জীবন, সামাজিক নিরাপত্তা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো বৃহৎ সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে থাকেন।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, দ্বৈত নাগরিকত্বের মাধ্যমে চার ধরনের সুযোগ নিয়ে থাকেন অভিবাসীরা। এগুলো হলো ভ্রমণ, স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও পেশাগত উন্নয়ন এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ উন্নত জীবন।

প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও আফগানিস্তানে অবশ্য দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থাৎ এসব দেশ তাদের নাগরিকদের অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার কোনো সুযোগ রাখেনি। বিশেষত ভারতের মতো দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও নাগরিকত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। কোনো ভারতীয় নাগরিক মার্কিন নাগরিকত্ব নিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। এর পরও ভারতীয় পাসপোর্ট ত্যাগ করেও প্রবাসে খুঁটি গাড়ছে দেশটির ধনী নাগরিকরা।

বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোতে দ্বৈত নাগরিকত্ব পাওয়া সবচেয়ে সহজ। যদিও এর সঙ্গে অর্থপাচারের বিষয়টিরও সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও অর্থায়ন বিশেষজ্ঞদের। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিএডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানায়, দেশে তথ্য গোপন করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। 

দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশেও অবৈধ উপায়ে সম্পদ ও অর্থপাচার করার অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে। লন্ডনসহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় অন্তত অর্ধশত বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারের বাড়ি কেনার সুনির্দিষ্ট তথ্য নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অভিবাসনসংক্রান্ত সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান লন্ডনভিত্তিক অ্যাস্টনস।

ওই প্রতিবেদনে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিভিন্ন এলাকার বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের জাতীয়তাভিত্তিক যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশিদের অবস্থান নবম। এই সময়ের মধ্যে তারা প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন।

বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এছাড়া দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের স্থানান্তরের মাধ্যমে অবৈধভাবে কাজ দেওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি সম্পদ বিক্রি করে অর্থ নিয়ে যাওয়ার মতো অভিযোগও রয়েছে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে বলেই তারা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন তাদের অনেক টাকা রয়েছে, যে কোনো সময় তাদের ওপর চাপ আসতে পারে। তাই তারা নিরাপদ জায়গায় অর্থ রাখতে চান। আর সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়ালেখা করলে নিরাপত্তাহীনতার কারণে অভিভাবকরা তাদের আর দেশে আসতে বলেন না।

তারাও বিদেশে বসবাস শুরু করেন। এতে দেশের ওপর, সুশাসনের ওপর, ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থাহীনতাই প্রকাশ পায়। এটি যে কোনো দেশের জন্যই উদ্বেগের বিষয়।

নাগরিকত্ব, নাগরিত্বের প্রকার, নাগরিকত্বের আইনি বিধি-বিধান, প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘১৯৮৪ সালের আগে বিয়ে করে ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকত্ব লাভ করার প্রচলন ছিল। ১৯৮৪ সালের পর অনেক দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ মেলে।

তখন থেকেই দেশের টাকা পাচার বা স্থানান্তরের প্রবণতাটা বাড়তে থাকে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় যখন ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ হচ্ছে, তখন থেকে লুটপাট শুরু হয়েছে। আর এই লুটপাটের টাকা দিয়েই বিদেশে কেউ বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব অর্জন করছেন। বাড়ি কিনছেন।’

এদিকে জানা গেছে, বিদেশে অর্থ নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনা আছে। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো দেশের পাঁচ বছরের ভিসা পান, তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ ১২ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যেতে পারবেন সে দেশে। 

আর এক বছর, ছয় মাস বা তার চেয়ে কম সময়ের জন্য ভিসা পেলে ১০ হাজার মার্কিন ডলার নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া আর কোনো বৈধ উপায় নেই টাকা নিয়ে যাওয়ার। তাই দেশ থেকে প্রচুর টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, ভারত ও মালয়েশিয়া হয়ে পরে এ টাকা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। 

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিদেশে টাকা পাঠানো এখন কোনো বিষয়ই নয়। দুই টাকা বেশি দিলে যে কেউ টাকা পাঠাতে পারে। যেসব দেশে টাকা পাঠানো হয়, তারাও তেমন কোনো প্রশ্ন তোলে না।’ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //