ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস

ওষুধের খরচ জোগানোই দায়

উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাত-পা ব্যথা, ঘুমের সমস্যা ও ডায়াবেটিসের কারণে ছয় পদের ওষুধ প্রতিদিন খেতে হয় শফিক আহমেদের। একই দশা তার স্ত্রী ডলি আক্তারেরও। ওষুধ ও ইনসুলিন ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও সুস্থতাবোধ করেন না স্বামী-স্ত্রী। শফিক-ডলি আগে প্রতিমাসে এক থেকে দেড় হাজার টাকার ওষুধ খেতেন। এখন অন্যান্য খাতের মতো ওষুধের পেছনে তাদের ১২ গুণ বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ওষুধ খাওয়া যেনো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জীবনে।

দুই সন্তান নিয়ে চারজনের সংসার শফিক-ডলির। মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের। শফিক আহমেদ এখনো চাকরি করে যাচ্ছেন। বছর দুই পর রিটায়ার্ড করবেন। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। ডলি আক্তার পেশায় গৃহিণী। দুই সন্তানের মধ্যে একজন সদ্য স্নাতক শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছেন। আরেক জন কন্যা সন্তান। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরুতে পারেননি। তবে পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করেন। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে বাড়ি ভাড়া সব কয়েক গুণ বেড়েছে দেশে। কোনটা রেকে কোনটা বাদ দিবেন এই চিন্তায় আরও ঘুম হয় না। বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওষুধ ছাড়া যেখানে এক মুহূর্তও বাঁচা যায় না। সেখানে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এক/ দুই দিন ওষুধ খান না শফিক আহমেদ। তবে আমি বিষয়টি টের পাই। তবে কিছু বলি না। 

এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন ডলি আক্তার।

প্রায় এক যুগ ধরে শফিক-ডলি দম্পতি ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত। তাদের বাড়ি রাজধানীর খিলগাঁওয়ে। শুরুতে তাদের ডায়াবেটিসের বিভিন্ন ওষুধপত্রে প্রতি মাসে খরচ ছিল এক থেকে দেড় হাজার টাকা। আর দুই বছর আগে খরচ ছিল তিন থেকে চার হাজার টাকা। অথচ গত কয়েক মাসে সেই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার টাকার ওপরে। 

মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগে কথা হয় ডলির সঙ্গে। সেসময় তিনি এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, ডায়াবেটিসের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাত-পা ব্যথা, ঘুমের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। এজন্য প্রতিদিন আমার পাঁচ ধরনের ওষুধ খেতে হয়। তাতে প্রতিদিন খরচ হয় ২০০-৩০০ টাকা। আগে যে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয়ে গ্লুকোমিটারে ব্যবহৃত এক কৌটা স্ট্রিপ কিনেছি ৩৭০ টাকায় সেটা এখন ৪৫০ টাকা, ১১৯০ টাকার ইনসুলিন এখন কিনতে হচ্ছে ১৫০০ টাকা দিয়ে। দিন যতই যাচ্ছে ততই সব ওষুধের দাম বাড়ছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের পরিবারের অবস্থা একসময় খুব ভালো ছিল। স্বামীও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দুজনের চিকিৎসায় ব্যয় বহন করতে গিয়ে পুরো পরিবারই এখন নিঃস্ব।

শুধু এই দম্পতি নয়, মুগদা হাসপাতালে আসা কমপক্ষে ২৫ জন ডায়াবেটিস রোগী জানান, ওষুধ ভেদে বড় ব্যবধানে দাম বাড়ায় রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। নিয়মিত ওষুধ কিনতে পারছে না। আবার অনেকেই কাটছাঁট করে ওষুধ খাচ্ছে ফলে তাদের জটিলতা আরও বাড়ছে। ডায়াবেটিস পরীক্ষা ইনসুলিন ও মুখে খাওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় রোগী প্রতি স্ট্রিপ, খরচ বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

চিকিৎসরা জানিয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১০তম ডায়াবেটিসপ্রবণ দেশ এবং বাস্তব পরিস্থিতি এর চেয়েও গুরুতর। বর্তমানে শহর ও গ্রামে প্রায় সমানভাবে বেড়ে চলেছে ডায়াবেটিসের রোগী। নিয়মিত চিকিৎসা না করানোয় ইনসুলিন নেওয়ার পরও ৮৫ ভাগের বেশি রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই। এর অন্যতম কারণ চিকিৎসা খরচ। যা বেশিরভাগ রোগী বেশি দিন চালিয়ে যেতে পারে না। এতে শরীরে অন্যান্য রোগ বাসা বাঁধে। তখন চিকিৎসা ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে যায়। একসময় রোগীর পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায় এবং রোগীকে আর বাঁচানো যায় না। তাই ডায়াবেটিক রোগীর সেবায় সুলভে ওষুধ সরবরাহ থেকে শুরু করে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ মঙ্গলবার ‘ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস’ ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ৬৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস। এবার দিবসটি প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সর্বক্ষণ; সুস্থ দেহ, সুস্থ মন’। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী কর্মসূচি রয়েছে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগী প্রায় ২৫ হাজার। 

ধারণা করা হচ্ছে, দেশে যে হারে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৪৫ সালে দুই কোটি ছাড়াতে পারে।

আর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের ২০২১ সালের প্রতিবেদন বলছে, ৬১ শতাংশই আক্রান্তই জানেন না তারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন। কিশোর-তরুণদের নিয়ে করা ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৩০ বছরের বেশি বয়সীদের ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার ২১ শতাংশের বেশি।

এদিকে, ডেমরা থেকে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নাজিয়া আক্তার বলেন, চার বছর আগে ডায়াবেটিস শনাক্ত হয় তার। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি জটিলতায় ভুগছেন। এজন্য নিয়মিত ওষুধ কিনতেই তাকে। 

তিনি বলেন, এক বছর আগে আমার প্রতি মাসে ওষুধপত্র, হাসপাতালে আসা-যাওয়ার খরচসহ চার হাজার টাকায় হয়ে যেত, এখন প্রায় ১০ হাজার টাকা লাগে, তাহলে আমরা চলব কীভাবে? আমাদের আয় কতটুকু। তাই টাকার অভাবে মাঝে মধ্যে অনেক ওষুধ খাওয়া বাদ দিতে হয়।

চিকিৎসকরা জানান, ডায়াবেটিস চার ধরনের হয়ে থাকে- টাইপ-১, টাইপ-২, জেস্টেশনাল ও অন্যান্য। ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন ওষুধ ও ইনসুলিনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আর ডায়াবেটিক রোগীদের অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, চোখের সমস্যা, কিডনি সমস্যাসহ অন্যান্য জটিলতায় ভোগেন। ফলে তাদের নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট খেতে নিয়মিত খেতে হয়। 

আর একাধিক ফার্মেসির দোকানিরা জানান, গত ছয় মাসে ডায়াবেটিকস সমস্যাজনিত কম-বেশি সব ওষুধেরই দাম বেড়েছে।

শাহবাগ ও মালিবাগ এলাকার বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে জানা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষার দেড় থেকে দুই মাস আগে ৫০টি স্ট্রিপের কৌটার দাম ছিল ৭৮০ টাকা। এখন বেড়ে তা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ টাকায়। আর ২৫টি স্ট্রিপের কৌটার দাম ৩৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২৫ টাকা। অর্থাৎ স্ট্রিপের দাম ২১ থেকে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ বেড়েছে। 

এছাড়াও একুচেক একটিভ ২৫টির প্যাক আগে ছিল ৮০০ টাকা এখন ১১০০ টাকা। আর ইনসুলিন এক প্যাকেটে (ছয়টি দাম) বেড়েছে ২০০ টাকা। যা আগে ছিল ২৪০০ টাকা বর্তমানে ২৬০০ টাকা, এছাড়া র‌্যানটাস ১২৯০ টাকার প্যাকেট ১৫০০ টাকা হয়েছে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কমপ্রিড ৪০ এমজি প্রতি পিস ট্যাবলেট ৭-৮ টাকা বেড়েছে।

ডায়াবেটিসের ডায়মোরাল ৪০ এমজি একটি ট্যাবলেট আট থেকে বেড়ে ১২ টাকা হয়েছে। রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণে এ্যাটোভা ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রতি পিস ১০-১২ টাকা, রসুভা ১০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬ টাকা, এর সঙ্গে গ্যাস্ট্রিকের সারজেল-২০ ট্যাবলেটের দাম ৭ টাকা বেড়ে ৯ টাকা, প্রোসিপটিন প্রতি পিস ৪০ এমজি ট্যাবলেট ৬ টাকা থেকে ৯ টাকা বেড়েছে।

বারডেম একাডেমির পরিচালক ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক পাঠান বলেন, বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশে যারা ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা নেন তাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ২০ ভাগ ইনসুলিন নেন। আর আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের তথ্য মতে ৫০ শতাংশ রোগী ইনসুলিন নেন। ২০২১ সাল আমরা এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপরে সার্ভে করি। তারা ডায়াবেটিস নেই বলে জানান। স্কিনিং করে দেখা গেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিস রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব সার্ভে অনুযায়ী আরও অনেক বেশি মানুষ ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত।

তিনি বলেন, দেশে বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগীর শুরুতে পাঁচ-ছয় বছর চিকিৎসার আওতার বাইরে থাকে। কারণ এই সময়ে তাদের কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। আর লক্ষণ না থাকলে তারা ডাক্তারের কাছেই যাবে কেন? পরবর্তীতে তারা যখন কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হয় তখন শনাক্ত হয় তিনি ডায়াবেটিস রোগে ভুগছিলেন। সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ডায়াবেটিক রোগীদের অন্যদের তুলনায় কিডনির রোগে, চোখের দৃষ্টিশক্তিহীনতা, স্নায়ু সমস্যা, হার্টের জটিলতা, স্ট্রোক, পায়ের পচন ও পঙ্গুত্ব অনেকগুণ বেশি হচ্ছে। আর এর ফলে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। চিকিৎসার ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক একে আজাদ খান বলেন, ডায়াবেটিস একবার হলেই চিকিৎসা আজীবন। আর ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার উন্নত দেশের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশে বেশি। এর প্রধান কারণ হলো, আমাদের জীবনযাপনে পদ্ধতির পরিবর্তন। বিশেষভাবে অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। হাঁটাচলা, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া তারপরে ফাস্টফুড বা তৈলাক্ত খাবার, কোমল পানীয়, ধূমপান ও মুটিয়ে যাওয়া কারণে ডায়াবেটিস বাড়ছে। এগুলো পরিহার করতে পারলে প্রতিরোধ করা যাবে।

তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব জায়গায় এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল। আর দেশে সবকিছুর দাম যখন বাড়ছে, ডায়াবেটিস রোগীদের খরচ বাড়াও স্বাভাবিক। তবে আশার কথা হলো, টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিনটা সরকার ফ্রি দেবে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে। পর্যায়ক্রমে সরকার টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদেরও ইনসুলিন ফ্রি করে দেবে। এর সঙ্গে মুখের ওষুধও পাওয়া যাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //