রাশিয়া-বাংলাদেশ ‘উত্তেজনার’ প্রভাব কী

নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রুশ জাহাজ বাংলাদেশে ভিড়তে না দেওয়ায় মস্কোয় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলবের বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি ঢাকা। তবে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে আগামীকাল বৃহস্পতিবার প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। 

এদিকে গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে রুশ সংবাদ মাধ্যম তাস জানিয়েছে যে, রুশ জাহাজকে বাংলাদেশি বন্দরে ভিড়তে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে মস্কোতে থাকা দেশটির রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করেছিলো রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

রাশিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে বরাবরই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও মস্কোর পক্ষ থেকে এই অসন্তোষ জানানোর পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এই পরিস্থিতি আসলে কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। সাম্প্রতিক এই উত্তেজনা দু'দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে খারাপ কোনো সম্পর্কের সূত্রপাত করবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

অবশ্য কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, রাশিয়ার এই প্রতিক্রিয়া বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের একটি অংশ।

এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে তাস সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের জন্য পণ্য বহনকারী রুশ জাহাজকে দেশটির বন্দরে ভিড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমরা ঢাকার কুটনীতিক প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।”

এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশ জাহাজ ভিড়তে না নেয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা দুই দেশের মধ্যে থাকা ঐতিহ্যবাহী বন্ধুপূর্ণ সম্পর্কের বিরোধী এবং এটি দু’দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

গত সপ্তাহে ঢাকায় রুশ দূতাবাস সংবাদ সংস্থা তাসকে নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশের বন্দরে কমপক্ষে ৬৯টি রুশ জাহাজকে ভিড়তে দেয়া হয়নি। তবে এর মানে এই নয় যে, রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ।

তবে এখনো পর্যন্ত উরসা মেজর ছাড়া আর কোন জাহাজকে ভিড়তে না দেয়ার খবর অবশ্য বাংলাদেশে শোনা যায়নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী অবশ্য বলেছেন যে, রাশিয়ার যে ৬৯টি জাহাজ এবং সাতটি নৌ-পরিবহন কোম্পানির উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলো অতীতে কখনো বাংলাদেশের কোন বন্দর বা জলসীমা ব্যবহার করেনি। আর বাংলাদেশও কখনো এসব নৌপরিবহন লাইন ব্যবহার করেনি।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।

বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে বলেছে, ঢাকা এবং মস্কোর মধ্যে সম্পর্কের যে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে তা অনেকটা হঠাৎ করে শুরু হওয়ার মতোই। কারণ নিকট অতীতে উত্তেজনাকর তেমন কোন অবস্থা এই দুই দেশের মধ্যে তৈরি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বরং রাশিয়া এবং বাংলাদেশ বরাবরই একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা উদাহরণ হিসেবে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলছেন। কারিগরি নানা সহায়তার পাশাপাশি এতে অর্থায়নও করেছে মস্কো। তাই রাষ্ট্রদূতকে তলব করে অসন্তোষ জানানোর এই ঘটনা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে যে, এই পরিস্থিতি দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা তৈরির কোন আগাম সংকেত কিনা।

বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে মিশ্র মতামত জানিয়েছেন। অনেকেই বলছেন যে, রাশিয়া অনেকটা লোক দেখানোর জন্যই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল। আবার অনেকেই বলছেন যে, যে টানাপড়েন শুরু হয়েছে তা আপাতত চলতে থাকবে।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলেন, বাংলাদেশ যখন রাশিয়ার জাহাজকে ভিড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন একটা প্রশ্ন এসেছিল ছিল যে আসলেই এমন কোন পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল কিনা।

বাংলাদেশ বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভারতের মতো শক্তিশালী দেশ না মানলেও যুক্তরাষ্ট্র খুব একটি মাথা ঘামায় না। কিন্তু বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ কোন দেশ নয় যে নিষেধাজ্ঞা না মানলেও তারা চুপ করে থাকবে।

“আমরা অতিরিক্ত সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করেছি কারণ আমরা অত শক্তিধর দেশ না,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত ভুল কিছু ছিল না বলে মনে করেন তিনি এবং বলেন যে, রাশিয়া সেটা বোঝে বলেই ঘটনার মাস খানেকের বেশি সময় পার হওয়ার পর এমন পদক্ষেপ তারা নিয়েছে যাতে করে লোক দেখানোর জন্য হলেও কিছু একটা করা হয়।

রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলেন ‘বন্ধুদের মধ্যে মন কষাকষি হয়’ যা নিয়ে তেমন চিন্তার কোনো কারণ নেই। বরং এটির মাধ্যমে দুই দেশের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ বাড়বে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. রাজিয়া সুলতানা মনে করেন, এটা আসলে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের একটি অংশ।

কারণ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর পশ্চিমা বিশ্ব এবং রাশিয়া দুটি আলাদা ভাগ হয়ে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে দুদিন আগে ইউক্রেন সফর করেছেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

এমন অবস্থায় পশ্চিমারা যখন তাদের পক্ষ ভারী করছে, তখন রাশিয়াও আসলে তার মিত্রদের সাথে সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে চাইছে। আর বাংলাদেশ যেহেতু রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই বজায় রেখে চলেছে তাই রাশিয়া তার কৌশলের অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক এই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকতে পারে বলে মনে করেন ড. সুলতানা।

তিনিও মনে করেন, জাহাজ ভিড়তে না দেয়ার যে কৌশল বাংলাদেশ নিয়েছে তা সঠিক ছিল এবং সময়ের সাথে সাথে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, মস্কো এবং ঢাকার সম্পর্কে যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা হয়তো কিছুদিন ধরে চলবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের যে মাত্রা রয়েছে সেখানে, বাংলাদেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে রুশ জাহাজকে ঢুকতে না দিলেও ভারত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনুমতি দিয়েছে। 

এই দুধরনের আচরণের মধ্যে যে বৈপরীত্ব দেখা যাচ্ছে তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা বা যুক্তি নেই।

তিনি মনে করেন, রাশিয়া এই বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না এবং পরিণতিতে সম্পর্কে একটা টানাপড়েন চলতে থাকবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //