সরকারি লাখো পদ শূন্য

তবু বাড়ছে বেকারত্ব

সরকারি চাকরিতে প্রতিবছরই লাখ লাখ পদ খালি থাকে। অন‌্যদিকে দেশে বেকারত্বের সমস‌্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে প্রতিবছরই অনুমোদিত পদের মধ্যে তিন থেকে চার লাখ পদ খালি থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলে আসছে।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই বেকারত্ব বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। উচ্চশিক্ষা শেষ করে বেশিরভাগই এখন সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করেন বছরের পর বছর। দুর্বিষহ বেকার জীবনের যাতনা সইতে না পেরে আত্মহননের মতো ঘটনাও এদেশে ঘটে থাকে। 

করোনা ভাইরাস মহামারিতে বেকারত্বের সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশি তরুণদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশেই উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের পরিসংখ্যান এবং গবেষণা কোষ প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যান নিয়ে ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস‘ বা ‘বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের পরিসংখ‌্যান’ নামে একটি বই প্রকাশ করে থাকে।

সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রকাশিত বই থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালে প্রশাসনে মোট অনুমোদিত ১৯ লাখ ১৩ হাজার ৫২টি পদের বিপরীতে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি পদ শূন্য ছিল। ২০২০ সালে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি, পদ শূন্য ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, শূন্য পদের মধ্যে ৪৩ হাজার ৩৩৬টি প্রথম শ্রেণির, ৪০ হাজার ৫৬১টি দ্বিতীয় শ্রেণির, এক লাখ ৫১ হাজার ৫৪৮টি তৃতীয় শ্রেণির এবং এক লাখ ২২ হাজার ৬৮০টি চতুর্থ শ্রেণির পদ রয়েছে।

মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পর্যায়ে ১৮ হাজার ২৪০টি পদের মধ্যে শূন্য ৫ হাজার ২৮৪টি, সংস্থা ও অধিদপ্তর পর্যায়ে ১৪ লাখ ২১ হাজার ৭৩টি পদের মধ্যে শূন্য ২ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪৬টি। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসে ১৪ হাজার ৮৪১টি পদ খালি রয়েছে, এখানে মোট পদের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৯৭১টি। ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনগুলোতে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৭৬৮টি পদের মধ্যে ৬৯ হাজার ২৫৪টি পদ খালি ছিল।

বিগত বছরগুলোতে শূন‌্য পদের পরিস্থিতি

২০২০ সালে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ খালি ছিল। ২০১৯ সালে শূন্য পদের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি। এর আগের বছর ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৭টি পদ খালি ছিল। ২০১৭ সালে পদ খালি ছিল ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭৯টি। ২০১৬ সালে শূন্য পদের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি। সরকারি চাকরিতে ২০১৫ সালে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩১১টি, ২০১৪ সালে ৩ লাখ ২ হাজার ৯০৪টি, ২০১৩ সালে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮৭টি, ২০১২ সালে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৯৬৪টি, ২০১১ সালে ২ লাখ ৫৪ হাজার ২০৫টি, ২০১০ সালে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৭টি পদ খালি ছিল।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৭৬৪টি। ১২ বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ১৩ হাজার ৫২টি। এই ১২ বছরে পদ বেড়েছে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ২৮৮টি। প্রতিবছর গড়ে নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে ৫৬ হাজার। অন্যদিকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, শূন্যপদের মোট সংখ্যা হয়েছে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি। 

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা সব সময়ই পদ সৃজন করি। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বড় হচ্ছে। সেসব স্থানে পদ সৃজন হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের উইং বাড়াতে হচ্ছে। যেমন- রেলওয়েতে পদ সৃজন করতে হচ্ছে। কারণ রেলওয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। পদ বাড়তেই থাকবে। তাই শূন্যপদও থাকবে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৭৬৪টি। পরের বছর ৫৬ হাজার ৯৮৫টি পদ বেড়ে অনুমোদিত পদের সংখ্যা হয় ১৩ লাখ ২১ হাজার ৭৪৯টি। ২০১১ সালে ৪৮ হাজার ৩৭৮টি নতুন পদ সৃষ্টি হয়ে অনুমোদিত পদের সংখ্যা হয় ১৩ লাখ ৭০ হাজার ১২৭টি। ২০১২ সালে অনুমোদিত পদের সংখ্যা বেড়ে হয় ১৪ লাখ ৫ হাজার ৫২৪টি, ওই বছর ৩৫ হাজার ৩৯৭টি পদ বাড়ে। ৬৫ হাজার ৫১২টি পদ বাড়ে ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে এক লাফে ২ লাখ ৭ হাজার ৩০৬টি নতুন পদ সৃষ্টি হয়। ফলে মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা হয় ১৬ লাখ ৭৮ হাজার ৩৪২টি। প্রতিবছরই নতুন নতুন পদ সৃষ্টি হতে থাকে। এরপর ২০২০ সাল শেষে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত মোট পদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি।

যে কারণে খালি থাকে পদ

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে সে অনুপাতে নিয়োগ হয়নি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এ কারণে প্রতিবছরই সৃষ্ট পদের বিপরীতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শূন্যপদের সংখ্যা। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে নিয়োগ চলছে। তবে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কারণে সব প্রতিষ্ঠান চাইলেই নিজেদের মতো করে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে পারছে না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, শূন্যপদে নিয়োগের বিষয়ে সরকার পজিটিভ, যেখানে পদ শূন্য সেখানে নিয়োগ হচ্ছে। করোনার কারণে নিয়োগ কার্যক্রম এগোয়নি। কিছু পদ আছে সংরক্ষিত, সেই পদে নিয়োগ দিতে হলে সরকারের অনুমতি নিয়ে নিয়োগ দিতে হয়। বাকি পদগুলোতে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নিয়োগ দিতে পারে।

নিয়োগ ও শূন্য থাকা পদ নিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শূন্যপদগুলোতে রিক্রুটমেন্টও (নিয়োগ) প্রতিনিয়ত চলছে। করোনা মহামারি পরিস্থিতির পর আমরা দ্রুত শূন্যপদে নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারি সে প্রচেষ্টা আমাদের রয়েছে। সে বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তও আছে।’

বেকার সমস‌্যার চিত্র

উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বড় অংশই এখন বেকার। পড়াশোনা শেষ করে বছরের পর বছর চাকরির জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। গত বছরের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করা ৩২ বছর বয়সী বগুড়ার আলমগীর নামের এক ব্যক্তি ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর বিজ্ঞাপন দেওয়ার বিষয়টি খুব আলোচিত হয়। দেশের বেকার সমস্যার একটি করুণ উদাহরণ হিসেবে বিষয়টি অনেকটা নাড়া দিয়ে যায়। ঢাকা গিয়ে চাকরি না পেয়ে বগুড়ায় এসে টিউশনি করে ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনায় একটি বাদে সব কটি টিউশনি হারাতে হয় আলমগীরকে। এ কারণে বাধ্য হয়ে একটি বিজ্ঞাপন দেন তিনি। নগর এলাকায় দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো সেই ফটোকপির বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, ‘শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই।’

‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ’ বা ‘বিশ্বজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের প্রবণতা ২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আইএলও জানিয়েছে, মহামারির ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের তরুণসমাজ।  কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে তারা এখনো পিছিয়ে আছে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের জন্য শ্রমবাজার আরও কঠিন হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের চেয়ে তারা পিছিয়ে আছেন।

প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশি তরুণদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। যদিও ২০১৭ সালের বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বেকারত্বের হার মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় তরুণদের বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১, যা মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। 

সম্প্রতি একশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবে না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //