বড় অপরাধে ছোট শাস্তি পান সরকারি কর্মকর্তারা

বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিভাগীয় মামলার তদন্তে অনেকের সেসব বড় অপরাধের অভিযোগ প্রমাণও হয়; কিন্তু তারা শাস্তি হিসেবে পান লঘুদণ্ড। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রশাসনে কর্মকর্তাদের বড় অপরাধ করেও ছোট শাস্তিতে পার পাওয়ার এই প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।

কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলন, দায়িত্বে অবহেলা, প্রতারণা, দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিতিসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে। বিভাগীয় ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, অপরাধ তদন্তে নিয়োগ দেওয়া হয় কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেওয়া হয় শাস্তি। দেখা যাচ্ছে, বড় অপরাধ প্রমাণ হলেও শাস্তি মোটামুটি বেতন স্কেলের নিম্নতর ধাপে নামিয়ে দেওয়া, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা, তিরস্কার, পদাবনতি- এসব লঘুদণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

অভিযোগ ওঠা সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী।  

বিধিমালায় রাখা গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে- নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, চাকরি থেকে অপসারণ এবং চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ। নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে নমিয়ে দেয়াকে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের অনেকে গুরুদণ্ড মনে করেন না।

অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরও লঘুদণ্ড  

একজন সাংবাদিককে হয়রানিমূলকভাবে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ হওয়ায় কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোছা. সুলতানা পারভীনকে ২ বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছিল।

বিভাগীয় মামলায় তাকে গুরুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। তাকে বেতন বৃদ্ধি স্থগিতের লঘুদণ্ড দিয়ে গত বছরের ১০ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল।

পরে তিনি এই শাস্তি পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষতে সেই লঘুদণ্ডও বাতিল করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন

মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ২৩ নভেম্বর দণ্ড বতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। 

সাংবাদিক নিগৃহের ঘটনায় অভিযুক্ত কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমাও লঘুদণ্ড পেয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাকে শাস্তি দেওয়ার প্রজ্ঞাপনে জানায়, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার থাকার সময় রিন্টু বিকাশ চাকমা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তার বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় মামলার তদন্তে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা বা অন্য কোন উপযুক্ত গুরুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে সরকারি কর্মকমিশনও (পিএসসি) এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করে; কিন্তু পরে তাকে গুরুদণ্ডের পরিবর্তে তিন বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর তাকে শাস্তি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল।

নারী অফিস সহকারীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় জামালপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীরকে বেতন কমানোর শাস্তি দেওয়া হয়। 

উপসচিব লোকমান আহমেদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ। একাধিকবার বিভাগীয় মামলার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। বিভাগীয় মামলার তদন্তে অভিযোগ প্রমাণও হয়; কিন্তু শাস্তি হিসেবে পান লঘুদণ্ড।

উপসচিব নাজিয়া শিরিন নীলফামারীর জেলা প্রশাসক থাকার সময় জেলার ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নে উত্তর খড়িবাড়ি মৌজায় তিস্তা নদীর বালুমহাল ইজারা দেয়ার ক্ষেত্রে দাখিল করা চেক ব্যাংকে জমা না দিয়ে ইজারার পুরো টাকা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে ইজারা গ্রহীতার সঙ্গে চুক্তি করেন। তাকে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছরের ১১ মে তিনি এই শাস্তি পান। তিনি পরে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিবও হন।

ইফতেখারুল ইসলাম খান নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় নাটোর সদর উপজেলার ১নং খতিয়ানভুক্ত ৬০০৪, ৬৯৪৩ ও ৮৫১৭ নম্বর দাগের ২৭ দশমিক ১৬৯৬ একর আয়তনের অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানী ভবানী দীঘিটি (জয়কালী দীঘি) বন্দোবস্ত দিতে বেআইনিভাবে সহযোগিতা করেন। এতে সরকারের এক কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার ৫১২ টাকার রাজস্ব ক্ষতির অভিযোগ প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ হয়। তার পরও লঘুদণ্ড হিসেবে ইফতেখারুল ইসলাম খানকে এক বছরের জন্য বেতন গ্রেডের নিম্নতম ধাপে নামিয়ে দেওয়া হয়। 

সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ আরিফুজ্জামানের বিরুদ্ধে স্ত্রীকে নির্যাতন, ডিভোর্সের হুমকি দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ছিল। বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পরও গত বছরের ৮ নভেম্বর আরিফুজ্জামানকে ‘তিরস্কার’ নামের লঘুদণ্ড দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী কমিশনার থাকার সময় মো. আব্দুর রউফ তালুকদার তথ্য গোপন করে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তামান্না রহিম ফাল্গুনী নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। স্ত্রী হিসেবে ফাল্গুনীকে প্রাপ্য আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ ওঠে রউফের বিরুদ্ধে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর গত বছরের ২৪ মার্চ ‘তিরস্কার’ শাস্তি পান তিনি।

এক নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ ইমতিয়াজের বেতন কমানো হয়। তাকে বেতন কমানোর ‘লঘুদণ্ড’ দিয়ে ৩১ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ইমতিয়াজ বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি)।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকার সময় অমিত চক্রবর্ত্তীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাকে শাস্তি হিসেবে লঘুদণ্ড ‘তিরস্কার’ করা হয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ শাস্তির কথা জানানো হয়।

যে কারণে বড় অপরাধেও লঘুদণ্ড

‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় অসদাচরণ ও দুর্নীতির জন্য শাস্তি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। যে কোনো শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কর্মকর্তারা জানান, প্রশাসন ব্যাপকভাবে রাজনীতিকীকরণের কারণে অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। দলীয় অনুগত কর্মকর্তারা বড় অপরাধ করলেও লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে প্রশাসনে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হবে না। বরং তা অপরাধ করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের আরও উৎসাহিত করবে।

যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিধি-বিধানও বাধা। ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা’ অনুযায়ী দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলেও লঘুদণ্ড দেওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কর্মকর্তারা।

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়। অনেক সময় অভিযুক্তের চাকরিকাল, বয়স, মানবিক দিক বিবেচনা করেও শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া যে কারো শাস্তি মওকুফ বা কমিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, কোনো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় তদন্ত হয়। তার পর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী গুরু বা লঘু শাস্তি দেওয়ার দুটি বিধান আছে; সেটি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন সর্বোচ্চ ব্যক্তি, যার অনুমোদন লাগে। রাষ্ট্রপতির শাস্তি মার্জনা বা প্রমার্জনা করার ক্ষমতা আছে। সেই অনুযায়ীও সবদিক বিবেচনা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেটি করা হয়। রাষ্ট্র তার কাছ থেকে যদি বেশি অবদান পায়, সেক্ষেত্রে সে যে ভুল করেছে বা কোনো অপরাধ যদি তিনি করে থাকেন, তখন সেটি সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এমন কিছু সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা দেখছি অনেক বড় অপরাধ করেও লঘুদণ্ড হচ্ছে। শাস্তি বলতে পদোন্নতি দুবছর বন্ধ থাকা বা বেতন কিছুটা কমিয়ে দেওয়া। এগুলো তো শাস্তি হলো না।’

তিনি বলেন, ‘অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি না হওয়াটা একটা বড় সমস্যা। প্রশাসন তো এখন অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে রাজনীতিকীকরণ। প্রশাসন রাজনীতিকীকরণের কারণে দুর্নীতি আরও বেড়ে গেছে।’

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘অনেক সময় শাস্তির মাত্রা নির্ভর করে তিনি কত কাছের লোক, কত দূরের লোক; সেটার ওপর। যদি কারও গুরুদণ্ড পাওয়ার কথা, তাকে যদি লঘুদণ্ড দেওয়া হয় তবে অনাচার-দুর্নীতি বন্ধ হবে না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //