রোহিঙ্গা শিবিরে বাল্যবিয়ের হিড়িক

কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে বাল্যবিয়ের হিড়িক পড়েছে। গত পাঁচ বছরে অন্তত ১২/১৫ হাজার বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। অধিকাংশ বিয়ে ছিল সম্পর্কের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিভাবকরা দায় মোচন করতে দিয়ে দিচ্ছে অল্প বয়সে বিয়ে। একেতো বেকার জীবন অন্যদিকে ঝুপড়ি বাসায় থাকার জায়গা সংকটের কারণে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বাল্যবিয়ে।

তা ছাড়া মেয়েরা একটু বড় হলেই যৌন নির্যাতনের টার্গেটে পরিণত হয়। এমনটা দাবি উখিয়ার জামতলী ১৫ নম্বর ক্যাম্পের মেয়েকে ১৩ বছরে বিয়ে দেওয়া কবির হোসেনের। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে পাঁচ বছরে ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

সেই সঙ্গে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে নতুন জন্ম নেওয়া প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। সূত্র জানায়, ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থানরত কম বয়সী নারী ও শিশুরা বিয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে বিনা অনুমতিতে, যা সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

বাল্যবিয়ে মায়ের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেন ক্যাম্পে কর্মরত স্বাস্থ্য সেবিকারা। কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা, সন্তান জন্মদানে জটিলতাসহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এ নারীদের। 

একটি গবেষণা সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রচলনের কারণে ক্যাম্পগুলোতে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে অভাব আর নিরাপত্তাহীনতার কথা বলছেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। কম বয়সী মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৩-এর আবদুল করিম।

মেয়ের বয়স ১৪ আর বরের বয়স ১৬ বছর। মেয়ের নাম রোকসানা বরের নাম রবি আলম, সে ১৪ নং ক্যাম্পের নুর হোসেনের ছেলে। বিয়ে হয়েছে গত এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখে। মেয়ের বাবা আবদুল করিম বলেন, মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া হলো সুন্নত। আর যুবতী মেয়েরা ক্যাম্পে অনিরাপদ। 

ক্যাম্প-৬, ব্লক বি-এর ১৩ বছর বয়সী রহিমা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় ১৭ বছরের আকতার আহমদ, ১৫ বছরের নূর কায়দার বিয়ে হয় ১৮ বছরের নুর হোসেনের। তাদের মতো অনেক রোহিঙ্গা কিশোরীর অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া ক্যাম্পগুলোতে।

মানবিক বিপর্যয়, খাদ্যাভাব ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী বাল্যবিয়ে রোধের প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করে ও বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না বলে উদ্বেগ জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

ইউনিসেফ কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু মারাত্মক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন তারা। মা ও শিশুদের জন্য বিশেষায়িত খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় অপুষ্টিতে ভুগছেন অনেকেই। তার ওপর বাল্যবিয়ে ও বহু সন্তান নেওয়ার প্রবণতা রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও আইন অমান্য করে বিয়ে করছেন রোহিঙ্গা কিশোরীদের। রোহিঙ্গাদের বিয়ে করা আইগতভাবে নিষিদ্ধ; কিন্তু কেউ নিয়ম মানছেন না।

এ দিকে রোহিঙ্গারা মনে করেন, তাদের অল্প বয়সী হোক বা যুবতী হোক এ দেশে পরিণত বয়সীদের হাতেও যদি একটি মেয়ে বিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে কপাল খুলেছে পুরো পরিবারের। একটি সন্তানের বিয়ে দেওয়া মানে নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ সহজ হওয়া।

সে কারণেই তারা বাচ্চা মেয়েকে বয়স্ক বাংলাদেশি পাত্রের সঙ্গেও বিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। এ সুযোগ স্থানীয় লোকজনও কাজে লাগাচ্ছে।

বিয়ে করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ নয় বলে মনে করেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী।

তাই বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের বাল্যবিয়ে সংস্কৃতি ও এর প্রভাব নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করা প্রয়োজন।

এসব অসম বিয়ে রোধ করতে যথাযথ আইনের প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি। উখিয়ার পালংখালী থাইংখালীর মমতাজ আহমদ (৫৬) বিয়ে করেছেন ১৪ বছরের এক রোহিঙ্গা তরুণীকে। এ জন্য তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি। তার মতো হাজার হাজার লোক আছে উখিয়ার টেকনাফ তথা কক্সবাজার জেলায়, যারা রোহিঙ্গা কিশোরীদের বিয়ে করে ঘরে তুলেছে।

রোহিঙ্গা প্রতিরোধ জাতীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আতাউল্লাহ খান বলেন, রোহিঙ্গা নর-নারীদের শরণার্থী আইনে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে বিয়ে সম্পাদন করা হোক। আর বাংলাদেশি-রোহিঙ্গাদের বিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর নজরদারির দাবি জানাচ্ছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //