ঋণখেলাপিদের আবারও বড় ছাড়!

ঋণখেলাপিরা যেন ব্যাংক খাতের বরপুত্র। তাদের আবদারের শেষ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দিতে কার্পণ্য নেই। ২০১৩ সাল থেকে ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া শুরু। এরপর নিত্যনতুন ফর্মুলায় ছাড় দেওয়া অব্যাহত রয়েছে। 

সর্বশেষ গত ১৮ জুলাই দেওয়া ছাড়ের নতুন ফর্মুলা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বকেয়া ঋণের মাত্র আড়াই শতাংশ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে বের হতে পারবেন যে কেউ। সুবিধা ভোগ করতে পারবেন একনাগাড়ে ৮ বছর। পর্যায়ক্রমে এই সুবিধা ২৯ বছর পর্যন্ত ভোগ করা যাবে। আবার নিতে পারবেন নতুন করে কাঁড়ি কাঁড়ি ঋণও। বারবার সুবিধা দেওয়ার ফরমানে বেকাদায় পড়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। খাতা-কলমে তাদের খেলাপি ঋণ না থাকলেও গ্রাহকের পকেটে দীর্ঘদিনের জন্য আটকে যাচ্ছে ব্যাংকের টাকা। এতে ব্যাংকের জন্য ব্যবসা করা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে গত ১২ জুলাই দায়িত্ব নেন আবদুর রউফ তালুকদার। দায়িত্ব নেওয়ার ৬ দিনের মাথায় ঋণ খেলাপিদের ব্যাপক ছাড় দিয়ে এই সার্কুলার জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে- আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এই নীতিমালা জারি করা হলো। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫ থেকে ৮ বছরে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ আছে এমন গ্রাহকরা ৪ দফায় ২৯ বছর পর্যন্ত এই সুবিধা উপভোগ করবেন। 

নতুন ফর্র্মুলায়, খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকমালিকেরাই এখন ঠিক করবেন, তারা ঋণখেলাপিদের কী সুবিধা দেবেন। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত, যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল করতে বিভিন্ন তদবির আসত। এ কারণে নতুন গভর্নর সেই সুবিধা দেওয়ার ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দিয়েছেন। পাশাপাশি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিতে পড়া অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ঋণ পুনঃতফসিলে ছাড় দিয়েছেন। না হলে বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হয়ে পুরো আর্থিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।

ঋণখেলাপিদের ছাড় এবারই প্রথম নয়। করোনার কারণে ২০২০ সালে কেউ এক টাকা না দিলেও খেলাপি হননি। ২০২১ সালে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, ১৫ শতাংশ দিলেই তাকে খেলাপিমুক্ত রাখা হয়েছে। চলতি বছরও যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, তার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করলে খেলাপি হবেন না। ২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়। তখন ৫২ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল হয়। এর আগে ২০১৫ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ ১২ বছরের জন্য পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। এই সুবিধায় ১১ প্রতিষ্ঠানের ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন হয়। তার আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ডাউনপেমেন্টের শর্ত শিথিল ও ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনার আলোকে ২০১৪ সালে ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়েছিল।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর না দিয়ে লুকিয়ে ফেলার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপিদের আরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে সমস্যায় পড়ে গেছে। তবে আমানত প্রবাহ ঠিক থাকায় এখনই হয়তো সেভাবে সংকট বোঝা যাচ্ছে না। কোনো কারণে আমানত না পেলে বড় ধরনের সংকট দেখা দেবে। ঋণখেলাপিদের বারবার এভাবে ছাড় দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।

বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংকের মালিক ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২০১৯ সালে ঘোষণা করেন খেলাপি ঋণ আর এক পয়সাও বাড়বে না। এরপর দেন গণছাড় সুবিধা। কিন্তু করোনার কারণে দেওয়া ছাড় উঠে যাওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নতুন করে অনেক ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে যে এক লাখ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে, তারও বড় একটা অংশ অনাদায়ী হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণ তিন মাসে বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। 

এখন খেলাপি ঋণ কম দেখানোর নতুন ফর্র্মুলায় বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ আদায়ের স্বার্থে চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিল করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ৫০০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় গ্রেস পিরিয়ডসহ আট বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করতে পারবে ব্যাংক। ১০০ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ প্রথম ও দ্বিতীয়বারে ৭ বছর এবং ১০০ কোটি টাকার কম অঙ্কের ঋণ দুইবার ৬ বছর পর্যন্ত পুনঃতফসিল করা যাবে। প্রতি পর্যায়ে এক বছর কম করে তৃতীয় দফায় এবং আরও এক বছর কম করে চতুর্থবার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। এভাবে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ ২৯ বছর, ১০০ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ২৫ বছর এবং ১০০ কোটি টাকার কম ঋণ ২১ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা যাবে। 

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন নতুন নীতিমালা করে ঋণখেলাপিদের প্রতি যেভাবে উদারতা দেখানো হচ্ছে তাতে ভালো ব্যাংকের জন্য ব্যবসা করা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। কেননা এখানে ব্যাংকে টাকা ফেরত না দেওয়ার মানসিকতা আগে থেকেই আছে। এটি ব্যাংকের জন্য গভীর সমস্যা। আবার সুবিধা দেওয়ার কারণে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রবণতা একেবারেই কমে যাবে। 

অর্থনীতিবিদরা এই সার্কুলারের সমালোচনা করলেও ব্যাংকের এমডিরা সরাসরি এর বিরুদ্ধে বলছেন না। কারণ ব্যাংকের মালিকরা এই নীতিমালার পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এটি গণছাড় হিসেবে দেখতে রাজি নন। 

রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম এই নীতিমালাকে সময়োপযোগী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি প্রণয়ন করবে, উপদেশ দেবে এবং তদারকি করবে। পুনঃতফসিল করবে ব্যাংক। তিনি বলেন, কেউ খেলাপি হলে তাকে বেইল আউট দিতে হবে। তা না হলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে। মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গণছাড় দেওয়ার জন্য এই সার্কুলার জারি করা হয়নি। আমরা মনে করি, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক টালমাটালের মধ্যে খেলাপি ঋণ আদায়ের স্বার্থে এই নীতিমালার দরকার ছিল। এতে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //