তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে দিনভর যা হলো

রাজধানীর কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে গতকাল হঠাৎ মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে আটক করে হয়রানি করে পুলিশ। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদের জেরে দুইজনকেই ছেড়ে দেয়া হয়। তবে আজ সকাল থেকে আবারো মাঠে স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু করে থানা পুলিশ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিনব্যপী নানা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা।

একদিকে পুলিশি হয়রানির নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি, মাঠে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণ না করে খেলার মাঠ রাখার দাবি, মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা।

অপরদিকে মাঠ নিয়ে আলোচনা করতে একটি সভা ডেকেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলামকে।

সবমিলিয়ে কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে আজ সোমবার (২৫ এপ্রিল) দিনভর একাধিক ঘটনা ঘটেছে। চলুন একনজরে দেখে আসা যাক কি কি হল এই মাঠকে ঘিরে-

প্রতিবাদী সংবাদ সম্মেলন-

রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘তেঁতুলতলা মাঠে থানা না এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের তীব্র প্রতিবাদ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে অধিকারকর্মীরা কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণ না করে খেলার মাঠ রাখার দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করে এএলআরডি, বাপা, বেলা, আসক, ব্লাস্ট, গ্রিন ভয়েস, নিজেরা করি, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও টিআইবি।

বক্তারা বলেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে তেঁতুলতলা মাঠটি স্থানীয় বাসিন্দারা ঈদগাহ হিসেবে, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের কেন্দ্রস্থল হিসেবে, মরদেহ গোসল করানোর কাজে ও খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। মাসখানেক ধরে মাঠটিতে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে বেষ্টনি তৈরি করে সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করেছে কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ। সেখানে ঝুলানো সাইনবোর্ড অনুযায়ী মাঠটিতে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণ করা হবে।

তারা আরো বলেন, গত ২৪ এপ্রিল মাঠ রক্ষায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার সময় সৈয়দা রত্না ও তার ১৭ বছরের ছেলে ঈশা আব্দুল্লাহকে কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ আটক করে নিয়ে যায়। পরে দিনভর প্রতিবাদের মুখে মধ্যরাতে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাদের থেকে মাঠ রক্ষার আন্দোলন আর করবেন না বলে মুচলেকায় সই নিয়েছে। ফলে আটক ও তুলে নিয়ে যাওয়া এবং মাঠ দখলের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কলাবাগান থানা যে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিরই নিন্দনীয় প্রতিফলন ঘটিয়েছে, তা স্পষ্ট।

সুশীল সমাজের নাগরিকদের বিবৃতি-

তেঁতুলতলা মাঠ সংরক্ষণ করাসহ মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে পুলিশি হয়রানির নিরপেক্ষ তদন্ত দাবিতে বিবৃতি দিয়েছে সুশীল সমাজের নাগরিকেরা। বিবৃতিটি গণমাধ্যমে পাঠায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)।

বিবৃতিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৈয়দা রত্না ও তার নাবালক ছেলেকে কোনো রকম আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, কোনো আইনসিদ্ধ অভিযোগ ছাড়া দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টারও বেশি সময় আটক রাখা দেশের সংবিধান ও আইনের ন্যাক্কারজনক লংঘন ও বেআইনি।

বিবৃতিদাতারা হলেন-

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র; সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও সভাপতি বাপা; ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী সভাপতি পিপিআরসি; ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক; ড. হামিদা হোসেন, মানবাধিকার কর্মী; খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি; শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন; মেঘনা গুহঠাকুরতা, গবেষক; ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ; রাশেদা কে. চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গণস্বাক্ষরতা অভিযান; শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি; শিরিন হক, সদস্য, নারীপক্ষ; অধ্যাপক পারভীন হাসান, উপাচার্য, সেন্ট্রাল উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়; ড. ইমরান রহমান, প্রাক্তন উপাচার্য, ইউল্যাব; শাহদীন মালিক, আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ; সারা হোসেন, অনারারী ডিরেক্টর, ব্লাস্ট; প্রফেসর আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; গীতিয়ারা নাসরীন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; এম এম আকাশ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ফেরদৌস আজিম, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়; ড. সামিনা লুৎফা, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. স্বপন আদনান, প্রফেসারিয়াল গবেষণা সহযোগী, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়; জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ; রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী, কোস্ট; মো. নূর খান লিটন, মানবাধিকার কর্মী; তাসাফি হোসেন, প্রতিষ্ঠাতা, বহ্নিশিখা; ড. নায়লা জেড খান, পরিচালক, ক্লিনিক্যাল নিউরোসাইন্স সেন্টার, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন; ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী; রেহনুমা আহমেদ, লেখক; অরূপ রাহী, সঙ্গীতশিল্পী, লেখক; নবনীতা চৌধুরী, উন্নয়নকর্মী, গায়ক; মাহমুদ রহমান, আলোকচিত্রী, ম্যাপ-ফটো; ড. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক; সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান নির্বাহী, বেলা।

মাঠে ঈদের নামাজ আদায়ের ঘোষণা

তেঁতুলতলা মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা।  বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তেঁতুলতলা মাঠে নাগরিক প্রতিবাদ সমাবেশে এ ঘোষণা দেন এলাকার স্থপতি ইকবাল হাবীব।

ইকবাল হাবীব বলেন, আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, খুব শিগগিরই এখান থেকে থানার ভবনের নির্মাণকাজ স্থানান্তর করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই আশ্বাসের পরও যদি কেউ ঈদুল ফিতরের বন্ধে মাঠে কোনো সীমানা দেয়াল নির্মাণ করতে চায় এলাকাবাসী তা মানবে না, প্রতিবাদ গড়ে তুলবে।

মাঠ নিয়ে সরকারের চিন্তা

তেঁতুলতলা মাঠ খেলার মাঠ হিসেবেই থাকবে, না সেখানে থানার জন্য ভবন করা হবে, সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তিনি বলেন, আমরা মনে করি খেলার মাঠে বাচ্চারা খেলাধুলা করবে এটাই স্বাভাবিক। খেলার মাঠের ব্যবস্থা যেমন করতে হবে আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও থানার জন্য জায়গাটা জরুরি। জায়গাটায় কী করা যায়, এটা আমরা পরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।

ঢাকা জেলা প্রশাসককে ডেকেছে মন্ত্রণালয়

রাজধানীর কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে আলোচনা করতে একটি সভা ডেকেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই সভায় ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলামকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

গতকাল রবিবার এই উত্তেজনার শুরু হয় মা ও ছেলেকে আটকের মধ্যে দিয়ে।  যা ঘটেছিল গতকাল

খেলার মাঠে থানা, প্রতিবাদ করায় মা-ছেলে আটক

গতকাল রবিবার (২৪ এপ্রিল) সকালে তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনে থাকা সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে আটক করে পুলিশ। এই মাঠে কলাবাগান থানার ভবন নির্মাণের কথা রয়েছে।

সকালে তেঁতুলতলা মাঠ থেকে তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে সৈয়দা রত্না ফেসবুকে মাঠে ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে লাইভ করছিলেন। লাইভ দেয়ার সময় তাকে আটক করা হয়।

পুলিশ জানায়, সরকারি কাজে বাধা দেয়ার জন্য দুইজনকে আটক করা হয়েছে।

মা-ছেলের মুক্তি

সকালে মা-ছেলেকে আটকের পর নানা নাটকীয়তা শেষে রাতে দুইজনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

এর আগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া নিয়ে কলাবাগান থানা পুলিশ নানা তথ্য দেয়। ছেড়ে দেয়ার অল্প সময় আগেও পুলিশ জানায়, শুধু রত্নার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তার ছেলেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এর পর পরই তারা এই বক্তব্য থেকে সরে আসেন।

এ বিষয়ে গতকাল রবিবার (২৫ এপ্রিল) রাত সোয়া ১২টার দিকে জানতে চাইলে এসি শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান বলেন, ‘মামলা হয় নাই। সিদ্ধান্তটা হচ্ছে এ রকম, যেহেতু তিনি একটা মুচলেকা দিছেন, তিনি ভুল বুঝতে পারছেন। তিনি সরকারি কাজে আর বাধা দিবেন না। এ কারণে মা ও ছেলেকে তার পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’

মাঠটি কার

তেঁতুলতলা মাঠের এক বিঘা জমি এক জন বিহারির মালিকানায় ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। সেই জায়গাটিতে স্থানীয় শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করত।

সরকারি খাস জমি হিসেবে নথিভুক্ত এই ফাঁকা জায়গাটিতে থানা করতে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। আর এর পর থেকেই সেই জায়গাটি খেলাধুলার জন্য ফাঁকা রাখার দাবি উঠেছে।

কলাবাগানে সিটি করপোরেশনের একটিমাত্র খেলার মাঠ আছে। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশেই সেই মাঠ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //