সরকারের সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতার পাল্লাও ভারী!

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তিন বছর অতিক্রম করল কয়েক দিন আগে। সাফল্য-ব্যর্থতা নিরূপনের জন্য তিন বছর খুব বেশি সময় নয়। আবার যদি আওয়ামী লীগের আগের শাসনকাল বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতে হবে ২০০৮ সাল থেকে টানা তিন দফায় তারা ক্ষমতায় আছে। 

কোনও একক দল হিসেবে ক্ষমতায় থাকার এই সময়কালও একটা রেকর্ড। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এর আগে কোনও সরকারই টানা এত বছর ক্ষমতাসীন থাকেনি। সে হিসাবে ব্যর্থতার প্রশ্ন ওঠে না। হতে হবে সাফল্যতার গল্প। যদি ব্যর্থতা কিছু থাকেও, সেটা প্রয়োগের বেলায় হতে পারে। কিন্তু তথ্য বলছে সরকারের সাফল্য যেমন আছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও আছে। 

বিগত কয়েক বছরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও, জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর থাবা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হোঁচট খেতে হয়েছে সরকারকে। এসময়ে অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে গেলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখাতে না পারার ব্যর্থতা বড় ব্যর্থতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ায় জাতি অনেকটাই স্বস্তিতে আছে। 

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে অতি দারিদ্র্যের হার এখন ১২ দশমিক এক শতাংশ। মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) ৬ শতাংশের বাধা অতিক্রম করে প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৫ মার্কিন ডলারে। 

বেসরকারি স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তকমা ঝেড়ে ফেলার যোগ্যতা অর্জনের অনেকটাই দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। যদিও বিশ্বব্যাংকের এই পরিসংখ্যানকে ‘এমবেডেড’ বলেন অনেকে। দৃশ্যমান উন্নয়ন বলতে বড় বড় দালান-কোঠা নির্মাণকেই বোঝায় না। মানবসম্পদের উন্নয়নকেই মূল উন্নয়ন বোঝায়। যদিও এই ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের উন্নতি নেই বললে চলে এবং তারা এর উন্নতি ঘটাতে সচেষ্টও নয়।

আবার ব্যক্তি খাতে প্রবৃদ্ধির সুবাদে সরকারের রাজস্ব আয় প্রত্যাশিত হারেই বেড়েছে। অবকাঠামোসহ নানা খাতে সরকার প্রতি বছর ব্যয় করছে লাখ কোটি টাকার বেশি। এক সময় খাদ্য চাহিদা পূরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে বিদেশি দাতাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ এখন আর খাদ্য সহায়তা নেয় না। খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৩৯০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।  অথচ এ বছর ভরা মওসুমেও লাখ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তাহলে ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ কথাটা বড্ড করুণ শোনায়। কৃষিঋণ ১৭ দশমিক সাত হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। 

বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ হাজার ৯৮০ মেগাওয়াট। এরই মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। 

দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ এখন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা। ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহের পরিমাণ ৬ লাখ ৭১ হাজার ৯ দশমিক ৩ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। এসব আপ্তবাক্য বলবার সময় বিশ্বব্যাংক বা ওই ধরনের দাতা সংস্থা যেসব উপমা ব্যবহার করে, সেসব সরকারের নীতিনির্ধারক, মন্ত্রী-আমলাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মাল-মসলা জোগায়।

তৃতীয় বছরে বিদেশে সাত লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। রফতানির পরিমাণ এখন ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমদানির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাজস্ব আয় ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই যে তৈরি পোশাক খাত এবং প্রবাসী শ্রমিক খাত। এই দুটি খাত থেকে আসা টাকাই সরকারের পায়ের তলাকার মাটি শক্ত করে। অথচ এই দুটি খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনমানে সামান্যতম উন্নতি হয়নি। তাদের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়েছে; কিন্তু আয় বাড়েনি।

পরিসংখ্যানের মতে, ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের বাস। সেই জনসংখ্যা নিয়ে গর্ব করার জন্য বলতে হয়- ‘জনশক্তিতে রূপ দেওয়ায় বিশাল এ জনগোষ্ঠী অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসেবে বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ এখন কর্মক্ষম। ২০২২ সালে কর্মক্ষম মানুষের হার ৬৯ শতাংশে উন্নীত হবে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। বিপুল জনশক্তির কর্মের নিশ্চয়তা দিতে অবকাঠামো উন্নয়নে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।’

শুনতে ভালো লাগে। যখন এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদার প্রশ্ন আসে, তখন দেখা যায় এই বিপুল জনসংখ্যা যতটুকু পণ্য কনজিউম করে. তা নিতান্তই অপ্রতুল। এই জনগোষ্ঠি এতটাই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যে, তাদের আর বিক্ষুব্ধ হওয়ার ফুরসত থাকে না। তাই সরকারেরও মনে হয় সব কিছু শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে।

অবকাঠামো খাতে বেশ বড় কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বর্তমান সরকার। এ সব প্রকল্পের কাজ শেষে দেশের চেহারা অনেকটাই পাল্টে যাবে। পদ্মা সেতু চালু হলে মোট দেশজ আয় ১ শতাংশের বেশি বাড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের কাজ চলছে। ইতিমধ্যেই ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চার লেনে রূপান্তর করা হয়েছে। চার লেনের কাজ চলছে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে। গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলো ডাবল ট্র্যাকে উন্নীতের কাজও চলছে। 

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে- ৩৫ হাজার ৯শ ৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আলোচিত কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে ফাস্ট ট্রাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটি। এসব প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়াও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। চলছে মেট্রোরেল নির্মাণের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া। 

সুন্দরবনের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে শিগগির। দ্রুত কাজ শেষ করতে প্রকল্পটিকে ফাস্টট্রাক প্রকল্পে যোগ করা হয়েছে। জ্বালানি চাহিদা পূরণে মহেশখালীতে নির্মাণ হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির জন্যই এ টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

বাজেট বাস্তবায়নে বরাবর বড় ব্যর্থতা থাকলেও এবার অর্থনীতির প্রায় সবগুলো সূচক ইতিবাচক। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল। চলতি অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বড় কোনো দুশ্চিন্তা নেই সরকারের। যখন কোনও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তখন এভাবেই বলা হয়- ‘গত ৮ বছরে দেশে কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। খাদ্যে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে প্রতি বছর সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে তার শতভাগ পূরণ হচ্ছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন আবিষ্কার দেশকে শুধুই অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’

২০২১ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের সাময়িক মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। আর এটি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে গত বছর। 

সাফল্যের পাশাপাশি আছে ব্যর্থতাও

আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের গত বছরের শুরু থেকেই সরকারকে নানা রকম অস্বস্তিকর ঘটনার মধ্যে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধিসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সড়ক পরিবহনের বিশৃঙ্খলা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন, বুয়েটের আবরার হত্যাসহ আরও কয়েকটি হত্যাকা- সরকারকে কিছুটা হলেও উদ্বেগ উৎকন্ঠায় ফেলে দেয়।

উন্নয়নে সাফল্য থাকলেও, সরকারের ব্যর্থতা গণতন্ত্রে, কিন্তু এই যে বিরাট ব্যর্থতা, একেই আবার ব্যর্থতা বলতে চান না সরকারের কেউই। তাদের কাছে যেকোনও ব্যর্থতার বিষয় উঠলেই ইতিহাস টেনে তাদের বলতে হয়- অমুকের শাসনামলের চেয়ে ভালো। তমুকের শাসনামলে এই ছিল না, ওই ছিল না, আমাদের সময়ে কী কী আছে তার ফিরিস্তি।

দেশে মানবাধিকারসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলমান রয়েছে। নারী ও শিশু অধিকারের বিষয় এখনো উদ্বেগজনক। রাজধানী ঢাকা এখন চার-পাঁচটি নেতিবাচক তালিকার প্রথম বা দ্বিতীয়। ওইসব তালিকার বিস্তারিত অর্থ-রাজধানী ঢাকা একটি বসবাসের অযোগ্য অথচ ব্যয়বহুল শহর। সেই শহর উন্নত করার জন্য ডজন ডজন প্রকল্প থাকলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //