বর্ষবরণের বলি প্রকৃতি

মানুষের আনন্দে আতঙ্কিত প্রাণিকুল

কোটি কোটি টাকার বাজি পুড়িয়ে আর ফানুস উড়িয়ে ইংরেজি বর্ষবরণ উদযাপন করেছে গোটা দেশ। পুলিশের পক্ষ থেকে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও থামানো যায়নি শব্দ দানবের দৌরাত্ম্য। উৎসব-আনন্দ ঘিরে আতশবাজি পোড়ানো যেন এখন নীরব সম্মতি। প্রবল শব্দের সঙ্গে রাতের অন্ধকার ভেদ করে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে আলোর রোশনাই। অপূর্ব সেই দৃশ্যে বিমোহিত হয়, উল্লাসে ফেটে পড়ে সব বয়সীরাই।

অথচ আলোর উৎসবে মানুষের কয়েক মুহূর্তের নিছক আনন্দের বলি হতে হয় প্রকৃতিকেই। তার প্রমাণ আরেকবার মিলল রাজধানী ঢাকায়। বছরের প্রথম প্রহরে ফোটানো শব্দ আর উড়িয়ে দেওয়া আগুন থেকে বাঁচতে ঘুমন্ত পাখিরা নীড় ছেড়ে ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়িতে। সঙ্গী কেবল ভয় আর আতঙ্ক, আর্তচিৎকারে চলে ছুটাছুটি। প্রাণি বিশেষজ্ঞদের দাবি, শব্দবাজির জেরে বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে পাখি। হারাতে পারে দৃষ্টিশক্তি। হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে কুকুর-বিড়াল। নির্বংশ হওয়ার শঙ্কায় শুয়ো পোকার বংশও।

রসায়নবিদরা বলছেন, বাজি-পটকার মধ্যে থাকে সহজদাহ্য মিশ্রণ, যা বাতাসের সাহায্য ছাড়াই জ্বলতে পারে। এ জন্য মূলত ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম ক্লোরেট বা নাইট্রেট অথবা সোডিয়াম নাইট্রেট। এ ছাড়া দাহ্যপদার্থ হিসেবে থাকে কাঠ-কয়লার গুঁড়া, সালফার বা গন্ধক। আগুন লাগলে পটাশিয়াম ক্লোরেট থেকে প্রচুর অক্সিজেন বেরিয়ে আসে। আর তারই সাহায্যে অন্য পদার্থগুলো জ্বলতে থাকে। একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ও ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়। দেশে তৈরি বাজিতে ক্ষতিকর এসব উপাদান আরও বেশি থাকে।

মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে আতশবাজির ভয়াবহতা। সেখানে বলা হয়েছে- বাজির কণাগুলো ধাতুর লবণের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শুধু যে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে তা নয়, এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে চিহ্নিত কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন-ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনযুক্ত গ্যাস তৈরি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলোর অন্যতম এই প্রক্রিয়া। তাছাড়া ধাতুযুক্ত এসব কণা এবং গ্যাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে খুব দ্রুতই ফুসফুস ও রক্তে মিশে যেতে পারে। তাতে ঘটতে পারে তাৎক্ষণিক বা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক প্রতিক্রিয়া। আর জনবহুল রাজধানীতে ফানুস ওড়ানো মানেই আগুন নিয়ে খেলা। শুধু তাই নয়, ফানুসের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত সুতা ও বাঁশের ফ্রেমও যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদ। আকাশে উড়তে থাকা অনেক পাখিরই এতে আটকে মৃত্যু হয়।

পুরো শহরই কেঁপে উঠেছিল : ঢাকায় আতশবাজির দূষণ ধরা পড়েছে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায়। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বছরের অন্য দিনগুলোর তুলনায় ৩১ ডিসেম্বর রাতের ঢাকা বায়ু ও শব্দদূষণে সব রেকর্ডকেই ছাড়িয়ে যায়। এ সময় বায়ুমান পৌঁছায় ৫০০ একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পর্যন্ত, যা মানুষের সহ্য ক্ষমতার ৯ গুণ বেশি। একই চিত্র দেখা যায় শব্দের ক্ষেত্রেও। গত ৩০ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত যেখানে শব্দমান পাওয়া যায় ৩০ ডেসিবল পর্যন্ত, সেখানে থার্টিফাস্ট নাইটের একই সময়ে গিয়ে উঠে ১১০ ডেসিবল। একজন মানুষকে যা বধির করে দেওয়ার শক্তি রাখে। মারাত্মক এই দূষণের পেছনে নতুন বছর উদযাপনে ফোটানো আতশবাজির অবদান বলে মনে করেন ক্যাপস প্রধান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক বলেন, ‘শুকনো মৌসুমে ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলাবালির কারণে এমনিতেই বাতাসের মান খারাপ থাকে। এর মধ্যে আতশবাজি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘থার্টিফাস্ট নাইটে ১১টা থেকে ১টার মধ্যে শোরগোলের পরিমাণ বাড়ে ১১৩ শতাংশ। এবার অবশ্য রাত ১০টার পর থেকেই আতশবাজি ফোটানো শুরু হয়। রাত ১১টা পর্যন্ত চারদিক থেকে মুহুর্মুহু শব্দ শুনেছেন ঢাকার মানুষ। আর ১২টার দিকে পুরো শহরই কেঁপে কেঁপে উঠেছিল সেদিন। অতিরিক্ত এমন শব্দদূষণে বধির হতে পারে মানুষ। গর্ভস্থ ভ্রুণের ক্ষেত্রেও আতশবাজি ক্ষতি করতে পারে। গভীর রাতে হঠাৎ এই বিকট শব্দ মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠতে পারে ঘুমিয়ে থাকা প্রাণিদের।’ 

দিক হারায় প্রাণিকুল : বর্ষবরণ উদযাপন চলাকালীন একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে। তাতে দেখা যায়, আতশবাজির শব্দে একদল পাখি মানুষের ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছে। আর বাইরে যখনই আতশবাজির বিকট শব্দ হচ্ছে, পাখিগুলোর অস্থিরতাও বেড়ে যাচ্ছে। সেই ভিডিওধারণকারী রুহি আশরাফ বলেন, ‘থার্টিফার্স্ট নাইটে চারদিকে আতশবাজির শব্দ আর আগুনের ফুলকি। ফানুস উড়ে এসে পড়ছে গাছের ওপর। আতশবাজির আগুন ছিটকে পড়ছে পাতায় পাতায়। ভয়ে-আতঙ্কে গাছে থাকা পাখিগুলো ছুটছিল আর চিৎকার করছিল। তখন আমার ড্রয়িংরুমের জানালা খোলা ছিল। মুহূর্তেই দলবেঁধে সেই রুমে ঢুকে পড়ে বেশকিছু চড়ুই। বাসার সিঁড়িতেও অনেক পাখি আশ্রয় নিয়েছিল। আতশবাজির মুহুর্মুহু শব্দে অবলা পাখিগুলো যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। আসলে আমাদের উৎসবগুলো ততক্ষণই আনন্দের; যতক্ষণ না সেটা অন্যের ভয়, দুঃখ, আতঙ্কের কারণ না হয়ে যায়।’

গত বছরও ইংরেজি নববর্ষে আতশবাজি ফাটানোর ফলে ইতালির রোমে শত শত পাখির মৃত্যু ঘটে। পরিবেশবাদীদের ধারণা, পাখিগুলো মূলত বিকট শব্দে হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল।

এবারের বর্ষবরণের রাতে নিজের শিশু সন্তানকে নিয়ে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন বাবা ইউসুফ রায়হান। ফেসবুকে লেখেন, ‘কী বিকট শব্দ! আমার ছোট বাচ্চাটি এমনিতে হার্টের রোগী। আতশবাজির প্রচণ্ড শব্দে বাচ্চাটি আমার ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে। খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। খুব আতঙ্কে রাত পার করছি।’ পরদিন হাসপাতালের নেওয়ার পর ছেলেটি মারা যায়। যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইউসুফ বলেন, ‘বর্ষবরণের রাতে আতশবাজির বিকট শব্দের ভয়ে ছেলেটা বারবার কেঁপে উঠছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। সকাল থেকে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। চিকিৎসকরা বলেছেন, আমার ছেলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে।’

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসা তথ্যানুযায়ী, শব্দ ও আলোক দূষণ যে কেবল মানবদেহেই প্রভাব ফেলে তা নয়, এর গভীর প্রভাব পড়ে অন্যান্য প্রাণি ও পক্ষীকুলের ওপরেও। কুকুরের শ্রবণক্ষমতা মানুষের প্রায় পাঁচ গুণ। মানুষের কাছে যা খুব ফিসফিস করা শব্দ, প্রাণিটির কাছে তা যেন হাজার ওয়াটের সাউন্ডসিস্টেম বাজানো। তাতেই পরিষ্কার হয়ে যায়, ৯০ ডেসিবেলের শব্দবাজি কুকুরের কাছে কতটা যন্ত্রণাদায়ক। 

আগুনের খেলায় পুড়লো দেশ : থার্টিফার্স্ট নাইট বা ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন ঘিরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে পটকা বা আতশবাজি ফোটানোয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা অমান্য করেই পুরনো বছর বিদায় ও নতুনকে বরণ করতে উন্মদনায় মাতে নগরবাসী। আনন্দঘন এই রাত কারো কারো জন্য পরিণত হয় বিষাদেও। সারাদেশ থেকে প্রায় ২০০টি অগ্নিকাণ্ডের খবর আসে ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোলরুমে। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, এসব অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগই ঘটেছে উৎসবে উড়ানো ফানুসের ছিটকে পড়া আগুন থেকে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে তিনতলা ভবনের অগ্নিকাণ্ড ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। কয়েকটি জায়গায় আতশবাজির কারণেও আগুন লাগে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (ঢাকা) দিলমনি শর্মা বলেন, ‘রাতে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলেছে। ভবনগুলোর ছাদে মালামাল কিংবা ছোট টিনশেডের ঘরে বাগান করার কারণে ফানুসের আগুন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। রাতে কয়েকটি জায়গায় একযোগে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে নেভায়। আমাদের সৌভাগ্য যে, কোনো বস্তিতে আগুন লাগেনি। তাহলে ক্ষয়ক্ষতি হতো ভয়াবহ। তাই এমন উদযাপনে কঠোরভাবে ফানুস উড়ানো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।’ 

থার্টিফাস্ট নাইটে নির্দেশনা না মেনে রাজধানীবাসীর অনিয়ন্ত্রিত উদযাপন নিয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আতশবাজি থামানোর বিষয় নয়। হাত দিয়ে আটকে রাখা যায় না। ঘরে ঘরে গিয়েও নিষেধ করতে পারব না। আমরা অনুরোধ করেছিলাম বয়স্ক মানুষ, শিশু ও অসুস্থ মানুষের কথা বিবেচনা করে এটি সীমিত রাখার।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ধীর পদক্ষেপে মানবসভ্যতার দিকে এগিয়ে আসছে জলবায়ু পরিবর্তনের মহাবিপর্যয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইডসহ গ্রিনহাউস গ্যাস বেড়েই চলেছে। উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠছে পৃথিবী। গলছে দুই মেরুর বরফ। বাড়ছে সমুদ্রতলের উচ্চতা। তলিয়ে যাচ্ছে বহু নিম্নভূমি। এমন পরিস্থিতিতে কেবল মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের বাজি পুড়িয়ে উৎসবে মাতে মানুষ। এ যেন ধ্বংসকেই আলিঙ্গন করা।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //