মশিউর রহমান আকাশ
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২১, ০৯:০৭ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২১, ০৯:১০ এএম
নূর হোসেন শহীদ হন ১৯৮৭ এর ১০ নভেম্বর। বুকে লেখা ছিলো- স্বৈরাচার নিপাত যাক, পিঠে লেখা ছিলো- গণতন্ত্র মুক্তি পাক। ১৯৮৭ সালের এই দিনে তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে মিছিলের পুরোভাগে থাকা নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। স্থানটি গুলিস্তান জিরোপয়েন্ট এলাকা, যা এখন নূর হোসেন চত্বর নামে পরিচিত।
নূর হোসেনের জন্ম ১৯৬১ সালে। পৈতৃক বাড়ি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া। জীবিকার সন্ধানে তাঁর গোটা পরিবার এসেছিল ঢাকায়। থাকতেন রাজধানীর পুরনো ঢাকার বনগ্রামে। বাবা মজিবুর রহমান পেশায় বেবিট্যাক্সি চালক। মা মরিয়ম বেগম গৃহিণী। নূর হোসেন নিজেও ছিলেন একজন পরিবহন শ্রমিক।
১৯৮৭ এর ১০ নভেম্বর ছিলো ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি। নূর হোসেনের প্রতিবাদী মন সম্পর্কে পরিবারের সবার জানা ছিলো। পরিবারের দিক থেকে বারণ ছিলো যাতে নূর হোসেন মিছিলে না যান। রাস্তায় অনেক ঝামেলা হতে পারে ভেবেই এই বারণ ছিলো।
তবুও নূর হোসেন মিছিলে গেলেন। আগের দিনই ইকরাম নামে এক সাইনবোর্ড লেখকের কাছে গিয়ে নিজের শরীরকে পোস্টারে পরিণত করেছিলেন। লেখার সময়ই নূর হোসেনকে ইকরাম সতর্ক করে বলেছিলেন যে- “এ কাজের অর্থ হলো নিশ্চিত কারাগারে যাওয়া। সেই সাথে তাঁর নিজেরও বিপদে পড়া”।
প্রথমে না করলেও পরে নাছোড়বান্দা নূর হোসেনের পীড়াপীড়িতে তিনি তাঁর শরীরে শ্লোগান লিখে দেন। মুহূর্তেই তৈরি হয়ে যায় এক অন্য নূর হোসেন, যে নূর হোসেন অচেনা হয়ে যান শিল্পী ইকরামের কাছে, এমন কি নিজের কাছেও। নয় তারিখ রাতে এই পোস্টার লেখা থেকে পরের দিন ১০ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত সেই শ্লোগান ধ্বনিত হতে থাকে নূর হোসেনের শরীরের কোষে কোষে, ঘুম কিংবা ঘুমহীনতার ঘোর আর স্বপ্নের প্রতিটি অলিন্দে।
পায়ে কেডস। পরনে জিন্সপ্যান্ট। গায়ের শার্ট কোমড়ে বাঁধা। খালি গায়ে বুকে পিঠে লেখা স্বৈরাচার নিপাত এবং গণতন্ত্র মুক্তির শ্লোগান। গোটা শরীরটাই যেন একটা ত্রিমাত্রিক পোস্টার। ১০ তারিখ ভোরে শহরের প্রথম আলোয় ঝলসে উঠেন নূর হোসেন। সূর্যের সব আলো প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর বুকে পিঠে। এতটা বোধ হয় স্বৈরাচারের দূষিত আত্মা নিতে পারেনি। তার ভণ্ড স্বৈরসত্তা কোথাও তার প্রেতপূজার দীপ নিভে যাওয়ার আভাস পেয়েছিল। তাই নির্মম বুলেট ছুটে আসে নূর হোসেনের দিকে।
নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন। কবি শামসুর রাহমান যেমনটি লিখেছেন তাঁর কবিতায়, “ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়”। মরণ যন্ত্রণায় যখন নূর হোসেন ছটফট করছিলেন তখন এক যুবক তাঁকে একটি রিকশায় করে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলেন। নূর হোসেনকে বহনকারী রিকশাটিকে পুলিশ চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেয় তারা। তিনি যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন, তখন একজন নিষ্ঠুর পুলিশ সদস্য পায়ের বুট দিয়ে তার বুক চেপে ধরে। স্বৈরাচারের পুলিশেরা এতটাই নিষ্ঠুর ছিলো।
এরপর মিছিলের সাথীরা কিংবা স্বজনরা নূর হোসেনের খোঁজ আর পায়নি। বিনা চিকিৎসায় যন্ত্রণাময় এক মহৎ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেন গণতন্ত্রের এই সাহসী বীর।
দুপুরের দিকেই স্বজনরা বিভিন্ন দিক থেকে খবর পান যে নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নূর হোসেনের বোন শাহানার ভাষ্য মতে, সন্ধ্যায় বিবিসির খবর শুনে তারা নিশ্চিত হন যে নূর হোসেন শহীদ হয়েছেন। আরো পরে পত্রিকার খবর থেকে স্বজনরা জানতে পারেন যে জুরাইন কবরস্থানে তাঁর কবর হয়েছে। এ খবর শুনে স্বজনরা ছুটে যান জুরাইনে। কবরস্থানের কর্মীরা বলেন, এখানে তিনজনের নতুন কবর হয়েছে। তিনজনের মধ্যে একজনের মুখে দাঁড়ি, পায়ে কেডস জুতা, পরনে প্যান্ট, খালি গা এবং বুকে-পিঠে কী যেন লেখা ছিলো। এসব বর্ণনা থেকে স্বজনরা আন্দাজ করে নেন কোনটা নূর হোসেনের কবর।
১০ নভেম্বরের আগের দুদিন নূর হোসেন ঘরে ফেরেন নি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তাঁর সক্রিয়তা সবসময়ই ছিলো। কিন্তু ১০ নভেম্বর নিয়ে পিতা-মাতার মনে ভয় ছিলো। তাই নূর হোসেনের কাছে মিছিলে না যাওয়ার অনুরোধ ছিলো বাবা মায়ের দিক থেকে।
১০ নভেম্বর ভোরের আলো ভালোভাবে ফুটে উঠার আগেই মা-বাবা ছেলের খোঁজে বের হলেন। হাজির হন মতিঝিলের নির্মাণাধীন ডিআইটি (রাজউক) মসজিদের একটি কক্ষে। সেখানে গিয়ে দেখেন নূর হোসেন খালি গায়ে শুয়ে আছে। সাথে আছে তার এক বন্ধু।
মা-বাবাকে দেখেই তিনি তড়িঘড়ি করে চাদর দিয়ে গা ঢেকে ফেলেন। মা কিন্তু বুকে পিঠের লেখা দেখে ফেলেন। পৃথিবীতে ছেলের জীবন্ত পোস্টার হয়ে যাওয়া দেখেছেন এমন মা বোধ হয় একজনই। তিনি নূর হোসেনের মা। দারিদ্রের কারণে হয়তো ছোটবেলায় ছেলেকে একটা শার্ট সবসময় কিনে দিতে পারেন নি। মায়াবী হাত বুলিয়ে দিয়েছেন ছেলের উদোম গায়ে। আজ এই বুক-পিঠ পোস্টার হয়ে যাওয়া ছেলের দিকে এক অবাক নতুন দৃষ্টি নিয়ে তাকান মা। মায়ের ভালবাসার হাত সন্তানের পিঠ ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে যায় পিঠে লেখা শব্দ ‘গণতন্ত্র’কে।
মায়ের মনে এক বুড়িগঙ্গা দুশ্চিন্তা শুরু হয়। মা বলেন, চল বাসায় চল। নূর হোসেন অতল অটল থাকলেন। বাবা- মাকে বললেন, “আপনারা যান। আমি আসতেছি”। সেটাই ছিলো শেষ দেখা।
১৯৯৬ সালে এরশাদ নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য জাতীয় সংসদে অফিসিয়ালভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তার দল জাতীয় পার্টি ১০ নভেম্বরকে “গণতন্ত্র দিবস” হিসেবে পালন করে।
ক্ষমতার বিবিধ সমীকরণ মেলাতে গিয়ে আমাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিবিদরা স্বৈরাচারকে পুনর্বাসিত করে বসে আছেন। এটা নূর হোসেনের আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
স্বৈরাচার এরশাদ নূর হোসেনের জন্য মায়াকান্না কেঁদেছেন। বলেছেন, জেল থেকে বের হয়ে তিনি নূর হোসেনের পরিবারের খোঁজে গিয়েছেন। কিন্তু ১৯৮৭ সালে যখন ‘দ্য নিউ নেশন’ পত্রিকায় নূর হোসেনের ‘পোস্টার-শরীর’ এর ছবি ছাপা হয় তখন চিত্রগ্রাহক পাভেল রহমানকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল দিনের পর দিন, এরশাদের গোয়েন্দা বাহিনীর তাড়া খেয়ে। এরশাদের প্রশাসন প্রচার করার চেষ্টা করেছিল যে ছবিটি বানোয়াট। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বরের পর টানা তিন বছর পালিয়ে থাকতে হয়েছিল নূর হোসেনের শরীরের পোস্টার লেখক ইকরামকে।
এরশাদ এবং তাঁর অনুসারীরা বার বার নূর হোসেনকে হত্যার চেষ্টা করেছে তাঁর মৃত্যুর পরও। ভবিষ্যতে হয়তো আরো চেষ্টা করে যাবে। কিন্তু তারা সফল হবে না।
নূর হোসেনকে যখন জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় তখন কেরোসিন দিয়ে তারা তাঁর শরীর থেকে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” এই শ্লোগান তুলে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা তা মুছে ফেলতে পারেনি। নূর হোসেন তাঁর শ্লোগানকে নিয়েই কবরে গেছেন। গণতন্ত্রকে বুকে ধারণ করে যার শেষ যাত্রা, তিনি অমর অক্ষয়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : শহীদ নূর হোসেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh