সরকারি হাসপাতালগুলোতে সক্রিয় অপরাধী চক্র

অবাঞ্ছিতের অনুপ্রবেশ ও দুষ্কৃতকারীদের অবাধ দৌরাত্ম্য, ভবঘুরেদের নিরাপদ আস্তানা, দিনের বেলাতেও নাকে আসে গাঁজার উৎকট গন্ধ আর বেআইনি দোকান বসিয়ে রাতের আঁধারে বিক্রি হয় নেশার দ্রব্য।

হাত বাড়ালেই মিলে ইয়াবা, ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিনসহ বিভিন্ন মাদক। আর এসব ঘিরে সন্ধ্যার পরই এদিক-ওদিক বসে যায় মদ-জুয়ার আসর। চলে অসামাজিক কাজকর্মও। হইহল্লা, মারামারি, লুটপাট, চুরি-ছিনতাই, শ্লীলতাহানির মতো অপরাধ তো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিত্যচিত্র। রোগী, স্বজন ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে তাই নানা প্রশ্ন। এসব সমস্যা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কথাবার্তায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে অসহায়ত্বের চিত্র। তারাও যে আজ আতঙ্কিত।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই হোক বা জেনারেল, কিংবা মফস্বলের সরকারি হাসপাতাল- ক্রমশই হয়ে উঠছে দুষ্কৃতকারীদের মুক্তাঞ্চল। পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের বাইরে থাকায় মূলত হাসপাতালকে নিরাপদ জোন হিসেবে বেছে নিয়েছে অপরাধ চক্রের সদস্যরা। ভয়ে কেউই মুখ খোলেন না। কখনো ধরা পড়লেও অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যায়; ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের হাসপাতাল ইউনিট নেতা এবং হাসপাতালের কর্মচারী নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালে ঘুরে বেড়ায় চক্রের অপরিচিত সদস্যরা। কখনো এরা নিজেকে হাসপাতালের কর্মী বলে পরিচয় দেয়, কখনো বা বলে তাদের রোগী কোন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক আনসার সদস্যের সঙ্গে অপরিচিত এক যুবকের ঝগড়া হয়। এর সূত্রপাত যখন ওই যুবককে নারী ওয়ার্ডে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। জোর গলায় তখন ওই যুবক জানায়, সে হাসপাতালের কর্মী। তখন দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য হাসপাতালের কয়েকজন কর্মীকে ডেকে আনেন এবং তারা এলে যুবকটি কথা পাল্টায়।

জানায়, তার এক আত্মীয় নাকি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে খবর নিয়ে জানা যায়, সেটাও মিথ্যা। এরপর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ভয় দেখালে সে ক্ষমা চেয়ে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনা আরও অনেক হয়েছে, তবে সবক্ষেত্রে এভাবে আটক করে যাচাইয়ের সুযোগ বা সময় হয়ে ওঠে না। 

নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালের ভেতরে চুরির ঘটনা নিয়ে অতীতে অনেক অভিযোগ এসেছে। বেশ কয়েকবার হাসপাতাল চত্বরে হানা দেওয়া হয়েছে। সব সময় অপরিচিতদের বেরিয়ে যেতে বলা হয়। তবে এই হাসপাতালে হাজার হাজার রোগী আসেন। সঙ্গে তার থেকে বেশিসংখ্যক আসেন পরিবারের সদস্য। তাই সন্দেহ করে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয় না। সিসি ক্যামেরা বসিয়েও লাভ হয়নি।

কিছু দিন আগে হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে জামালপুর থেকে এসে কুলসুমা বেগম ভর্তি হয়েছিলেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। নারী ওয়ার্ডে থাকা যাবে না বলে রাতে বাইরে ছিলেন তার স্বামী লালু মিয়া ও ভাই আবুল কাশেম। হাসপাতালের সামনে এক ব্যক্তি আলাপ জমিয়ে চা খেতে দেন তাদেরকে। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড ঘুম পায়। সকালে উঠে দেখেন, সঙ্গে থাকা মোবাইল ও টাকা-পয়সা উধাও। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় বিপুলসংখ্যক রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়। এ সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স, ট্রলি, রোগী ভাগানো, বাইরে টেস্ট করানো, আইসিইউ, রক্ত বাণিজ্য, মোবাইল চোর, জাল মেডিকেল সার্টিফিকেট ও মাদক সিন্ডিকেট উল্লেখযোগ্য। এসব চক্রে রয়েছে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় থেকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও। 

কেবল ঢামেকেই চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে রোগী ও তার স্বজনদের কাছ থেকে ছিনতাই ও প্রতারণার অর্ধশতাধিক ঘটনা ঘটেছে। ২৬ অক্টোবর গভীররাতে রোগী মিতা আক্তার, স্বামী মামুন ও ননদ খুশি আক্তার এবং রোগী শাহিনুর বেগম ও স্বামী আবু বক্কর সিদ্দিককে অচেতন করে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় নারী চোরচক্র। মিতা ও শাহিনুর হাসপাতালের গাইনি ২১২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্বজনরাও।

ভুক্তভোগীরা জানান, ওই রাতে অচেনা এক নারী এসে তাদের সঙ্গে প্রথমে ভাব জমায়। কিছুক্ষণ পর জুস ও কেক নিয়ে এসে বলেন- আমার মা পাঠিয়েছেন। আপনাদের খেতেই হবে। অনেক অনুরোধ করায় জুস পান করেন; কিন্তু কৌশলে যে জুসের সঙ্গে নেশা জাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ঘূণাক্ষরেও টের পাননি মিতারা।

এ বিষয়ে ওয়ার্ড মাস্টার আবু সাঈদ জানান, হাসপাতালের রোগী ও স্বজনদের এভাবে অচেতন করে সব কিছু হাতিয়ে নেওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। গত ১১ অক্টোবর সকালে হাসপাতালের ২০০ নম্বর ওয়ার্ডে এক রোগীর মোবাইল চুরি করে পালানোর সময় পিন্টু নামে এক যুবককে আটক করেন আনসার সদস্যরা। তাকে এর আগেও কয়েকবার মোবাইল চুরির অপরাধে আটক করা হয়েছিল বলে জানান আনসারের ঢামেক হাসপাতাল প্লাটুন কমান্ডার শাহ আলম। 

আনসার প্লাটুন কমান্ডার বিল্লাল হোসেন জানান, বছরখানেক ধরে ইয়ামিন ও জিদনী ঢামেকের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কৌশলে স্বজন সেজে রোগীদের টাকা ও দামি মোবাইল চুরি করছে বলে স্বীকার করেছে। এ ঘটনার কিছু দিন আগেই হাসপাতালের ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় মরিয়ম বেগম নামে এক নারীকে অচেতন করে তার কানের দুল ও গলার চেইন চুরি করে নিয়ে যায় চোরচক্রটি। এ ছাড়াও ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের অষ্টম তলা থেকে গত ৫ জুলাই দুপুরে রোগীর মানিব্যাগ চুরির অভিযোগে জুয়েল নামে এক যুবককে আটক করেন আনসার সদস্যরা। 

এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে রোগী ও স্বজনদের মালামাল খোয়ানোর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব অপরাধীর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর রয়েছে পুলিশ; কিন্তু এ হাসপাতালে বেশির ভাগ রোগীই ঢাকার বাইরে থেকে আসেন। সময় কাটাতে অপরিচিত লোকদের সঙ্গে তারা বা তাদের স্বজনরা মিশে যান। আর এ সুযোগটিই নেয় চক্রের সদস্যরা। কৌশলে রোগী ও স্বজনদের অজ্ঞান করে মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়। 

এ দিকে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলেই চোখে পড়বে, নতুন রোগী দেখলেই স্বজনের মতো ছুটে কিছু নারী-পুরুষ। এদের কারও উদ্দেশ্য কোনো ঝামেলা ছাড়াই চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, কেউ সিরিয়াল ভেঙে বিভিন্ন পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়, কেউবা কম খরচে চিকিৎসার কথা বলে হাসপাতাল থেকে রোগীদের পাশের প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে আবার অনেকে আছেন, যারা হাসপাতালের ওয়ার্ডে ও কেবিনে রোগী ভর্তির জন্য তদবির করেন। হৃদরোগ থেকে স্নায়ুরোগ, নানা বিভাগে ভর্তির নামে হাজার হাজার টাকা আদায় করে এরা। রক্ত কেনা-বেচার দালালিও করেন কেউ কেউ।

রোগীর স্বজনরা দাবি করেন, দালালের সমস্যা হাসপাতালগুলোতে আগেও ছিল। এখন যুক্ত হয়েছে প্রতারকের দাপাদাপি। তাদের খপ্পরে পড়ে রোগী বা তার পরিজনেরা সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। ঢাকার দোহার থেকে সম্প্রতি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে এই চক্রের খপ্পরে পড়েন মরিয়ম আক্তার।

ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এই নারী জানান, হাসপাতালের ২ নম্বর ভবনের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করেন তিনি। ভেতরে যাওয়ার আগেই এক ব্যক্তি তাকে ঘিরে ধরেন। হাত থেকে টিকিটটি নিয়ে চুপিসারে মরিয়মকে বলেন, লাইনে দাঁড়াতে হবে না। সহজেই চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। বিনিময়ে ২০০ টাকা দিতে হবে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার চেয়ে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নিতে পারবেন ভেবে রাজিও হয়ে যান। কিন্তু টাকাটা হাতে পাওয়ার পর হঠাৎ লাপাত্তা ওই ব্যক্তি। 

ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, ‘এক ধরনের লোক আছে যারা এগুলো করেই জীবিকা নির্বাহ করে। তবে যখনই এ ধরনের বিষয় আমাদের নজরে আসে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেই। শুধু দালাল চক্রের সদস্য না হাসপাতালে প্রচুর চোরও রয়েছে। প্রায়ই তারা আনসার সদস্যের হাতে ধরা পড়ছে; কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই জেল থেকে বের হয়ে ওই চোরচক্রের সদস্যরা আবারও চুরিতে নামে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //