পরীমণিকে নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর

বর্তমান সময়ের আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমণিকে গাড়ি উপহার দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিনকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর বিষয়টি নজরে আসলে সংবাদটিকে মিথ্যাচার বলে দাবি করেন মাসরুর আরেফিন।

আবারো এই সব ইস্যু নিয়ে সব উত্তর দিয়েছেন মাসরুর। নিজের ফেসুবকে গতকাল মঙ্গলবার রাতে পরীমণি ইস্যু দ্বিতীয় পোস্ট দেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকালের পাঠকদের উদ্দেশে মাসরুর আরেফিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল -

অনেকেই আমাকে ফোন করে বলছেন, আমি যেহেতু ঝামেলায় আছি, আমার কোনো সাহায্য লাগলে আমি তার বা তাদের সাহায্য নিতে পারি। মানুষের এই মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ। কিন্তু ধন্যবাদ - আমি কোনো ঝামেলায় নেই। আমাকে ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠানো, ফোনে সহায়তার হাত বাড়ানো - হ্যাঁ, আমি আপনার মানবিক বোধটুকুর প্রশংসা করি। কিন্তু না, আপনি ভুল বুঝছেন যে আমি ঝামেলায় আছি।

এটাকে অ্যারোগেন্স হিসেবে নেবেন না। এটাই বাস্তব। যে-জিনিসের সঙ্গে আমার সামান্যতম যোগাযোগ নেই, সেই জিনিস নিয়ে আমার নামে খবর বের হওয়া আমার কাছে একটা শূন্য, একটা লাড্ডু, একটা ফক্কা, একটা বিগ জিরো, একটা বিগ নাথিং।

অতএব আমি মন দিয়ে অফিস করছি, প্লেনে পড়তে পড়তে আসা এডওয়ার্ড সাঈদের ‘হিউম্যানিজম অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক ক্রিটিসিজম’ বইটা শেষ করছি, জেট ল্যাগে কিছুটা ভুগছি, উপন্যাস ‘আড়িয়াল খাঁ’ নিয়ে বসব বসব করছি, আর বন্ধু কথাসাহিত্যিক মশিউল আলমের জন্য ফিওদর দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে লেখাটার প্রথমদিকের পাতাগুলি লিখেও ছিঁড়ছি আর ছিঁড়ছি।

এরই মধ্যে আমার শেষ পোস্টটা নিয়ে বেশ কিছু জিনিস পড়লাম ফেসবুকে (এখন ওসব পড়া পুরো বন্ধ করেছি যদিও)। জিনিসগুলো ভাবালো। যেমন:
১. আমি কী করে পরীমনিকে চিনি না, বা ‘বোট ক্লাব’ কাণ্ডের আগে কী করে আমি তার নামও শুনিনি?—শুনুন, আমি ঢঙ করে কথা বা ন্যাকামি ভরা ভালো-ভালো-লক্ষ্মী-লক্ষ্মী কথা বলার ধারে কাছের কোনো ক্যারেক্টার না। আমি তার নাম শুনিনি, তো আমি তার নাম শুনিনি। ব্যস। আমরা শাবানা-ববিতা-কবরী ছাড়িয়ে শেষমেশ শমী কায়সার-বিপাশা হায়াত পর্যন্ত ফলো করে হাঁপিয়ে যাওয়া জেনারেশন। এভাবে বাংলা রূপালী পর্দার সঙ্গে আমরা বহুদিন মোটামুটি সংযোগবিহীন। মাঝে নন-কমার্শিয়াল ভাল বাংলা ছবি যে কটা হয়েছে, তার সবই দেখেছি। কিন্তু সেসবের মধ্যে পরীমনি অভিনীত কোনো ছবি পাইনি, তাই দেখিনি। আপনারা দেখেছেন, আপনাদের সে প্রিয় নায়িকা, আপনারা তাকে চেনেন—ভাল কথা। আমি দেখিনি, আমার চেনার সময় হয়নি, আমার চেনার মতো কোনো চলচ্চিত্রে তিনি আসেননি, তাই আমি চিনি না। কথা শেষ।

২. সোশ্যাল মিডিয়ার প্রশ্ন এটাও যে, পরীমনির মতো বড় নায়িকাকে যিনি চেনেন না, তিনি আবার কী করে ‘সাহিত্যিক‘ হন? মানে, তাহলে সমাজের পালসটা তিনি কী করে ধরতে পারেন?—দেখুন, সমাজ একটা বিরাট কড়াই। তাতে থানকুনি পাতা দিয়ে খলসে মাছের ঝোলের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব সম্পর্কিত আপনার বিশ্বাস, মসজিদ ও মন্দির সংক্রান্ত আপনার ভাবনা, বেগুনের কাঁটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া রিকশার স্পোক আর এই মুহূর্তে ডেন্টাল সার্জনের হাতে উঠে আসা আপনার দাঁত আর সেই হঠাৎ নেই-হয়ে-যাওয়া দাঁতের হু-হু করে ওঠা কান্না, সবটা, সবটা—মুদ্রাস্ফীতি-জিডিপি-মানইজ্জত-বার্থ কন্ট্রোল পিল-আর্মির ট্রাক-কোকিলের কুউউউইসহ সবটা—সেই কড়াইতে একসাথে রান্না হচ্ছে।

ওই বিশাল রান্নার কড়াইয়ে ফুটতে থাকা অতগুলো জিনিসের মধ্যে একটা মাত্র জিনিসের নাম ‘পরীমনি’। যাকে আপনি এ মুহূর্তে ‘দি পরীমনি ফেনোমেনন’-ও বলতে পারেন। মানে যার মধ্যে এই এখন আছে এক ব্যক্তি পরীমনির ওপর দিয়ে চলা সিস্টেমের গ্রাইন্ডিং মেশিনের গড়গড়গড়, যা এই এখন তাকে নিষ্ঠুরভাবে গুড়িয়ে-মাড়িয়ে-কেটে-চিড়ে-ছিঁড়ে দিচ্ছে। (এটাই হয়তো আপনার নৈতিকতার বিচারে ‘পরীমনি’ নামের এক চক্র বা বলয়ের লোভ ও লালসার যৌক্তিক পরিণতি।)

আবার ওই একই ‘পরীমনি’ ফেনোমেননের অন্যদিকে? অন্যদিকে আছে একগাদা জিভ-বের-করা, লোল-ফেলা, চকচকে বড় গাল ফুলিয়ে হাসতে থাকা কিছু লোক, যারা পরীমনিদের কাছে বেড়াতে গিয়ে কল রেকর্ডে ধরা, ভিডিওতে ধরা, এতে ধরা, তাতে ধরা। 

তো, লেখক হিসেবে ওই কড়াইয়ের ‘পরীমনি’ নামের তরকারিটুকু চিনতে আমার এই নির্দিষ্ট ‘পরীমনি‘-কেই চেনা বাধ্যতামূলক না। ওই তরকারি মানবসভ্যতার প্রথম থেকেই কড়াইতে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা এক তরকারি, স্বাদে যা চকলেটের খসখসে খোসার মতো, আবার ডালিম-ডালিমও (‘গিলগামেশ’-এ এক রাজা ডালিম খেতে খেতে একজন পা-খোঁড়া প্রজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রজা, তোমার পায়ের অবস্থা কী?’ প্রজার উত্তর, ‘ডালিম-ডালিম।’—মানে রাজা মশাই, আমার পা-টা ভুজভুজ করছে, মানে বোমার মতো আপনার মুখ-গাল-ঘাড়-বুকজুড়ে ওটা ফেটেফুটে পড়বে।) 

সমাজের কড়াইয়ের নির্দিষ্ট ‘পরীমনি’ নামের ওই ডালিম-ডালিম স্বাদের তরকারি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। সেটা এই অর্থে যে, ওই ডালিমের স্বাদ নেওয়াটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়, আমি তা সম্মান করি। আমি নৈতিকতার পণ্ডিত না, সুবিধাবাদী মানুষের সুবিধামতো বানানো ভাল-মন্দের কোনো পতাকাবাহকও আমি না। 

এ ক্ষেত্রে কেবল এক জায়গায়ই সমস্যা আছে আমার, মানে যদি কথা ‘সত্যি’ হয়। সমস্যা এই যে, যারা ওই চক্রের হাতে পড়ে পরে ব্ল্যাকমেইলড্ হন, তারা যদি আবার রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম বা রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন হয়ে থাকেন, তাহলে সমূহ বিপদ। তাহলে বঞ্চিতের আরও বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা। এর বাইরে আর কোনো বিপদ দেখি না—এর বাইরে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওই ডালিমের সবটাই লাল, ওই তরকারির সবটাই তাজা স্বাদের। 

৩. আমার নিজের গাড়ি নেই? এটা কেমন কথা? এ কেমন ন্যাকামি? সিটি ব্যাংক এমডির গাড়ি নেই?—ভাই ও বোনেরা, আমি মাইক্রোফোনে মুখ রেখে বলছি যে, আমার নিজের কোনো গাড়ি নেই। কথাটা আমাদের অনেক ব্যাংক এমডির জন্যই সত্য। ‘ব্যাংক এমডি’ শব্দ দুটো এদেশে হয়ে গেছে একটা গালি। এখন কোনো ব্যাংক এমডি যে আর্থিকভাবে সৎ মানুষ হতে পারেন, তা অবিশ্বাসযোগ্য এক বিষয়। কথা অবশ্য সেটা না। কথা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো সাধারণত: একটা লেভেলের পর থেকে ফুলটাইম গাড়ি দেয় ড্রাইভার-তেল ইত্যাদিসহ। তাই গাড়ি কেনার আমার প্রয়োজন হয়নি। সে কারণেই বললাম, বেশ কজন এমডিরই নিজের গাড়ি নেই।

নির্দিষ্ট করে সিটি ব্যাংক ডিএমডি হবার পর থেকে আপনাকে দেয় দুটো করে গাড়ি—একটা ডিএমডির নিজের চলার জন্য, একটা তার পরিবারের জন্য। এমডিরও তাই। অতএব আমার নিজের গাড়ি নেই। আর ভুলে যাবেন না আমি কথাটা কেন লিখেছিলাম? লিখেছিলাম এটাই বলতে যে, নিজের জন্য আজও একটা টয়োটা বা মারুতি কিনলাম না, আর আমি কিনা অন্য একজনকে পকেটের টাকা দিয়ে একবারে ৩ কোটি টাকার ‘মাসেরাতি’ কিনে দিলাম?

৪. এটা ওনার কোন্ ধরনের ন্যাকামি যে উনি বলছেন চাকরি জীবনের শেষে ব্যাংক থেকে ‘কার লোন’ নিয়ে উনি গাড়ি কিনবেন?—আপনি আমার এ কথায় বিশ্বাস করলেন কি করলেন না, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা আমার অবস্থা, আপনার না। মোটামুটি ভাল একটা গাড়ির দাম আমার জানা আছে। আমি নিজেই ব্যাংকার হিসেবে ‘কার লোন‘-এর ব্যবসা করি। অতএব যা বলেছি, জেনেই বলেছি। আমার বেতন ‘বড়’ হতে পারে, বাংলাদেশের বিচারে তা ‘বড়’-ও বটে। আবার খরচও তেমনই বড়, ইনকাম ট্যাক্সও তেমনই বড়, জীবনে নেওয়া লোনগুলির কিস্তি তেমনই বড়, সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসার কারণে দায়িত্ববোধের অন্য জায়গার অন্য খরচও তেমনই বড়। ‘ব্যাংক এমডিরা সব চোর’—ঢালাওভাবে এ কথা যেমন আপনার কথা, আপনার মনের অসুখ; তেমন ‘ব্যাংক এমডিরা সব বড়লোক’—ঢালাওভাবে এ কথাও আপনার এক হিংসাশ্রয়ী দগদগে কল্পনা, এক রগরগে শ্রেণীঘৃণা (যা নিয়ে আমার কোনোই আপত্তি নেই, যেহেতু ওটা ন্যায্য ঘৃণা)।

৫. সবচেয়ে বেশি বিচারের শিকার আমি হলাম এর আগের এক ‘নারী কেলেঙ্কারী’-তে আমার নাম থাকার কারণে। অনেকেই ভাবলেন, বাহ্, এই লোকের নাম তো আগেও এক নারী সম্বন্ধে বাজারে এসেছিল, অতএব পরীমনিকে গাড়ি কিনে দেওয়ার বিষয়টা এই লোকের বেলায় সত্য। 

আপনারা যারা আগের খবর ফলো করেছিলেন (প্রায় তিন বছর আগের কথা), তাদের জন্য আমি কিছুই বললাম না, শুধু এই লেখার নিচে কমেন্ট বক্সে আমার পুরোনো এক লেখার লিঙ্ক দিয়ে দিলাম। পড়ে নেবেন।

সিটি ব্যাংকে চাকরি করে কেউ দেশের জাতীয় সংসদের মিথ্যা বিজনেস কার্ড নিয়ে ঘুরবে, ব্যাংকের পাশাপাশি নিজের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে ৪-৫টা ব্যবসা চালাবে (যার একটা আবার স্পষ্ট ‘চাকরি বাণিজ্য’— যেখানে পোস্টারের নিচে ব্যাংকিং কোচিং সেন্টারের যোগাযোগের ঠিকানায় থাকবে আপনার নিজের ইমেইল ঠিকানা) ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি, আর আমি ব্যাংক এমডি হয়ে কোনো ব্যবস্থা নেব না? আমি ব্যবস্থা নিতে একটুও দেরি করিনি। আর সেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া মাত্র আমি হয়ে গেছি ‘যৌন নির্যাতনকারী’। বাহ্। আমার সঙ্গে ‘ঘটা’ পরীমনি কাণ্ডের মতোই সেটা আরেক মহাকাণ্ড—এক সুতো প্রমাণ কিংবা একটা কারো কোনো সামান্যতম সাক্ষ্য বা সামান্যতম সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স ইত্যাদি কিছুর টুকরোটাও সেখানে নেই। অতএব রাষ্ট্রের আদালতে মামলাটা আমরা তিনজন ভিকটিম সেবার জিতেছিলাম।

এখন আপনারা বলছেন, এই লোকটার সাথেই এটা হয় কেন?

কী হয় কেন? আপনি কী করে জানেন যে ওই ঘটনাটা আমাকে নিয়ে হয়েছিল বলেই একদল লোক এবার ঠিক করেনি যে, এই ব্যাটার মাথাটাই পরীমনির গাড়ির মধ্যে ঠেসে ঢুকিয়ে দে, তাহলে লোকে খাবে? 

বুঝছেন হয় কেন? মানুষ এইসব ‘রিপিট’ ফর্মুলায় বিশ্বাস করে বলেই হয়। এটাই হিউম্যান সোসাইটি, এটাই দ্য গ্রেট-গ্র্যান্ড-টগবগিং অ্যাট দ্যা বয়েলিং অ্যান্ড বার্স্টিং পয়েন্ট—দি বিউটিফুল হিউম্যান কড়াই।

আর কথা না বাড়াই। যারা আমার গত পোস্টে সাহিত্যিকের অহংকার দেখেছেন, তাদেরকে বলি যে, আমি আমার বইটাকে ‘সেরা’ বলিনি, বলেছিলাম ‘অন্যতম সেরা’ বা ‘অন্যতম প্রধান’। কিন্তু সাহিত্যিকের অহংকার আমার আসলেই আছে। সমাজের কড়াইতে ধাই-ধাই করে আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কায় আমি ওই অহংকার একটু কম দেখাই। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //