ভেঙে পড়ছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর, দায় কার

‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা করা হয়। ঘর এবং জমি নেই এমন পরিবারের সংখ্যা দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১ জন। অপরদিকে জমি আছে, ঘর নেই এমন পরিবারের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি। সর্বমোট আট লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারকে পর্যায়ক্রমে বাসস্থান নির্মাণ করে দেয়া হবে সরকারের পক্ষ থেকে। দুই শতক জমির ওপরে নির্মিত প্রতিটা ঘরের নির্মাণ ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। দুই কক্ষ বিশিষ্ট ঘরের সঙ্গে একটি রান্নাঘর, একটি সংযুক্ত টয়লেট ও ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রাখা হয়েছে। ভূমিহীন যারা রয়েছে তাদের দুই শতক ঘরের জমির মালিকানাও দেয়া হবে।

সারাদেশে ভূমিহীন-গৃহহীন বিধবা, অসহায়, বয়স্ক, দুস্থ এবং প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম ধাপে ৬৯ হাজার ৯০৪ পরিবারকে একটি আধাপাকা বাড়ি দেয়া হয়। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে এসব ঘর ও জমি ২৩ জানুয়ারি দেয়া হয়। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই সেই ঘরে ধস ও ভেঙে পড়ার খবর আসতে শুরু করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা ও অর্থ আত্মসাৎকারীদের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে এগোচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে মোট ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর নির্মাণে নানা অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

ঘর নির্মাণে গাফিলতিসহ নানা অভিযোগে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট পাঁচ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। আরো বেশ কিছু কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, ঠিকাদারসহ অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। যেসব ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো পুনর্নির্মাণের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্পকে বিতর্কিত করার দায় কার-এমন প্রশ্ন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের।

জানা গেছে, গৃহহীন ও  ভূমিহীনদের জন্য ঘর শুধু ঘর নয়, এটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে এই বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সবার আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৈথিল্যের ঘটনায় জড়িতদের ছাড় দেবেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন, অনিয়ম ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি পেতেই হবে। কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না।

মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না-প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা বাস্তবায়নে রূপ দিতে ইতিমধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। একসঙ্গে এত ঘর যা বিশ্বে অনন্য নজির। প্রধানমন্ত্রী উপহারের ঘর পেয়ে ভূমিহীন-আশ্রয়হীন মানুষগুলো খুশি। প্রকল্পটি বেশ সুনাম কুড়ালেও কোনো কোনো কর্মকর্তার অনিয়মের কারণে সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘর কয়েক দিন যেতে না যেতেই ভেঙে পড়ছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী ও উপকারভোগীরাও। রাজনীতিবিদরাও বিষয়টিকে ভালো ভাবে দেখছেন না। এর জন্য মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা ও অসাধু ঠিকাদারই দায়ী করছেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, মোট ২২ জেলার ৩৬টি উপজেলায় ঘর নির্মাণে নানা অভিযোগ পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে প্রশাসনের পাঁচ কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। ওএসডি হওয়া কর্মকর্তারা হলেন- সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে সাবেক ইউএনও (বর্তমানে উপসচিব) শফিকুল ইসলাম, বগুড়ার শেরপুরের সাবেক ইউএনও মো. লিয়াকত আলী সেখ (বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক), মুন্সীগঞ্জ সদরের সাবেক ইউএনও রুবায়েত হায়াত, বরগুনার আমতলীর ইউএনও মো. আসাদুজ্জামান ও মুন্সীগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ মেজবাহ-উল-সাবেরিন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ পাঁচ কর্মকর্তাকে গত কয়েক দিনে পৃথক আদেশে ওএসডি করা হয়। ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জের সাবেক ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। বাকি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। যেসব উপজেলায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল সেসব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিদর্শন দলের সদস্যরা। তাদের প্রতিবেদনে ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে। এ অনিয়মে জড়িত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্লোগান হলো- ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। এর সঙ্গে আমাদের সবার আবেগ জড়িয়ে আছে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ক্রটিবিচ্যুতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৈথিল্যের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। অনিয়ম ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি পেতেই হবে। কাউকেই বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীনকে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া গেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেসব ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা পুনর্নির্মাণের নিদের্শনা দেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, কুড়িগ্রাম, বরগুনার আমতলী, বগুড়ার শেরপুর, শাজাহানপুর, হবিগঞ্জের মাধবপুর, সুনামগঞ্জের শাল্লা ও মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলায় ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা ও দুর্নীতির ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়াও গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার মধুপুর আশ্রয় প্রকল্পের ঘর, নেত্রকোনার পূর্বধলা, কিশোরগঞ্জ, বগুড়াসহ মোট ২২টি জেলার ৩৬টি উপজেলা রয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘর নির্মাণের বেলায় নীতিমালা মানা হয়নি। অনেক ঘরে নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে, গুণগত মান ঠিক হয়নি। নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। যার কারণে ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। অনেক পিলার ভেঙে গেছে। দেয়াল ধসে পড়েছে। নিচু এলাকায় ঘর নির্মাণ করায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ভূমির মালিকরাও ঘর বরাদ্দ পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে পরিষ্কারভাবে দুর্নীতি হয়েছে। এটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সঙ্গে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পকে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ বা হাইপ্রোফাইলের প্রকল্পে দুর্নীতি প্রত্যাশিত ছিলো না। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকল্প মানেই কিছু মানুষের সম্পদ গ্রাসের মাধ্যম। দুঃখজনকভাবে এই প্রকল্পেও এমনটাই ঘটেছে। বিষয়টি জরুরিভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এর সঙ্গে কোনো কোনো কর্মকর্তা, ঠিকাদার বা স্থানীয় অন্য কোনো প্রভাবশালী কেউ যুক্ত থাকলে তা খুঁজে বের করতে হবে। শুধু নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে সেই ব্যাখ্যা দিলেই চলবে না। আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //