বোট ক্লাব আসলে কী?

পারস্পরিক পরিচয়, যোগাযোগ এবং সম্পর্কের আদান-প্রদান, বন্ধুত্ব গড়ার লক্ষ্য নিয়েই গড়ে উঠেছে ক্লাব-সংস্কৃতি। সমাজের অভিজাত ক্লাবগুলোতে একটা শালীন পরিবেশ থাকে, বেশ কড়াকড়িভাবেই মেনে চলা হয় ড্রেসকোড। সদস্যদের কেউ সীমালঙ্ঘন করলে বহিষ্কারও করা হয়। অধিকাংশ সদস্যই মূলত ক্লাব ব্যবহার করেন- টেনিস, জিম, সুইমিংপুল ও রেস্টুরেন্ট সুবিধার কারণে। এর বাইরেও ক্লাবগুলোর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে রয়েছে রাজ্যের প্রশ্ন। কোনো কোনোটিতে আছে রাতভর জুয়া, মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলার অভিযোগ। তবে ক্লাবপাড়ার সব অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে যায় পর্দার আড়ালেই। সমাজের সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এগুলোর সদস্য হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও এ নিয়ে বেশি নাক গলাতে যায় না।

অভিধান কিংবা বিশ্বকোষ ঘেঁটে জানা যায়, বোট ক্লাব মূলত বাইচ, ইয়াটিং, কায়াকিং, ক্যানোয়িং, ছোট-বড় যন্ত্রহীন ও যন্ত্রচালিত নৌযানের বিষয়ে আগ্রহী নৌযান মালিকদের ক্রীড়া সংগঠন। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই গড়ে ওঠা দেশের প্রথম এ ধরনের ক্লাব- ‘চিটাগাং বোট ক্লাব’। মেরিটাইম এজেন্সি, সিভিল ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্যুরোক্রেটস ও মিলিটারি সার্ভিসের অভিজাত ব্যক্তিরা যাতে এক ক্লাবেই বিনোদনের সব সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন, সেই পরিকল্পনা থেকেই ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্লাবটি। আর এর উদ্যোক্তা ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব নেভাল স্টাফ প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল সুলতান আহমেদ। আন্তর্জাতিকমানের সভা-সেমিনার আয়োজনের জন্য রয়েছে মাল্টিপারপাস কনভেনশন সেন্টার। আছে রিভারভিউ অ্যান্ড রেস্তোরাঁ, কফি অ্যান্ড ক্রিম কর্নার, বারবিকিউ অ্যান্ড গ্রিল, বার (শুধু সদস্যদের জন্য), বোট ক্লাব হাউস, ব্রিসা মেরিনা সিবিসি রিসোট, সিনেপ্লেক্স ও কিডস জোন। কর্ণফুলী নদীর কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা ক্লাবটি নান্দনিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর। বর্তমানে সর্বসাধারণের জন্য এ ক্লাবের বিভিন্ন ফেসিলিটি চালু রয়েছে। অভিজাত এই ক্লাবটি চলছে যেন সবার স্বার্থেই। 

এ দিকে অভিজাত না হলেও তেমনই একটি যশোর বোট ক্লাব। নিবিড় পরিবেশ, মিনি চিড়িয়াখানা, দোলনা, বিশাল লেক, ঝুলন্ত সেতু, অর্জুন গাছের সারি। আর ছোট ছোট কটেজ। সাজানো গোছানো মনোরম পরিবেশ। যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও এয়ারপোর্ট সংলগ্ন বোট ক্লাবটি সবার জন্য উন্মুক্ত। রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর-সাভার সড়কের আশুলিয়া মোড় থেকে বেড়িবাঁধ ধরে বিরুলিয়ার দিকে এগোলেই হাতের ডান পাশে ‘ঢাকা বোট ক্লাব’-এর অবস্থান। তিন পাশে পানিঘেরা বিস্তৃত মাঠে স্থাপিত ক্লাবটি দিনের বেলায় থাকে সুনসান। রাত নামলেই শুরু হয় বিত্তশালীদের আনাগোনা। 

দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে শতশত কোটিপতি। আর তাদের চিত্তবিনোদনের জন্য অলিতে-গলিতে গড়ে উঠছে নানান রকমের ক্লাব। পুরনো ক্লাবগুলোতে নতুন সদস্যপদ মিলে কদাচিৎ। তাই নব্য ক্লাবগুলোর চাহিদা তুঙ্গে। ‘ঢাকা বোট ক্লাব’ তেমনই একটি, যেখানে ২০১৫ সালে জনপ্রতি এক লাখ টাকা দিয়ে সদস্য নেওয়া শুরু হয়। ২০১৬ সালে শ্রেণিভেদে সদস্য ফি করা হয় পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা। ২০১৮-২০১৯ সালে সেই ফি হয়ে যায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এমনকি প্রভাবশালী কয়েকজনকে বিনা টাকায় মেম্বারশিপ দিয়ে বড় বড় পদেও বসানো হয়। পরবর্তীতে তাদের দোহাই দিয়েই দখল করা হয় অনেকের জমি। সেখানেই গড়ে ওঠে ক্লাব হাউসটি। 

ঢাকায় অভিজাত সব ক্লাব থাকলেও হঠাৎ করে নির্জন জায়গায় বোট ক্লাব গড়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, উত্তরাসহ বিভিন্ন ক্লাবে ঠাঁই না পেয়ে নতুন এই ক্লাবটি করার উদ্যোগ নেন নব্য ধনিক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন পারটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবেল আজিজ। অবসরে বিনোদন, শরীর চর্চা ও জলজ নানা ধরনের ক্রীড়ার ব্যবস্থা রাখার উদ্যোগ নেন তিনি; কিন্তু সেগুলো যেন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বোট বা নৌকা তো দূরের কথা, কোনো বৈঠা বা লগির ছবিও নেই ক্লাব ভবনে। মদ আর ডিজে পার্টির নামে চলে নানারকম আনন্দ-ফুর্তি। পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদ বর্তমানে বোট ক্লাবের সভাপতি। ক্লাবের ওয়েবসাইটে তার এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘ডিবিসি মূলত একটি নৌকা চালানোর ক্লাব, যা এর নাম থেকেই বোঝা যায়। তবে পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্রীড়ার পাশাপাশি এখানে অন্যান্য খেলাধুলার ব্যবস্থাও থাকবে। যেমন- মাছ ধরা, টেনিস, স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ডস ও আরও অনেক কিছু।’ ওই বার্তায় আরও বলা হয়, ‘ক্লাবটি চাচ্ছে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিবারের সদস্যদের জন্য মরুভূমির মাঝে প্রশান্তিমূলক মরূদ্যান হিসেবে কাজ করতে, যেখানে তারা এসে অবকাশ যাপন করতে পারবেন এবং একই ধরনের মন-মানসিকতার মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সমাজের অপরাধ ও দুর্নীতির ফসল হলো এ সব ক্লাব-সংস্কৃতি। ঘুষ, লুণ্ঠন ও দুর্নীতির মাধ্যমে কিছু লোকের হাতে প্রচুর টাকা আসছে। তাদের তো ব্যয়ের জায়গা থাকতে হবে। এখন একেকটা প্রকল্প হচ্ছে, যেখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা কিছু লোকের কাছে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক বিভিন্ন চুক্তি হচ্ছে, বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে, সেখান থেকেও কমিশন যাচ্ছে দেশের বেশ কিছু লোকের হাতে। ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্য; সেখান থেকে পুলিশ, আমলা, বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, নেতা, ছোট নেতা- সবাই টাকা পাচ্ছেন। এই যে বিপুল পরিমাণ আন্ডারগ্রাউন্ড মানি; এটার কারণে সন্ত্রাসী তৈরি হয়, মাদকবাণিজ্য হয়, আর এগুলোর কারণেই যত অপরাধ।’

উত্তরার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় তুরাগ নদীর তীরে নিরিবিলি পরিবেশে ঢাকা বোট ক্লাব প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন প্রতিষ্ঠাতারা। শুরুতে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ২৭ বিঘা জমি কিনে, সেখানে ঘাঁটি গাড়ে বোট ক্লাব কর্তৃপক্ষ। এরপরই শুরু হয় দখল বাণিজ্য। সমাজের প্রভাবশালীরা ক্লাবের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলারও সাহস হয় না কারও। অনেকের দাবি, বোট ক্লাবের জায়গাটির মধ্যে বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মাহমুদুল হাসান আলালেরও প্রায় এক একর জমি রয়েছে। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সেই জমি জবর-দখল করে নিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এমনকি অন্যের লিজ নেওয়া খাস জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে ক্লাব কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এমনই এক ভুক্তভোগী বিরুলিয়ার বর্তমান চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজন। সুজন বোট ক্লাবের ৭৭ শতাংশ দাবি করে বলেন, ‘বাউন্ডারি করে জমিটা ব্যবসার জন্য আমি কয়েকজনকে ভাড়া দিয়েছিলাম; কিন্তু আমার সেই বাউন্ডারিও এখন আর নেই। ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের মতো করেই দখলে নিয়েছে। আসলে বেড়িবাঁধের পাশের সব জমি মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সরকারি ওইসব জমিও বোট ক্লাব দখল করে বাউন্ডারি দিয়েছে।’ 

সুজন যদিও বলছেন, ‘এখন ক্লাব কর্তৃপক্ষ চাইলে জমিটা তাদের কাছে হস্তান্তর করে দেব। আমি আর সেই দিকে তেমন যাইও না।’

এ বিষয়ে ঢাকা বোট ক্লাবের সচিব লে. কমান্ডার (অব.) তাহসিন আমিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হাবুল শেখ হাবিব উল্টো সুজনের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। 

তুরাগ রিক্রিয়েশন ওয়ার্ল্ডের এই মালিক বলেন, ‘বোট ক্লাবের জন্য জমি কিনতে গিয়ে আমরা ওই জমির সন্ধান পাই। হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে নেই। পরে অবশ্য জানতে পারি ভূমি অফিসের একটি অসাধু চক্র মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেছে, জমিটা আসলে সরকারি। নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তীতে ক্লাবের নামে সেটি লিজ নেই। এর মধ্যে নবায়ন করতে দেরি হওয়ায় বিরুলিয়ার চেয়ারম্যান ক্ষমতায় এসে তার নামে নিয়ে নেয়। তবে অভিযোগ তোলার পর আবার আমাদের নামেই লিজ হয়। এ ছাড়া ক্লাবের সামনের কিছু জায়গা আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। তাদের কাছ থেকে স্থাপনা না করার শর্তে শুধু ব্যবহারের অনুমতি নেওয়া আছে আমাদের।’ সাবেক চেয়ারম্যান আলালের জমি থাকার বিষয়টি অবশ্য ‘ফলস ইনফরমেশন’ বলে জানান স্থানীয় এই ব্যবসায়ী। 

নানা ঘটনা ও বিভিন্ন অভিযোগের যুক্তি খণ্ডিয়ে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল বলেন, ‘ক্লাবগুলোতে মূলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। স্পোর্টস হয়। এর সঙ্গে কিছু রিফ্রেশমেন্ট থাকে। ক্লাবের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। এর কোনো ব্যত্যয় হয় না। আর সেই নিয়ম মেনেই সদস্য করা হয়। অর্থ-বিত্ত থাকলেই কেউ ক্লাবের মেম্বার হয়ে যেতে পারেন না, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য গুণাবলি থাকতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //