করোনা সংক্রমণের নতুন রেকর্ড ছুঁতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

করোনা সংক্রমণের নতুন রেকর্ড ছুঁতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সংক্রমণ আতঙ্কজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

এটি এখন ধরে নেয়া যায় যে, বাংলাদেশে গরমেই করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও একই অবস্থা, খুব দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানেও। 

নতুন করে উচ্চ হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি পালনের প্রবণতাও কমে গেছে। গত বছর ২ জুলাই সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল।

এ বছর মার্চ মাসের শুরুতে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার (৬ এপ্রিল) একদিনে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ২১৩ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে ও মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৬ জন। একদিনে মৃত্যু ও শনাক্তের হিসেবে যা নতুন রেকর্ড। 

যেভাবে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে। 

আশঙ্কার কথা হলো- করোনা সংক্রমণ নতুন করে বেড়ে যাওয়ার পরও মানুষের মধ্যে রোগটি নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কমই কাজ করছে। বেশির ভাগ মানুষই মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হচ্ছে এবং সমাগম রয়েছে এমন স্থানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করছে। জনসমাবেশও হচ্ছে নানা জায়গায়। হাত ধোয়ার প্রবণতা কমে গেছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা সাধারণ মানুষের এই প্রবণতাকে ভয়ের চোখেই দেখছেন। তারা বলছেন, করোনা সম্বন্ধে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ‘না থাকাটা’ খুবই খারাপ ধরনের প্রবণতা। এ ধরনের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যেতে থাকবে। 

এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এম মোজাহেরুল হক বলছেন, ‘সরকারের উচিৎ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আরও কঠোর হওয়া এবং জোরে-শোরে প্রচারণা চালানো যেন মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। এছাড়া শনাক্তের ধরন দেখে তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া।’

ভারতে করোনার ডাবল মিউট্যান্ট

ভারতে করোনা ভাইরাসের ডাবল মিউট্যান্ট হচ্ছে। এ ধরনের ভাইরাসে নিজের মধ্যে দু’বার ডিএনএ পরিবর্তন করে থাকে। ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে দুটি মিউটেশন হয়ে থাকে। করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনই মানুষের শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। ভাইরাসটি মানুষের শরীরেই দু’বার নিজের মধ্যে পরিবর্তন করতে পারলে শরীরের সাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (অ্যান্টিবডি) পাশ কাটিয়ে সংক্রমণ ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। 

গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত ভারতে ১০ হাজার ৭৮৭টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাসের ডাবল মিউট্যান্টের বৈশিষ্ট্যযুক্ত ৭৭১টি ভেরিয়েন্ট (ধরন) শনাক্ত হয়েছে। 

এই মিউট্যান্টগুলোর মধ্যে ৭৩৬টি ইউকে ভেরিয়েন্ট ও ৩৪টি দক্ষিণ আফ্রিকা ভেরিয়েন্ট। ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, ভাইরাসের মিউটেশন বা ডিএনএ’র মধ্যে পরিবর্তন স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নতুন পরিবর্তনগুলো গুরুত্বহীন হয়ে থাকে। নতুন পরিবর্তন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শরীরের ভেতর বড় কোনো অসুস্থতা তৈরি করতে পারে না; কিন্তু ইউকে ভেরিয়েন্ট বা দক্ষিণ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট কিছুটা বেশি সংক্রামক। 

অবশ্য করোনার ডাবল ভেরিয়েন্টের সাথে ভারতের করোনা রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক থাকার কথা ভারত সরকার নাকচ করে দিয়েছে। ডাবল মিউট্যান্টের সাথে করোনার নতুন করে ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের যোগসুত্র নাকচ করে দিলেও তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের জনগণের সাথে ভারতের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ডাবল মিউট্যান্ট ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে কি-না তা কেউ বলছে না। এজন্য বেশি হারে জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে; কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে সিকোয়েন্সিংয়ের সুযোগ কম। ফলে বাংলাদেশে ডাবল মিউট্যান্ট ভেরিয়েন্ট থাকলেও তা জানার সুযোগও খুব কম। 

তবে এখানে ইউকে ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব রয়েছে। এই ভেরিয়েন্টটি খুবই সংক্রামক। দেশে সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেকেই ইউকে ভেরিয়েন্টকেই দায়ী করছেন; কিন্তু এসব বলার পেছনে ব্যাপকহারে গবেষণা হয়নি।

রফতানি নিষেধাজ্ঞায় টিকা প্রাপ্তি সহজ হচ্ছে না

করোনাভাইরাসের টিকা রফতানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, নতুনভাবে করোনা বৃদ্ধি পাওয়ায়। গত ২৮ মার্চ ভারতে একদিনে ৬২ হাজার করোনা শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত পাশাপাশি দেশ এবং প্রায় কাছাকাছি প্রকৃতির আবহাওয়া ও জলবায়ু বিরাজমান থাকায় এই দুই দেশে একই সময়ে করোনা সংক্রমণ কমে গিয়েছিল ও আবার একই সময়ে সংক্রমণ গতি ঊর্ধ্বমুখী। 

নতুন এই সংক্রমণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না। ফলে ভারত সরকার করোনা টিকা রফতানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিজেদের মানুষের টিকা প্রাপ্তি যেন বিঘ্ন না ঘটে। উল্লেখ্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানি। শুধু করোনার টিকা নয়, সারাবিশ্বে শিশুদের জন্য যে টিকাগুলো নিয়মিত দেয়া হয় এর বেশির ভাগ সিরাম সরবরাহ করে। এসব কারণে আগামী দিনগুলোতে শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বব্যাপী করোনার টিকা প্রাপ্তি ও প্রয়োগ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে আগামী জুন পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করবে। জানুয়ারি মাসে প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে; কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে পাঠিয়েছে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। চুক্তি অনুযায়ী মার্চে কোনো টিকা পাঠায়নি সিরাম। 

তবে ভারত সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দুই দফায় ৩২ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। প্রথমবার জানুয়ারিতে ২০ লাখ ও দ্বিতীয়বার ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ১২ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক কোটি দুই লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। ২৮ মার্চ পর্যন্ত সরকার ৫২ লাখ ৬৩ হাজার ২৪৮ ডোজ টিকা দিয়েছে। 

অবশিষ্ট দুই কোটি ৩০ লাখ ডোজ টিকা সিরাম থেকে পাবে বাংলাদেশ; কিন্তু মার্চ চলে গেলেও এখন পর্যন্ত মার্চ মাসের চালান আসেনি। সময় মতো এবং চুক্তি অনুযায়ী দেবে কি-না তাও বলতে পারছেন না স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। 

প্লাজমা থেরাপির গুরুত্ব বাড়ছে

করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাজমা থেরাপির গুরুত্ব বাড়ছে। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে গেলে শরীরে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) তৈরি হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে তিন মাসের মধ্যে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত নিয়ে কনসেনট্রেশন (ঘন) করে করোনা আক্রান্তকে দেয়া হলে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহেও করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। এ কারণে নতুন করে করোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাজমা থেরাপি গুরুত্ব পাচ্ছে। 

রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে প্লাজমা থেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের প্লাজমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। প্লাজমা নেয়ার পর তা মেশিনে কনসেনট্রেশন করে পরে রোগীর শরীরে পুশ করতে হয়। এটি বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হয়। ফলে মানুষের কাছ থেকে বিনামূল্যে রক্ত পেলেও হাসপাতালগুলো থেকে বিনামূল্যে প্লাজমা পাওয়া যাবে না। নগরীর কয়েকটি হাসপাতালে অনেকটা চড়া দামে প্লাজমা পাওয়া গেলেও গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল কেবল কনসেনট্রেশন আর সংরক্ষণের খরচটা নিয়ে থাকে বলে তারা বলছেন। 

গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের তথ্য উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু জানিয়েছেন, অন্যান্য হাসপাতাল থেকে তারা এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ কম দামে প্লাজমা সরবরাহ করেন। প্রকৃতপক্ষে মানুষের কাছ থেকে বিনামূল্যে প্রাপ্ত রক্ত প্রসেস ও সংরক্ষণের দামটা নিয়ে তারা তা সরবরাহ করেন ও কোনো মুনাফা তারা করেন না। 

টিকার প্রথম ডোজ সমাপ্ত হবে শিগগিরই 

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে অর্ধকোটির বেশি টিকা দেয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে এ টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথম দিকে দৈনিক দুই লাখ ডোজ টিকা দেয়া হলেও মার্চের শুরু থেকে তা এক লাখ ডোজের নিচে চলে এসেছে। যারা ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন চলতি এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ থেকে তাদের দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। দ্বিতীয় দফার টিকা প্রদান যেন সময় মতো পাওয়া যায়, সে জন্য সরকার প্রথম দফার টিকা প্রদান কিছু ধীরগতি করেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। 

তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা আশা করছেন, মার্চে না আসলেও এপ্রিল মাসে টিকার আরেক দফা চালান সিরাম থেকে পাওয়া যাবে। ফলে প্রথম দফায় যাদের টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের সবাইকেই দ্বিতীয় দফায় টিকা প্রদানে কোনো সমস্যা হবে না। আরেকটি চালান না আসা পর্যন্ত প্রথম দফার প্রথম ডোজ টিকা প্রদান কর্মসূচি আপাতত বন্ধ রাখা হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //