৫০ বছরেও যেসব বিতর্কের সমাধান হয়নি!

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ায় নওগাঁয় সাহার আলী নামে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধের মৃত্যুর খবরটি স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এসে মোটেও কাক্ষিত নয়। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) নতুন তালিকা প্রকাশ করেন নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ওই দিনই সাহার আলী জানতে পারেন, তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়েছে। এ খবর শুনে স্ট্রোক করে মারা যান তিনি। 

তার ছেলে দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তার বাবা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; কিন্তু জামুকার যাচাই-বাছাই প্রতিবেদনে বাতিল তালিকায় তার নাম থাকার কথা শুনে তিনি স্ট্রোক করে মারা যান।

যদিও যাচাই-বাছাইয়ের পরে যে প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ ছিল। যেহেতু এটি চূড়ান্ত নয়, তাই সাহার আলীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়ই সমাহিত করা হয়েছে। আসলেই তিনি তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবর শুনে স্ট্রোক করেছেন, না-কি বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, সেটি বলা মুশকিল। তবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক; মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন বা স্বাধীনতাবিরোধী ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ ঘোলা করা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বিষয় নিয়ে জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলার প্রয়াস যৌক্তিক নয়। 

স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ঘোষণা করবে সরকার। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতেই এই উদ্যোগ। যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। এই তালিকায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগও পুরনো। যার মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ অন্যতম। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণ। পাশাপাশি আর্থিক সুবিধা ও সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-মেয়ে ও পরবর্তীতে নাতি-নাতনি পর্যন্ত যে কোটার ব্যবস্থা ছিল, তার কারণে বিভিন্ন সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। 

এ রকম বাস্তবতায় সরকার বলছে, অনিয়ম ঠেকাতে নানা ধরনের যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১০ হাজারের মতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারও সনদ নেই। অনেকে এখনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার বাইরে– এমন খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।   

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ মুহূর্তে সরকারি ভাতা ভোগ করছেন এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৫ হাজার ২০৬ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৭৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) নামে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সরাসরি ভাতা পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ঠিক কত, সে বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। প্রসঙ্গত, দেশে এ পর্যন্ত মোট ছয়বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাও নির্ধারণ করা হয়েছে অনেকবার। 

শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাই নয়, বরং সম্প্রতি আরেকটি বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ‘বীরউত্তম’ খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে। ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মদদদাতা’ উল্লেখ করে তার খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। যদিও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, এটি এখনই চূড়ান্ত নয়। বরং বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে যদি জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তারপর তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

বাস্তবতা হলো, জিয়াউর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ও বঙ্গবন্ধুর সরকারই তাকে বীরউত্তম খেতাব দেয়। আবার এও ঠিক যে, তিনি পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের প্রশ্রয় দিয়েছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন; কিন্তু তারপরও পঞ্চাশ বছর পরে এসে জিয়ার ‘বীরউত্তম’ খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্তটি কতটা যৌক্তিক ও এর পেছনে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সমীকরণ কতটা সক্রিয়– সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী ২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধার ও ১৬ ডিসেম্বর রাজাকারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে; কিন্তু এর আগে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ নিয়ে কী ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেছে, তা দেশবাসী ভোলেনি। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে অহঙ্কারের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না– এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর। 

অভিযোগ আছে, ২০১০-১২ সালে বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্থানীয়ভাবে রাজাকারদের একটি তালিকা করেছিল। যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তালিকায় অনেক লোকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে আগামী ১৬ ডিসেম্বর রাজাকারদের যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের কথা বলা হচ্ছে, সেই তালিকায় যদি সত্যিই প্রতিহিংসা এবং ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিরোধের জেরে কারও নাম অন্তর্ভুক্ত করার মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে ওই তালিকা প্রকাশের পরে বিষয়টি নিয়ে আবারো বিতর্ক তৈরি হবে। আর এ কারণে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ পুনরায় প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। 

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে একজনের নাম বাদ গেলে তিনি হয়তো এতদিনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হারাবেন; কিন্তু রাজাকার না হয়েও ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কারণে কাউকে যদি রাজাকারের তালিকায় যুক্ত করা হয় এবং সেই তালিকা যদি প্রকাশিত হয়, তাহলে শুধু ওই ব্যক্তিই নন, বরং সারাজীবন ওই ব্যক্তির পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। আর এই গ্লানি তাদের আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হবে, যা মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। 

সুতরাং একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার যেমন তালিকা থেকে নাম বাদ যাওয়া কাক্ষিত নয়, তেমনি নিরাপরাধ বা পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কাউকে রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাও উচিত হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //