জয়শঙ্করের ঢাকা সফর

আশা-নিরাশার দোলাচলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক!

সাদা চোখে কূটনীতির শিষ্টাচারের অংশ হিসেবেই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকা সফর করে গেলেন। আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রটি দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু বটে, কখনো বা নানা ভূমিকার কারণে সমালোচকদের তীর্যকবাণে বিদ্ধও হয় দেশটি। ভারত-বাংলাদেশ তাই ছোট্ট আলোচনাতে সরব হয়ে ওঠে, উভয় দেশের গণমাধ্যমসহ কূটনৈতিক বিশ্লেষক মহলও। 

গত ৪ মার্চ মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট ব্যক্তিটি। তিনি ঘড়ির কাঁটা ধরে প্রতিটি মিনিটের যথাযথ ব্যবহার করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও বেসরকারি পর্যায়েও কয়েকটি মিটিং করেন। উদ্বোধন করেন ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেরও। সবকিছু ছাপিয়ে দিন শেষে আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ইস্যুটি। এর আগে মোদির সফর সামনে রেখে ২৮ থেকে ৩১ জানুয়ারি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন দিল্লি সফর করেন। সেই সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সাথেও তিনি বৈঠক করেন।

জয়শঙ্করের সফর নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, নরেন্দ্র মোদির সফরে আলোচ্য বিষয়গুলো চূড়ান্ত করতেই জয়শঙ্করের ঢাকা সফর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন দুইমন্ত্রী। সাংবাদিকদের চিরাচরিত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন তারা। তবে স্বভাবসুলভ কূটনৈতিক ভঙিমায় তা উৎরানোর চেষ্টাও ছিল তাদের। বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার পেছনে অপরাধ কর্মকাণ্ডকে কারণ হিসেবে দেখান  জয়শঙ্কর। 

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা একমত হয়েছি, যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক; কিন্তু সমস্যাটি কেন হচ্ছে তা আমরা জানি। সীমান্ত হত্যার মূল কারণ অপরাধ। সুতরাং আমাদের মিলিত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ‘অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন’ সীমান্ত। আমি নিশ্চিত, আমরা যদি এটি করতে পারি, তাহলে একসঙ্গে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবো।’ 

আর প্রত্যেকের অগ্রাধিকারকে পরস্পরের জন্য কীভাবে লাভজনক করা যায়, সেটির ওপর ভিত্তি করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিভিন্ন দিক বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে বলে জানান একে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, এ মাসের শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশ সফর আমাদের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। আমরা আনন্দিত তিনি মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনে অংশ নেবেন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও মহাত্মা গান্ধীর ওপর ডিজিটাল প্রদর্শনীর মাধ্যমে দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। আসন্ন সফরে মোদি গোপালগঞ্জ আর সাতক্ষীরায় যাবেন বলে নতুন আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কোনো বিষয় জড়িত না থাকলেও, ভারতের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে তিনি ওই দুই জেলায় যাবেন, অনেকে তাই মনে করছেন।

এ বৈঠকে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা ছিল বহুল আলোচিত তিস্তা ইস্যু নিয়েও। আশার কোনো বাণী দেখা যায়নি তাদের উত্তরে। জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। শিগগির আমাদের পানি সচিবদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আমি নিশ্চিত তারা এ বিষয়ে পরবর্তী আলোচনা চালিয়ে নেবেন। আমি মনে করি, আপনারা এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অবস্থান জানেন, যা এখনো পরিবর্তন হয়নি।’ 

তিনি আরো বলেন, সম্পর্কের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেটি নিয়ে আমরা বর্তমানে কাজ করছি না। আমাদের সম্পর্ক সত্যিকার অর্থে ৩৬০ ডিগ্রির। সব ক্ষেত্রে আমরা কিছু না কিছু করছি। যতই কাজ করছি, ততই নতুন নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হচ্ছে। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন দু’দেশের সম্পর্ক ৫০ বছর পার হয়ে গেছে এবং পরের ২০ বছর কি করা যেতে পারে। আমি বলব, কানেক্টিভিটি। যদি আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কানেক্টিভিটি ঠিক রাখতে পারি, তবে এই অঞ্চলের সামগ্রিক ভূ-অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা দুই পক্ষই বিশ্বাস করি, এটি করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে জাপানকে যুক্ত করার বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন। 

পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জয়শঙ্কর। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কোনো সমস্যা হলে সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমেই তার সমাধান করা উচিত। এ সময় জয়শঙ্কর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বাবা কে. সুব্রামানিয়ামের লেখা বই ‘লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন। 

এই সফর নিয়ে দু’দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আশ্বাস আর সুসম্পর্কের নানা কথা শোনা গেলেও অবিশ্বাস আর সন্দেহের রেশ নিয়ে কথা বলেছেন বিশ্লেষকরা। কেননা, সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধের আলোচনাটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতেও বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর ব্যাপারে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সমর্থনও প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের। এর আগে দু’দফায় সরাসরি ভারতের দু’জন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস পেলেও, নানা জটিলতায় আলোর মুখ দেখেনি তিস্তার পানি বণ্টনের সমাধানের ইস্যু। আর মাঝে মাঝে আসামের এনআরসি ইস্যুও অনেকটাই ভীত করে তুলে বাংলাদেশকে। 

তবে আঞ্চলিক নানা ইস্যুতেও এ সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উপমহাদেশ ও এশীয় প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা নতুন মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে। এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুরৈখিক পদক্ষেপও বহু দিনের। উদীয়মান দেশ হিসেবে ভারতের চাওয়া-পাওয়াও এসব সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার জন্যই আগ্রহের বিন্দুতে। 

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমরা আসলে দেখছি, ভারত বাংলাদেশের জনগণের সাথে নয়, সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ তারা বাংলাদেশের জনগণের কোনো ধরনের সুবিধার কথা চিন্তা করছে না। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হতে পারে, তারা জিতে গেছে। জনগণের কাছেও হয়ত এসব বলে দু’চারটি ভোটও বেড়ে যেতে পারে; কিন্তু তাদেরও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও কিন্তু জনগণের কাছে এসব নিয়ে বলতে হবে। ফলে দেশের জনগণ বা সরকার যদি মনে করে, তারা আসলে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাহলে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্কে ফাটল ধরবে। এক সময় হয়তো আমাদের সরকার অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে অধিক মনোযোগী হবেন। সেটা তো ভালো হবে না। 

দাগ ধরে উল্লেখ না করলেও এসব প্রশ্নের ছাপ ছিল দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অবয়বেই। জয়শঙ্কর তাই বলেন, আমাদের সম্পর্কের প্রতিটি অর্জন সমগ্র অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। সবাই জানে আমরা অন্যদের কাছে এ সম্পর্ককে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করি। এ কারণেই নিরাপত্তা, বাণিজ্য, পরিবহন ও সংযোগ, সংস্কৃতি, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক থেকে শুরু করে জ্বালানি ও অভিন্ন সম্পদ এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কের যৌথ বিকাশসহ সব ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব সম্প্রসারণে কাজ করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //