৫০ বছরে বংলাদেশের নারীরা কতটুকু এগিয়েছে

বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে, ঠিক সেসময়ে দাঁড়িয়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। 

৫০ বছরে দেশের নারীদের সাফল্যের অনেক গল্প আছে; কিন্তু এর পাশাপাশি উল্টো চিত্রও রয়েছে। যতটা না এগিয়েছে নারীরা, তার চেয়েও অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দীর্ঘ পথ চলাতে অনেক নারী উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে নারীরা কাজ করছেন; কিন্তু দুঃখজনক ও উদ্বেগের হলেও সত্য- নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন, সহিংসতা উত্তরোত্তর  বড়েই চলেছে। ঘরে কিংবা বাইরে মর্যাদায় নারীর অবস্থান তেমন পরিবর্তন হয়নি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল মনে করেন, ‘কিছু নারী সফলতা পেয়েছেন। তবে বাস্তবতা হলো- দুই বছরের শিশু থেকে বয়স্ক নারী, সবাই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। আমাদের মানসিক বিপর্যয় এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে- মর্গে থাকা মৃত নারীর লাশও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকের হাত থেকে। নারী শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে, এখানেও নারীরা এগুতে পারেনি বেশিদূর। এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাল্য বিয়ে হচ্ছে। শহরে স্নাতক শেষ হওয়ার আগেই বেশিরভাগ মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। পরে তাদের অধিকাংশই আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। নারীরা পৈতৃক সম্পত্তিতেও সমান অধিকার পাচ্ছেন না।’ 

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২১ ইনডেকস’ বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে সমতা, মজুরি, বিয়ে, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, উদ্যোগ, সম্পদ ও পেনশন- এই আটটি সূচকের ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, এসব সূচকে গড়ে বাংলাদেশ যে মান অর্জন করেছে (৪৯.৪), তা পাকিস্তানের চেয়েও কম (৫৫.৬)। 

আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন  নেই। সাধারণ মানুষ পারিবারিক সহিংসতাকে নিতান্তই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় বলে মনে করে। নারীকে তার অধিকারগুলো নানা সময়ের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আদায় করে নিতে হবে।’

অভিনেত্রী দিলারা জামান মনে করেন, ‘৫০ বছর কেন মানসিকতার পরিবর্তন না হলে ১০০ বছরেও বাংলাদেশের নারীরা সঠিক মর্যাদা আর অধিকার পাবে না। আমাদের সময় নারীর যে চিত্র ছিল, এখনো তা-ই রয়েছে। গুটি কয়েকজন আছেন ও সবসময় থাকেন, যারা প্রতিবন্ধকতা ছাড়িয়ে যেতে পারে। পরিবার, সমাজ, সম্পদ, দক্ষতা, উচ্চশিক্ষা, জীবিকা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, অবস্থানগত ক্ষেত্রগুলোতে  দেশের নারীরা এখনো পুরুষের তুলনায় সংখ্যায় পিছিয়ে। নারী-পুরুষের সমান সুযোগ, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখনো আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’

সাহিত্যিক ও লেখক গাজী তানজিয়া বলেন, ‘ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১ প্রতিবেদন অনুসারে, তখন দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮ শতাংশের কিছু বেশি ছিল ছাত্রী।  ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর হার প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়ে ৩৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে এই হার খুব একটা উল্লসিত হওয়ার মতো কিছু না হলেও আশাপ্রদ। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ থাকলে, স্কুল থেকে অকালে ঝরে পড়া বা বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক ব্যধি যার সাথে যুক্ত আছে আনুষঙ্গিক আরো কিছু প্রতিবন্ধকতা- এটি এড়িয়ে যেতে পারলে নারীকে আরো অগ্রসর ভূমিকায় দেখতে পাবো। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ এবং অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। ডিজিটাল দুনিয়া ব্যক্তির জন্য যেমন সুফল বয়ে এনেছে, তেমনি নারীর জন্য অনেক সময় হুমকিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আমরা দেখেছি। এসব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে নারী এগিয়ে যাবে এটিই প্রত্যাশা।’

প্রাইম ব্যাংকের একসিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব সিগমেন্ট শায়লা আবেদিন বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে নারীর কম অংশগ্রহণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা বিভিন্ন অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। তবে জোর করে কেবল সংখ্যা বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে সমতা আসবে না। সামাজিকভাবে নারীর প্রতি যে মানসিকতা সেটিতে পরিবর্তন আনা আসল কাজ। নারীর উদ্যোক্তা বা কর্মজীবী হওয়ার ক্ষেত্রে এক সময় বড় বাধা ছিল পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। শুরুতেই বাধা আসত পরিবার থেকে। একজন মেয়ে হয়ে চাকরি বা ব্যবসা করবে- এটি পরিবারের কোনো সদস্যই মেনে নিতে পারত না। তা ছাড়া সমাজও ভালো চোখে দেখত না। আশার কথা হচ্ছে, সে অবস্থার এখন পরিবর্তন হয়েছে। নারীর চাকরি করা বা  উদ্যোক্তা হতে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা এখন তেমন একটা নেই। এখন বড় সমস্যা অর্থনৈতিক সংকট। নারীরা মূলত পরিবারে তার স্বামী বা বাবার ওপর নির্ভরশীল। নিজের তেমন পুঁজি থাকে না।’

পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য সূচকে আমরা এগিয়েছি, এটি সত্য; কিন্তু সামগ্রিকভাবে নারী-পুরুষের বৈষম্য বিলোপে আমরা এখনো বহু পিছিয়ে আছি। নারী স্বাস্থ্যে বাংলাদেশ এগিয়েছে, শিক্ষায় এগিয়েছে। আবার দেখা যাচ্ছে, বাল্যবিবাহের হার যদি বেড়ে যায়, তাহলে আমাদের নারীর সামগ্রিক পরিস্থিতি খারাপ হবে।’ 

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপে বাংলাদেশকে এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে  গেলেও শ্রমবাজারে এখনও নারীর অংশগ্রহণ হতাশাজনকই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ। 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যেখানে ৯০ দশকের সময়ও মোট কর্মক্ষম নারীর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ শ্রমবাজারে অংশ নিতেন, সেখানে এখন ৩৬ শতাংশ নারী শ্রমবাজারে অংশ নিচ্ছেন। এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের ব্যাপার; কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখব যে, এখনো আমাদের ৬৪ শতাংশ নারী কিন্তু শ্রমবাজারে নেই। অর্থাৎ যেখানে প্রায় ৮২ শতাংশ পুরুষ শ্রমবাজারে আছেন, সেখানে কর্মক্ষম নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ অনেক কম।’ 

পুরান ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করেন চুমকি আক্তার। তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো গৃহকর্মীরা তাদের সম্মান আর সঠিক বেতন থেকে বঞ্চিত। আমাদের মানুষ মনে করা হয় না। এই দিকটা পরিবর্তন আনা দরকার। আমরা কাজ করে খাই। আমাদের পেশাকে কেন ছোট করে দেখা হবে?’

তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা নানজীবা খান মনে করেন, ‘২০২১ সালে এসে আমারা নারীরা পোশাকে কেবল আধুনিক হয়েছি; কিন্তু মানসিকতার কোনো পরিবর্তন নেই। আর আমরা যারা মিডিয়াতে কাজ করি, তাদের অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। পরিবার, আত্মীয়-স্বজনরা ভালো চোখে দেখে না। আমাদের পুরুষ সহকর্মীরাও নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। একজন নারী যে বয়সেরই হোক, তার মেধা বিকাশে স্বাভাবিক সুযোগটি পাচ্ছেন না। এই জায়গায় আমাদের আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে, আমরা যত সভ্য হবো, ততই পিছিয়ে পড়বো।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //