অকাল বন্যার দায় কার

নদী বিধৌত সমতল বদ্বীপ অঞ্চল বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তোমার আমার ঠিকানা- এই স্লোগানই বলে দেয় বাংলার পরিচয়। তাই তো ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের প্রেমে মজে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছিলেন- ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল-পারা’। 

কিন্তু এখন আর নদীগুলোর সেই আপন গতি নেই, নিজের প্রয়োজনে বাঁধ দিয়ে ইচ্ছামতো তার বেগ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ। তটিনীর বুকজুড়ে কেবলই ধু-ধু বালুচর। উজানে পানিপ্রবাহ আটকে রাখায় শুষ্ক মৌসুমে বিরাজ করে অত্যুগ্র শুষ্কতা, গরমে এ অঞ্চল হয়ে ওঠে আরো গরম; বর্ষায় মেতে ওঠে প্লাবন আর ভাঙনের নিষ্ঠুর খেলায়। ভরাট হয়ে নিশ্চিহ্ন হতে যাওয়া নদী উপচে পানি গড়ায় আশপাশের গ্রাম-গঞ্জ, ফসলি মাঠ, রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজে। 

নদীগুলোর ওপর অন্যায়-অবিচারের চিত্র তুলে ধরে উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী ভূপেন হাজারিকা তাই গেয়েছিলেন, ‘বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের/হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে/ও গঙ্গা তুমি/গঙ্গা বইছ কেন?’

বাংলাদেশে সাধারণত বন্যা হয় বর্ষায়; কিন্তু আশ্বিনের বন্যায় যে উত্তর ও মধ্যাঞ্চল প্লাবিত হলো- তা অনেকটা অপ্রত্যাশিত। এবার প্রথম বন্যা শুরু হয় ২৭ জুন। পরে ১১ জুলাই শুরু হয় দ্বিতীয় দফা বন্যা। তৃতীয় দফার বন্যা শুরু হয় ২০ জুলাই। আর চতুর্থ দফার বন্যা চলছে ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে। স্মরণকালের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ৬৩ দিন, সেটি ১৯৯৮ সালে। ১৯৮৮ সালে টানা ১৫ দিন বন্যা দেখা দিয়েছিল। 

এবারের বন্যা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা পানির আধিক্য ও অতিবৃষ্টিই এর মূল কারণ। করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে এ বন্যা যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। ফসলি জমি পানির নিচে থাকায় মাঠের কাজে দিনমজুরের চাহিদা নেই। বেশিরভাগই এখন বেকার। অনেকের ঘরে খাবারও নেই, কাটছে পানিবন্দি জীবন। নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে আউশ-আমনের আবাদ। পরিস্থিতি আরো বেগতিক হলে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। 

ঘন ঘন বন্যার নেপথ্যে জলবায়ু পরিবর্তনকেই একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানীরা। এর পেছনের কারিগরও মানুষ, যার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে সবাইকে। 

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আবহাওয়ার স্বাভাবিক সূচির পরিবর্তন হয়েছে। বর্ষা মৌসুম আসতে বিলম্ব করায় অতিবৃষ্টি হয়েছে এবার। তবে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এলাকা বন্যায় ডুবে, এটিই এখানে স্বাভাবিক; কিন্তু যখন তা আরো বেশি এলাকায় ছড়িয়ে যায়, তখনই চিন্তার বিষয়। আর বন্যার স্থায়িত্বকালও এক সপ্তাহের বেশি হলে সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এখানে এ ধরনের বন্যা সাধারণত ২.৩৩ বছর পর পর আসে; কিন্তু পাঁচ বছর ধরে দেখছি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নিয়মিতভাবেই বড় বন্যা হচ্ছে।’ 

আশ্বিনে বন্যা প্রসঙ্গে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাই দেশের ভেতর বৃষ্টির প্রবণতা আরও কয়েক দিন থাকতে পারে। উজানেও বৃষ্টি হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বানের পানি ধেয়ে আসায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়।’

ফারাক্কার ধাক্কা

পদ্মার ভারতীয় অংশের নাম গঙ্গা। শুষ্ক মৌসুমে দেশটির একটি অঞ্চলে ফসল ফলানোর জন্য নদীটির বুকে বাঁধ দিয়ে পাল্টানো হয়েছে এর প্রবাহ ধারা। পক্ষান্তরে ভাটি বাংলায় পদ্মাসহ এর শাখা নদীগুলোয় সৃষ্টি হচ্ছে পানিশূন্যতা। পানিপ্রবাহ না থাকায় নদীর বুক ভরাট হচ্ছে, নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে নদীটি। কোথাও কোথাও শাখা নদীগুলোর কিছু অংশ ভরাট হয়ে আজ ফসলি জমিতে রূপ নিয়েছে। 

ফলে বর্ষায় উজান থেকে ধেয়ে আসা বানের জলে নদীগুলো সহজেই প্লাবিত হয়। দুর্ভোগের সীমা থাকে না কোটি কোটি নিম্নাঞ্চলবাসীর। আর্থিক ক্ষতি গিয়ে ঠেকে হাজার হাজার কোটি টাকায়।

নদী গবেষকরা বলছেন, ফারাক্কায় বাঁধ না দিলেও ভরা মৌসুমে উজানের পানি নিম্নাঞ্চল বাংলাদেশেই আসত; কিন্তু সেটা হতো প্রাকৃতিকভাবে। তখন বর্ষায় পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলোর গতিপথ, স্রোত ও গভীরতাও নির্ধারিত হতো আপন গতিতে। তবে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখায় বছরের পর বছর ধরে শুকনা মৌসুমে গঙ্গা থেকে কম পানি মিলছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে এদেশের নদীকেন্দ্রিক ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের। 

শুধু তাই নয়, প্রতি বছর গজলডোবা থেকে পানির সঙ্গে বালু-পলি আসছে। এতে তিস্তা নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদী ও নদীপারের উচ্চতা দুই থেকে তিন ফুটের ব্যবধান থাকে। ভারত বাঁধের দরজা খুলে দেয়ার সাথে সাথে তিস্তায় পানি বেড়ে যায় ৭ থেকে ৮ ফুট। এতে হঠাৎ করেই মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে যায়। চরের মানুষ সারাবছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে সঞ্চয় করে তা চোখের সামনেই কেড়ে নেয় তিস্তা।

একই কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ও পরে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে নালিশ করেছে। আন্দোলন-সংগ্রামও কম হয়নি। এমনকি অনেক ভারতীয় পরিবেশবাদীও বাঁধটি গুঁড়িয়ে দেয়ার পক্ষে; কিন্তু তাতে টনক নড়েনি নীতিনির্ধারকদের। 

আবার পুরোপুরি নিশ্চিতও হয়নি ন্যায্য হিস্যা। বর্ষায় নিজেদের বন্যা সামাল দিতে ভারত ফারাক্কা, তিস্তায় গজলডোবাসহ অন্যান্য বাঁধ ও ব্যারেজের গেট খুলে দিয়ে ভাটির দিকে কী পরিমাণ পানি ছাড়ে তা কখনোই জানায় না। ফলে আকস্মিক বন্যায় ভাসতে হয় বাংলাদেশকে। এমনকি সেটি মোকাবেলার জন্য এদেশে যে বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়, তাতেও আপত্তি জানিয়েছে ভারত। এতে বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে প্রকল্পটি। 

জলের তলায় পুকুর চুরি!

দেশের অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী ও নান্দনিক নদ-নদী আজ মৃত। অনেকগুলো বেদখল কিংবা অন্য কোনো কারণে অস্তিত্ব বিপন্ন। নানাভাবেই প্রায় ৯৯ শতাংশ নদী তাদের নাব্য ও আকার-আকৃতি হারাচ্ছে। ভাঙনের ফলে জেগে ওঠা চর ও ভরাটের কারণে পাল্টাচ্ছে গতিপথ। উজানে পানি কমে যাওয়ার কারণেই নদীগুলোর আজ এমন দশা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য মতে, দেশে এখন জীবিত আছে মাত্র ২৩০টি নদী। 

তবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাব অনুযায়ী সেই সংখ্যা ৪০৫। আর সারাদেশে বর্ষাকালে নৌপথের পরিমাণ ছয় হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে তা কমে দাঁড়ায় চার হাজার কিলোমিটারে। 

এদিকে নদীর নাব্য কমে যাওয়া ঘন ঘন বন্যার অন্যতম কারণ। অথচ প্রতি বছরই নদী ড্রেজিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। এবার ড্রেজিং মাস্টার প্ল্যানের আওতায় ১৭৮টি নদী খনন ও পুনরুদ্ধার করে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের উপযোগী করতে ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সে জন্য দেখানো হয়েছে বিশাল স্বপ্ন, ছড়ানো হয়েছে প্রতিশ্রুতির নানা ফুলঝুড়ি। যদিও দেশে নদী-খাল খননে অনিয়ম-দুর্নীতি একটি পুরনো রোগ। বহু প্রকল্পই অনিয়মের কারণে ব্যর্থ হয়েছে। 

পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশে অবস্থিত নানা ধরনের বিল, হাওর, জলাশয় ও নদীগুলো বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ করে; যা পরবর্তী সময়ে শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজে ব্যবহৃত হয়; কিন্তু নদীবাহিত পলি জমে এসব জলাশয় ও নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ধারণ ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত পানি চারপাশের সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে প্লাবনের সৃষ্টি করছে। তাই নদী-খাল ও অন্যান্য জলাশয়ের মধ্যে যে আন্তঃসংযোগ ছিল, তা পুনরায় স্থাপন করতে হবে। ঠিক উপায়ে চালাতে হবে খনন কাজ। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে সেগুলো নদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। পাশাপশি ভাঙন রোধে নদীর পাড়ে ব্যাপকভাবে সামাজিক বনায়ন করতে হবে।’

বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো

দেশে ১২ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং ২৫ হাজার ৫৮০ কিলোমিটার পানি নিষ্কাশন চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে, যা দেশের মোট ভূমির বিপুল অংশ দখল করে আছে। নিয়মিত মেরামত না হওয়ায় প্রতি বছরই বানের তোড়ে ভেসে যায় কোনো না কোনো পয়েন্ট। এর পর কথিত ‘জরুরি কাজ’-এর অজুহাতে চলে জোড়াতালি, নামমাত্র সংস্কার। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছিঁড়ে যায় সেই মায়ার বাঁধন।

নতুন প্রকল্পের নামে শুরু হয় আবার নতুন বরাদ্দ। যুগের পুর যুগ ধরে এভাবেই চলছে ‘বাঁধ ব্যবসা’। সবকিছুই হয় রাজনৈতিক মাফিয়া আর পাউবোর এক শ্রেণির বিপথগামী কর্মকর্তার যোগসাজশে। খাতা-কলমে কাজ দেখিয়ে চলে লুটপাট। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষক অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে বাঁধের মতো ব্যয়বহুল স্থাপনার জন্য বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বরাদ্দ পাওয়া অর্থ মুহূর্তেই জলে ঢালা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে দীর্ঘ ও কঠিন পথ। এর প্রস্তুতিও নিতে হবে ভেবেচিন্তে, সময় নিয়ে। তা ছাড়া বাঁধে সামাজিক বনায়ন করা হলে কিংবা ঘরবাড়ি তুললে সেটি অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে। কেননা নিজেদের স্বার্থেই এলাকাবাসী বেড়িবাঁধকে সুরক্ষিত রাখতে উদ্যোগী হয়। তাই যত বড় অংকের অর্থই বরাদ্দ হোক, সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া কাজ করলে সব জলেই যাবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //