ঝুলে যাচ্ছে বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল

খরচ ভাগাভাগির প্রশ্নে ঝুলে যাচ্ছে বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল। বাংলাদেশে তৃতীয় দফার ট্রায়ালে যে ব্যয় হবে এর কিছু অংশ বাংলাদেশ সরকারকে বহন করতে হবে- অনানুষ্ঠানিকভাবে চীন তা জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। 

ভাগাভাগির এ প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চীনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতেও অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। খরচের প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের সরকারি পর্যায় থেকে খোলাখুলিভাবে  না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বলা হচ্ছে। 

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার ভ্যাকসিন ট্রায়ালের খরচে ভাগাভাগিতে যেতে চায় না। এ দেশে চীনা ভ্যাকসিন ট্রায়াল করার সুযোগ দেয়াই তাদের জন্য বড় পাওনা। এর সাথে খরচ ভাগাভাগির প্রশ্ন থাকতে পারে না।  

বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল অনিশ্চিত

এটি সবারই জানা- করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভ্যাকসিন অপরিহার্য। চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল; কিন্তু সময় যতই যাচ্ছে চীনা ভ্যাকসিন ট্রায়ালে সৃষ্টি হচ্ছে ধোঁয়াশা। চীনারা চলতি মাসেই একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে চায়, এখানে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দেয়া যাবে কি-না। 

প্রকৃতপক্ষে চীনারা কয়েকটি দেশে তাদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করে শেষের পথে রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল পেয়ে গেছে। ফলে ভ্যাকসিন ট্রায়ালে চীনাদের আগ্রহ কমে গেছে অন্য কোনো দেশে তৃতীয় দফার ভ্যাকসিন ট্রায়াল করার বিষয়ে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশে চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল অনিশ্চিত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। চীনের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে বলা হয়, আপাতত ট্রায়াল শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। গত ২৪ সেপ্টেম্বর পাঠানো ওই চিঠিতে সিনোভ্যাক জানায়, অক্টোবরে ঢাকায় তারা এক জরিপ পরিচালনা করবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেবে কবে, কখন এই ট্রায়াল শুরু করবে। এর আগে কয়েক দফা তারিখ পরিবর্তন করে সেপ্টেম্বরেই ট্রায়াল শুরু হবে এমনটা বলা হয়েছিল। 

স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ওরা সময় চেয়েছে। আগামী নভেম্বরে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করা যায় কি-না চিঠিতে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে।’ 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘যত দূর শুনেছি, চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানি তাদের আগের জায়গা থেকে সরে এসে এখন ট্রায়ালে বাংলাদেশের আর্থিক অংশীদারিত্ব চাইছে। এটি যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা তাদের ট্রায়ালের সুযোগ করে দিচ্ছি, সেটিই বড় কথা। এ কারণেই হয়তো তাদের ট্রায়ালটি ঝুলে গেছে।’

বিভিন্ন দেশ ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করে এখন শেষ দিকে রয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণও ক্রমেই নিচের দিকে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এখানে ট্রায়ালের উপযোগিতা থাকে কি না, তা নিয়েই নানা আলোচনা চলছে। এছাড়া অন্য দেশগুলোতে চীনা ভ্যাকসিন ট্রায়ালে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সাফল্য পেয়ে গেলে বাংলাদেশে তারা ট্রায়াল নাও করতে পারে।

উল্লেখ্য গত ২৭ আগস্ট চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানিকে ভ্যাকসিন পরীক্ষার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ। সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় আইসিডিডিআরবিকে। প্রাথমিক পর্যায়ে চার হাজার ২০০ স্বাস্থ্যকর্মীর গায়ে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার কথা ছিল। এজন্য আইসিডিডিআরবি প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। ২৫০ জন মাঠকর্মীর নিয়োগ ঠিক করে রাখা হয়। সিনোভ্যাক জানিয়েছিল পরীক্ষা নিরাপদ ও কার্যকর হলে তারা এক লাখ ১০ হাজার ভ্যাকসিন বিনামূল্যে বাংলাদেশকে দেবে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায় এই ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু হয়ে গেছে। 

সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন বিলম্বিত হওয়ায় চীন, রাশিয়া, ভারত ছাড়া অন্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন আনার সম্ভাব্য বিকল্প পথ খুঁজে দেখছে বাংলাদেশ। কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রক্রিয়ায়ও বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন আনার জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি করেছে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো।

ট্রায়াল শেষের আগেই ভ্যাকসিন দিচ্ছে চীন

করোনাভাইরাসের জন্মভূমি চীনে কোনো রোগী নেই। দেশটিতে ইতিমধ্যে মানুষকে আগের মতোই স্বাভাবিক চলাফেরা ও কাজ-কর্ম করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে চীনে বিশাল গণসমাবেশ হয়েছে। মানুষের অংশগ্রহণও ছিল ব্যাপকভাবে। এর আগেই চীন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও পর্যটন স্পটগুলো খুলে দিয়েছে। সে দেশে অবাধে চলাফেরা করছে মানুষ। চীন তাদের উৎপাদিত ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে সেখানকার জনগণকে দিতে শুরু করেছে। এর আগেই চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সদস্যদের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। 

ইউরোপ ও আমেরিকার যৌথ প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে আট থেকে দশটি ভ্যাকসিন তাদের দ্বিতীয় দফার ট্রায়াল শেষ করে তৃতীয় দফার ট্রায়াল শুরু করেছে; কিন্তু কেউই তৃতীয় দফার ট্রায়াল শেষ করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও চীন তাদের জনগণকে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন দিতে শুরু করায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।

চীন আরো বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা করেছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে। চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ তৃতীয় দফা ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী ব্যতিত অন্য কোনো মানুষকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অপরীক্ষিত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেয়নি। 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, চূড়ান্তভাবে অপরীক্ষিত ভ্যাকসিনের ব্যবহারে মানুষের মধ্যে তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে এবং ভ্যাকসিন গ্রহণকারী ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যা নিরাপত্তার অনুভূতি (ফলস সিকিউরিটি ফিলিংস) জন্ম দিতে পারে। যদি ভ্যাকসিন সত্যিকার অর্থেই কার্যকর না হয়, তাহলে এই ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়তে পারে বিপজ্জনক এই ভাইরাস। 

বেইজিংভিত্তিক কোম্পানি সিনোভ্যাকের তিন হাজার কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ চীনের ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এছাড়া চীনের সরকারি কোম্পানি সিনোফার্মের ভ্যাকসিন ইতিমধ্যে কয়েক লাখ মানুষকে দেয়া হয়েছে বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়।

ভারত থেকেই আসছে ভ্যাকসিন!

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভারত থেকেই ভ্যাকসিন আসতে পারে। চীনা ভ্যাকসিনের তৃতীয় দফার ট্রায়াল ঝুলে যাওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি করে রেখেছে- যখনই সিরাম ইনস্টিটটিউট ব্রিটেনের অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করবে, তখনই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারা বেক্সিমকোকে ভ্যাকসিন দেবে। সেজন্য বেক্সিমকো ফার্মা সিরাম ইনস্টিটিউটকে অগ্রিম অর্থ প্রদান করে রেখেছে। 

বেক্সিমকো বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন বিক্রি করবে। তাহলে কি বেক্সিমকোর বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথ পরিষ্কার হচ্ছে? এ প্রশ্নও করছেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে বেক্সিমকো বাণিজ্যিকভাবে ভ্যাকসিন বিক্রি করতেই পারে। আবার বেক্সিমকো সরকারের কাছেও ভ্যাকসিন বিক্রি করতে পারে। 

যেভাবেই হোক, এখানে বেক্সিমকোর জন্য বিশাল বাণিজ্যের পথ সুগম হতে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //