পরিচ্ছন্নকর্মীরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত

কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও রাজধানী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে গিয়ে নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে তেমন সচেতন নন পরিচ্ছন্নকর্মীরা। আই ক্যান ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিদিন চার হাজার ৫০০ টন আবর্জনা তৈরি হয়। এই আবর্জনা পরিচ্ছন্নতায় কাজ করেন ২১ হাজার ক্লিনার ও ওয়েস্ট হ্যান্ডেলার। ঢাকার দুই সিটির বিভিন্ন এলাকায় মাস্ক, গ্লাভস ও গাউন ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণভাবে ময়লা অপসারণ করতে দেখা গেছে তাদের।

সম্প্রতি ওয়াটার এইডের একটি গবেষণায় ওঠে এসেছে পরিচ্ছন্নকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং অসচেতনতার এক ভয়ংকর চিত্র। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে অসচেতনা থেকে হতে পারে বড় বিপদ। আর এই সময়ে সবাইকে সর্বোচ্চ সুরক্ষার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্য, তারা পরিচ্ছন্নকর্মীদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী দিয়ে আসছেন; কিন্তু দায়িত্বরত পরিচ্ছন্নকর্মীরা বলছেন, তারা নিয়মিত এসব সামগ্রী পাচ্ছেন না। দু-একদিন পরপর এসব সামগ্রী নিজ অর্থে কেনার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। 

রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৮০, ৮১, ৮২ ও ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডে সরেজমিনে দেখা গেছে, মাস্ক, গ্লাভস ও গাউন ছাড়াই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছেন পরিচ্ছন্নকর্মীরা। ময়লা-আবর্জনা সারানোর কাজ করতে গিয়ে তাদের এমনিতেই স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। এমনই এক পরিচ্ছন্নকর্মীর সঙ্গে কথা হলো এই প্রতিবেদকের। সূত্রাপুর এলাকার পরিচ্ছন্নকর্মী আব্দুল জলিল। সুরক্ষা উপকরণ ছাড়া বর্জ্য পরিষ্কারের কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘সিটি করপোরেশন থেকে বুট জুতা, গ্লাভস, জামা দেয়া হয় বছরে একবার। তাও অনেকে পান না। গায়ের জামাটা পেয়েছি দুই বছর আগে। যে গ্লাভস পেয়েছিলাম, তা দুই সপ্তাহের বেশি ব্যবহার করা যায়নি। প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো রোগের জন্য ওষুধ খেতে হয়; কিন্তু সিটি করপোরেশন থেকে চিকিৎসার জন্যও কোনো টাকা দেয়া হয় না। এমনকি সারামাস কাজ করার পর বেতনও ঠিকমতো পাই না।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের এক পরিচ্ছন্নকর্মী বলেন, ‘ঠিকমতো খেতেই পারি না, আবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা! গরিব মানুষের খোঁজ কেউ রাখে না। কিছু উপকরণ পেয়েছিলাম। সেগুলো এতদিন ভালো থাকে না। এ কারণে আমরা অনেকে এখন আর এসব ব্যবহারও করি না।’

ওয়াটার এইডের জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে- পরিচ্ছন্নকর্মীদের মধ্যে ৩.২৫ শতাংশ কভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব কর্মীর বেশির ভাগই হাসপাতালের বর্জ্য পরিচ্ছন্নতা ও ব্যবস্থাপনায় কাজ করছেন। বাকিদের মধ্যে এই সচেতনতার ব্যাপক অভাব রয়েছে। প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, ৭০ শতাংশ কর্মী সারাদিনের কাজ শেষ করে একবারে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে থাকেন এবং প্রায় অর্ধেক (৪৭.৯৮) পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশনকর্মী সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অথচ পরিচ্ছন্নতা কাজের সময় সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

পরিচ্ছন্নকর্মীদের নিয়ে আরেকটি জরিপ করেছে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন। ওই জরিপে দেখা যায়, মহামারির কারণে ৪১ শতাংশ পরিচ্ছন্নকর্মীর বেতন কমেছে। দিনে তিনবেলা পর্যাপ্ত খাবার জোটে না ৭৯ শতাংশ পরিবারের। আয়ের এমন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা মাস্ক ও গ্লাভস কিনে কাজ করে যাচ্ছেন। ওয়াটার এইডের জরিপ মতে, ৭০ শতাংশ পরিচ্ছন্নকর্মীকে নিজের আয়ের টাকা থেকে সুরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে হয়েছে। 

গত মে মাসে প্রকাশিত প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ১৫ জন পরিচ্ছন্নকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। এরপর পরিচ্ছন্নকর্মীদের নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য উপাত্ত আর পাওয়া যায়নি। 

ওয়াটার এইডের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ৩৭.৪ শতাংশ স্যানিটেশন ওয়ার্কার কভিড-১৯ উপসর্গ দেখা দিলে টেস্ট কোথায় করতে হবে এবং টেস্টের ফলাফল পজিটিভ হলে চিকিৎসার সঠিক পদ্ধতি কী হবে তা জানেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্য ও স্যানিটেশন পরিচ্ছন্নকর্মীদের উপসর্গ মারাত্মক আকার ধারণ করেনি বলে তাদের সুরক্ষার বিষয়টিকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এই ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই এখনো অজানা। ওয়াটার এইডের জরিপে দেখা যায়, স্যানিটেশন ওয়ার্কাররা সাধারণ মানুষের তুলনায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। বাড়তি ঝুঁকি পরিচ্ছন্নকর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে যেমন হুমকির মুখে ফেলছে, তেমনি তাদের আর্থিক ও চিকিৎসা নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘সংবাদমধ্যামের বিভিন্ন খবর থেকে এটি বোঝা যায়, করোনাভাইরাস দীর্ঘ সময় ধরে থাকবে। তাই পরিচ্ছন্নকর্মীদের বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা গ্লাভস, মাস্ক, গাউনসহ সব একসঙ্গে পরেন। কারণ একটিও বাদ থাকলে সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত সুরক্ষা সরঞ্জাম আলাদা করে ফেলতে হবে, যাতে কোনো পরিচ্ছন্নকর্মীকে সরাসরি ভাইরাসের সংস্পর্শে না আসতে হয়। প্রতিটি ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের নিচে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে। পরিচ্ছন্নকর্মীরা বর্জ্য সংগ্রহ করার আগে ও পরে যাতে হাত ধোয়, সেটি মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তাকর্মীদের নির্দেশনা দিতে হবে।’

ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘পরিচ্ছন্নকর্মীরা সমাজে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। সুরক্ষা পরিকল্পনা থেকে তাদের বাদ দিয়ে আমরা কভিড-১৯ মোকাবেলায় কার্যকর সাফল্য পাওয়ার আশা করতে পারি না। তাই প্রাপ্য মর্যাদা ও প্রণোদনা দিয়ে তাদের সুরক্ষায় একসঙ্গে কাজ করা খুব জরুরি; কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বেশ নিম্নমানের হওয়ায় এসব উপকরণ দু-তিন সপ্তাহের বেশি ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। নষ্ট হওয়ার পর নতুন উপকরণ পেতেও অনেক সময় লেগে যায়। অনেক পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন, যারা সুরক্ষা উপকরণ পাচ্ছেন না দু-তিন বছর ধরে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিচ্ছন্নকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে গ্লাভস, মাস্ক, অ্যাপ্রোনসহ বিভিন্ন উপকরণ দেয়া হয় প্রতি বছর। তবে তারা (পরিচ্ছন্নকর্মী) সেটি নিয়মিত ব্যবহার করে না।’ সুরক্ষা উপকরণের সংকট ও তা বণ্টনে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় পেতে একটু দেরি হয়। পান না এ তথ্য সত্য নয়।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য সরকার থেকে গ্লাভস, বুট জুতাসহ সব সরঞ্জাম নিয়মিত দেয়া হয়। তবে পরিচ্ছন্নকর্মীরা তাদের স্বাস্থ্যের বিষয় নিয়ে সচেতন নন। এগুলো দেয়ার পর দু-একদিন ব্যবহার করে আর ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া এগুলো ভালো করে সংরক্ষণও করেন না। এগুলো ব্যবহার করতেও এক ধরনের অস্বস্তিবোধ করেন তারা।’

পরিচ্ছন্নকর্মীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য আর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা আছে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা পরিচ্ছন্নকর্মীদের যেন কোনো সংক্রমণ না হয় সেজন্য বুট জুতা, গ্লাভস, মাস্কের মতো নিরাপত্তা পোশাক প্রদান করি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //