আয়-ব্যয়ে এখনো সঙ্গতিহীন কর্মজীবীরা

মানিকনগরে হালিম, নুডলস ইত্যাদি বিক্রি করতেন জাকির হোসেন। করোনাভাইরাসের কারণে ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে ফুটপাতে দোকান বসতে দেয়া হয়নি। দুই মাসের ছুটির পর দোকান খুললেও ক্রেতার অভাবে নিজেই তা বন্ধ করে দেন জাকির। এরপর রাজধানী ছেড়ে যাওয়া আরেকজনের ফলের দোকানে কাজ করছেন তিনি। কিন্তু সংসারের নিত্য ব্যয় সামলানোর মতো আয় করতে পারছেন না। 

জাকির কিছুটা আয় করতে পারলেও এখনো রাজধানীর অনেক মানুষ কাজে যোগ দিতে পারেননি। আগে ছোটখাটো ব্যবসা করতেন এমন অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।

সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা বা অন্য কোনো সহায়তা না পাওয়ায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করার মতো সামর্থ্য নেই তাদের। এভাবে আয়হীন হয়ে পড়া মানুষদের অনেকেই ব্যয়ের চাপ সামলাতে না পেরে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

করোনাভাইরাস অর্থনীতিকে ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। ফলে দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠী, বিশেষত দরিদ্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ হঠাৎ করেই হয়ে পড়ে কর্মহীন। সাধারণ ছুটির পর অনেকেই কাজে যোগ দিয়েছেন। তবে সব মানুষ কাজে যোগ দিতে পারেননি। ছোটখাটো অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধই হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করতেন, তাদের নতুন করে কাজ খুঁজতে হচ্ছে। সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করা হলেও অনেকে ন্যূনতম জনবল দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন।  

সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) করোনাকালে আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে জরিপভিত্তিক গবেষণা 

ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাগ্যের অন্বেষণে গ্রাম থেকে শহরমুখী হয় মানুষ। আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এটিই; কিন্তু মহামারি সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। একসময় গ্রাম থেকে একটু ভালো করে বাঁচার আশায় যারা শহরে এসেছিলেন, তারা আবার হয়েছেন গ্রামমুখী। করোনাকালে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। গত এপ্রিল মাসে ছয় শতাংশ শহুরে দরিদ্র মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে যান। মে মাসে এসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩.৩ শতাংশ। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের ব্যয় এবং অন্য নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন।

গত ২০ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত এ জরিপ চালানো  হয়। এতে অংশ নেয় সাত হাজার ৬৩৮ পরিবার। এবার গ্রাম এবং শহরের দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষও যুক্ত ছিল। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি শহরের পরিবার, ৪৩ শতাংশের বেশি গ্রামের পরিবার এবং ১.২২ শতাংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবার।

জরিপে আরও দেখা যায়, মহামারি শুরু হওয়ার এক মাস পর, এপ্রিলে গ্রামে ৫০ শতাংশ এবং বস্তি এলাকার মাত্র ৩২ শতাংশ পরিবার কোনোরকম আয়মূলক কাজে জড়িত ছিল। লকডাউন তুলে দেওয়ার পর জুন মাসে এই হার যথাক্রমে ৮৩ শতাংশ ও ৮৪ শতাংশে উন্নতি হয়েছে। এখনো ১৭ শতাংশ পরিবারের কোনো আয়মূলক কাজ নেই।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু হলেও একে এক ধরনের ভঙ্গুর পুনরুদ্ধার তৎপরতা বলা যায়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে দরিদ্র মানুষকে যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তা এক ধরনের টোকেন সহায়তা। এপ্রিলে আমরা যে নতুন দরিদ্র শ্রেণি সৃষ্টির কথা বলেছিলাম, অর্থনৈতিক কর্মকা- চালুর পর তাদের মধ্যে মাত্র এক শতাংশ মানুষের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।’

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বাসাবাড়িতে কাজ করত যেসব মানুষ, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী, তাদের কাজ হারানোর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের সংখ্যা ৫৪.১৯ শতাংশ। এরপর আছে অদক্ষ শ্রমিক, দক্ষ শ্রমিক। তবে কারখানার শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ হারানোর হার অপেক্ষাকৃত কম। 

করোনাকালে কর্মজীবীদের রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে খাবার ব্যয় কমিয়ে আনতে বাধ্য হন। লকডাউনের আগে, লকডাউনের সময় এবং লকডাউনের পরে মানুষের খাবার ব্যয়ের তারতম্য চোখে পড়ার মতো। গত ফেব্রুয়ারিতে যেখানে শহরে একজন কর্মজীবী খাবারে ব্যয় করেন ৬০ টাকা, এপ্রিলে তা কমে হয় ৪৪ টাকা। জুনে এসে এটি সামান্য বেড়ে হয় ৪৫ টাকা। শহরাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের খাবারের ব্যয়ে কিছু উন্নতি হলেও, গ্রামে পরিস্থিতি লকডাউনের পরেও ভালো হয়নি। গ্রামে ফেব্রুয়ারিতে খাবার ব্যয় ছিল ৫২ টাকা। এপ্রিলে তা কমে হয় ৪১ টাকা, জুনে তা আরও কমে হয় ৩৭ টাকা। খাবার ব্যয় কমানোর প্রধান কারণ ছিল দরিদ্র মানুষের আয় ব্যাপকহারে কমে যাওয়া। শহরাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের আয় ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১০৮ টাকার বেশি। এপ্রিলে তা অনেকটা কমে হয়ে যায় ২৬ টাকা, জুনে দাঁড়ায় প্রায় ৬৭ টাকায়। গ্রামাঞ্চলে আয় ফেব্রুয়ারিতে ছিল প্রায় ৯৬ টাকা; এপ্রিলে তা কমে হয় ৩৭ টাকা এবং জুনে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ টাকায়। 

করোনাকালীন সংকট মোকাবেলার জন্য সরকার এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ছাড়াও রয়েছে দান-অনুদান। অতিদরিদ্র মানুষ কিছুটা সহায়তা পেলেও কাজ হারানো কর্মজীবীরা কিছুই পাননি। প্যাকেজের কোনো ধরনের সহায়তা পাননি ব্যবসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হওয়া উদ্যোক্তারাও। সহায়তাবঞ্চিত হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা ও খেটে থাওয়া মানুষ। বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিডব্লিউসিসিআই) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদ বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। সংকট কাটিয়ে উঠতে নারী উদ্যোক্তাদের বড় ধরনের সহায়তা প্রয়োজন।’ 

করোনাকালীন বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা হয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসেবা, পণ্য এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অনলাইনে খুচরা বিক্রি বেড়েছে; কিন্তু এরপরও জুনে অনলাইন ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন ২৪ শতাংশ নারী। ফ্যাশন, কসমেটিক এবং আমদানিনির্ভর পণ্য নিয়ে যারা ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ব্যবসা করতেন, এপ্রিলে স্টক ফুরিয়ে যাওয়া এবং অর্ডার বাতিল হওয়ায় এখন বিপাকে পড়েছেন।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে গত বছরের ঈদ এবং পহেলা বৈশাখের তুলনায় এবার কম রাজস্ব আয় হয়েছে ৭৯-৮৪ শতাংশ উদ্যোক্তার। এই চাপ সবচেয়ে বেশি পড়েছে নারী উদ্যোক্তাদের ওপর। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি নিবন্ধন না থাকায় ৬৫ শতাংশ উদ্যোক্তা সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে ওই উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ নারী তাদের সঞ্চয় এবং ২০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা তাদের পরিবার ও বন্ধুদের মধ্য থেকে ঋণ সহায়তা নিয়েছেন। কীভাবে সরকারি সহায়তা পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে ধারণা নেই ৬৩ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার। আর্থিক সংকটের কারণে ব্যবসা নিয়ে উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ মানসিকভাবে চাপে ছিলেন।

অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ী ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার বলেন, ‘করোনাকালে নিত্যপণ্যের সেবা দিয়ে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের ১৫ শতাংশ বেশ ভালো করেছে। বাকি ৮৫ শতাংশ বেকায়দায় পড়েছেন। তাদের জন্য জামানতবিহীন ঋণ প্রয়োজন। নতুন এই খাতকে বিকশিত করতে হলে এই সংকটে অবশ্যই সরকারকে সহায়তা করতে হবে।’

এদিকে, করোনাকালীন দরিদ্র মানুষের আর্থিক কষ্ট বেড়েছে দীর্ঘস্থায়ী বন্যায়। এতে ৩৩টি জেলার কৃষকের জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, তাদের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় বিপাকে এসব অঞ্চলের কৃষির ওপর নির্ভরশীল কৃষি শ্রমিক। রাজধানীতে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার খরচ আরও বাড়িয়েছে এই বন্যা পরিস্থিতি। বন্যার কারণে মানুষের খাবার ব্যয় আরও বেড়ে যাচ্ছে। নিম্নআয়ের অনেক মানুষের রাজধানীর বাজার থেকে সবজি কিনে খাওয়ার মতো অবস্থাও নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //