আইওএম প্রতিবেদন

কাজের নিশ্চয়তা পেলে ৯৯ শতাংশ প্রবাসীই দেশে থাকতে চান

আসাদুল ইসলাম, বাড়ি সাতক্ষীরা। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে মালায়েশিয়া ও সৌদি আরবে প্রবাসী হিসেবে কাজ করছেন। এর মাঝে বছর সাতেক আগে দেশে ফিরেছিলেন। মালায়েশিয়া থেকে সাথে আনা অর্থ কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। আবারো ফেরেন প্রবাসে। 

এরপর পাড়ি জমালেন সৌদি আরবে। কয়েক দফা কোম্পানি পরিবর্তন করেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। দেশে আসার পর বিপদ যেন আরো বেড়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে ফিরে যান আসাদ। 

তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে দেশের বাইরে পড়ে আছি, কেবল পরিবারের একটু সুখের জন্য। দুটি সন্তানকে মানুষ করব বলে। দেশে গিয়েছিলাম; কিন্তু কোনো কাজ পাই না। বসে খেয়ে সব টাকা ছয় মাসে শেষ। উপায়ান্তর না দেখে আবার এলাম সৌদি আরবে। দেশে যদি তেমন কাজকাম থাকত, তাহলে কী আর এত কষ্ট করে এখানে থাকি!’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের সাবেক শিক্ষার্থী অপু। বাড়ি কিশোরগঞ্জ। স্নাতক পড়তেই মাথায় ভূত চাপে দেশের বাইরে যাওয়ার। কোনোমতে টাকা-পয়সা ধারদেনা করে চলে যান যুক্তরাজ্যে। উদ্দেশ্য ছিল নিজের আয়ের টাকায় সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করবেন। কাজও পান রেস্টুরেন্টে থালাবাসন মাজার। দিন-রাত কাজ করে, মাস ছয়েক এই জীবন চালাতে পেরেছেন। তারপর কাজ হারান। বছরখানেক সেখানে থাকার পর আর টিকতে পারেননি। চলে আসেন দেশে; কিন্তু দেশেও কাজ নেই। দুই বছর দেশে বেকার থাকার পর আবার ফিরেছেন প্রবাসে। এরপর তার গন্তব্য হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। তবে সেখানে সুখে নেই, এদিকে দেশেও কাজ না থাকায় ফেরারও উপায় নেই। 

অপু বলেন, ‘আমরা প্রবাসীদের মনে অনেক কষ্ট। মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে বন্দিজীবন কাটাই। সকালে উঠে কাজে যেতে হয় আর রাতে ফিরি। দুপুরে পলিথিন ব্যাগে রাখা খাবার খেতে হয়। খুপরির মতো ডরমেটরিতে মাথা গুঁজে ঘুমাতে হয়। আসার আগে ভেবেছিলাম প্রবাসে অনেক সুখ আর টাকা ওড়ে। প্রবাসে আসার সাথে সাথেই বুঝে গিয়েছিলাম জীবন কী জিনিস! দেশে ফিরতে চাই; কিন্তু ফিরে কী করবো- দেশে তো চাকরি নেই। পরিবারকে খাওয়াব কীভাবে!’

আসাদুল কিংবা অপুদের গল্পগুলো একইরকম। তাদের স্বপ্নগুলোও তা-ই। দেশে ফেরার আকুতিও একই। সেই সাথে দেশে যে তাদের কাজ নেই, সেই চিত্রপটও আলাদা নয়। 

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলছে, বাংলাদেশে জীবিকা নির্বাহের ভালো সুযোগ পেলে ৯৯ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী দেশেই থাকতেন। যে পাঁচটি প্রধান কারণে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে অভিবাসন করেন তা হলো- জীবিকার অভাব, অপর্যাপ্ত উপার্জন, অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক সেবার অভাব ও সীমিত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার নতুন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। 

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ: সার্ভে অন ড্রাইভার্স অব মাইগ্রেশন অ্যান্ড মাইগ্রেন্টস প্রোফাইল’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি গত ১৯ আগস্ট প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম। ২০১৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ১১ হাজার ৪১৫ জন সম্ভাব্য অভিবাসীর সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ওই সম্ভাব্য অভিবাসীরা চলতি বছরের জুনের মধ্যে অভিবাসনে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অভিবাসনের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে নিবন্ধন করেছেন কিনা তার ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য অভিবাসীদের নিয়মিত ও অনিয়মিত- এই দুই খাতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশে এই প্রথম ৬৪ জেলার ওপর এ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হলো। এর আগে বাংলাদেশে অভিবাসনের চালিকাশক্তির ওপর পরিচালিত গবেষণাগুলো ছিল পরিসর ও মাত্রার দিক দিয়ে নির্দিষ্ট ও সীমিত। 

প্রতিবেদনে কভিড-১৯ পূর্ববর্তী চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণার অধিকাংশ উত্তরদাতা পুরুষ (৮৯ শতাংশ) ও অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ২৭। ৬৪ শতাংশের বয়স বিশের কোটায়। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই বিবাহিত। অধিকাংশ উত্তরদাতা কর্মক্ষম ও শিক্ষার কিছু স্তর পার করেছেন। উত্তরদাতাদের শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের কথা বিবেচনা করলে- ৪১ শতাংশ মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করেছেন, ২৭ শতাংশ উচ্চবিদ্যালয় স্তর ও ২৬ শতাংশ প্রাথমিক স্তর সম্পন্ন করেছেন। 

নিম্নমানের কর্মসংস্থান বাংলাদেশে এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। ৪০ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে কর্মহীন ছিলেন ও ৯০ শতাংশ জানান তাদের ব্যক্তিগত কোনো উপার্জন নেই বা তা অপর্যাপ্ত।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিয়মিত ও অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীদের ধরন প্রায় একইরকম। সাধারণত ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে অনিয়মিত অভিবাসীরা অল্পবয়সী, স্বল্প শিক্ষিত ও মূলত বেকার হয়ে থাকেন। কিন্তু এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিয়মিত ও অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীদের বয়স এবং শিক্ষার স্তর একইরকম। 

উপাত্ত থেকে দেখা যায়, অধিকাংশ অভিবাসীরা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়ার অন্যান্য দেশে অভিবাসন করে থাকেন। মাত্র ১.৪ শতাংশ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অধিকাংশ উত্তরদাতা জানান, তারা মধ্যপ্রাচ্যে গমনে ইচ্ছুক। গন্তব্য দেশ হিসেবে সৌদি আরব সবচেয়ে জনপ্রিয়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৫ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী তাদের অভিবাসনের জন্য অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছেন।  নিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা গড়ে দুই লাখ ৪৩ হাজার ৬৫১ টাকা (দুই হাজার ৮৭১ মার্কিন ডলার) দিয়েছেন, যেখানে অনিয়মিত সম্ভাব্য অভিবাসীরা গড়ে দিয়েছেন দুই লাখ ২৯ হাজার ৪৮৮ টাকা (দুই হাজার ৭০৫ মার্কিন ডলার)। আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস দেশ। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭৮ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসে অবস্থান করেছেন। প্রতি বছর এ দেশে ২২ লাখেরও বেশি তরুণ শ্রমবাজারে যুক্ত হয়।

সম্ভাব্য অভিবাসীদের জিজ্ঞেস করা হয়, কী কী পরিবর্তন করা হলে তারা দেশে থাকবেন। প্রায় সবাই (৯৯ শতাংশ) উত্তর দেন, উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে তারা বাংলাদেশেই থাকবেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে একজন বলেন, ‘দেশে আমি যা উপার্জন করি, তা দিয়ে ভালোমতো জীবন চালাতে পারি না। বিদেশে গিয়ে অনেকেই ভালো করছে, তাই আমিও বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘প্রতি বছর দেশে গড়ে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। ২০১৩ থেকে প্রতি বছর গড়ে ২১ লাখ তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন, যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এর ফলে প্রতি বছর গড়ে ৮ লাখ বেকার মানুষ শ্রমশক্তিতে যুক্ত হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আর প্রবৃদ্ধির সুবিধা অসমভাবে বণ্টন হচ্ছে, সমৃদ্ধির সুফল সবাই সমহারে পাচ্ছে না। এতে বৈষম্য ক্রমেই বেড়েছে। কর্মসংস্থানের এই অভাব বৈষম্য থেকেই প্রবাসকেই বেছে নিচ্ছেন যুবকদের একটি বড় অংশ। যদি দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকত, তাহলে তারা বিদেশে যেত না। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাবও যুবকদের সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘আগের গতানুগতিক শিক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়া যাবে না। ডিজিটাল, বাজার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ, সেই সাথে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার দরকার হবে। দীর্ঘদিন শ্রমবাজারের বাইরে থাকলে, তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেবে। ফলে যে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে তা-ই নয়, সমাজের ওপরেও সামগ্রিকভাবে একটা প্রভাব পড়বে। নতুন গ্র্যাজুয়েটদের প্রচলিত শিক্ষার ওপর নির্ভর করে না থেকে তাদের কোয়ালিটি বৃদ্ধি করতে হবে। যুবকদের এই সমস্যা ও সংকটের ব্যাপারে সরকারকেও গুরুত্ব দিতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //