কোরবানি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ

গত ২৮ জুলাই থেকে রাজধানীতে ঈদুল আজহা উপলক্ষে পশুর হাট বসার কথা থাকলেও তিন দিন আগেই হাট বসে গেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ১৭টি স্থানে বসেছে কোরবানির পশুর হাট। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১টি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬টি হাট বসেছে।

গত ২৪ জুলাই (শুক্রবার) থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অনুমোদিত কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাটগুলোতে পশু আসতে শুরু করেছে। তবে ব্যাপারীরা আশঙ্কা করছেন পশুর ন্যায্যমূল্য নিয়ে। কারণ হাটে পর্যাপ্ত গরু থাকলেও, ক্রেতা নেই। ঢাকা দক্ষিণের কয়েকটি গরুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতারা দাম দর করে ফিরে যাচ্ছেন। হাটকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মানতে দেখা যায়নি হাট কর্তৃপক্ষ এবং অনেক ক্রেতা-বিক্রেতাকে।

তবে হাট কর্তৃপক্ষের দাবি, সরকারি স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনেই হাট পরিচালনা করছেন তারা। প্রথম দিকে কিছুটা অনিয়ম হচ্ছে। এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঠে কোরবানির পশুর হাট বসিয়ে শারীরিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মানানো অসম্ভব। স্বাস্থ্যবিধি মানাটাই চ্যালেঞ্জ হবে হাট কর্তৃপক্ষের জন্য।

ঢাকায় যেসব জায়গায় হাট বসেছে

ঢাকা দক্ষিণে যেসব জায়গায় পশুর হাট বসছে- উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘের মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, হাজারীবাগে ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজির মাঠসংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবসংলগ্ন গোপীবাগ বালুর মাঠ ও কমলাপুর স্টেডিয়ামসংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা, আফতাব নগর (ইস্টার্ন হাউজিং) ব্লক-ই, এফ, জি, এইচ ও সেকশন-১ এবং ২-এর খালি জায়গা, মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, ধুপখোলা মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠের পাশে ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালসংলগ্ন উন্মুক্ত জায়গা, আমুলিয়া মডেল টাউনের খালি জায়গা এবং রহমগঞ্জ খেলার মাঠসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গায় হাটগুলো বসবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার যেসব জায়গায় পশুর হাট বসেছে- ঈদুল আজহা উপলক্ষে ডিএনসিসি এলাকায় মোট ছয়টি পশুর হাট বসবে। এর মধ্যে একটি স্থায়ী হাট এবং পাঁচটি অস্থায়ী হাট। স্থায়ী হাটটি গাবতলীতে বসবে। অস্থায়ী পাঁচটি হাট হচ্ছে- উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে বৃন্দাবন হতে উত্তর দিকে বিজিএমইএ ভবন পর্যন্ত খালি জায়গা, কাওলা শিয়াল ডাঙ্গাসংলগ্ন খালি জায়গা, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বাচল ব্রিজসংলগ্ন মস্তুল ডুমনি বাজারমুখী রাস্তায় উভয় পাশের খালি জায়গা, ভাটারা (সাইদ নগর) পশুর হাট এবং উত্তরখান মৈনারটেক হাউজিং প্রকল্পের খালি জায়গা। এই হাটগুলোতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পশু আসতে শুরু করেছে। তবে গরু ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গরুর ঠিক দাম পাবেন কি-না, তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইড লাইন

হাট বসানোর জন্য পর্যাপ্ত খোলা জায়গা নির্বাচন করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বন্ধ জায়গাতে হাট বসানো যাবে না। হাট ইজারাদার কর্তৃক হাট বসানোর আগে মহামারি প্রতিরোধসামগ্রী (যেমন- মাস্ক, সাবান, জীবাণুমুক্তকরণ সামগ্রী ইত্যাদি) সংগ্রহ করতে হবে। পরিষ্কার পানি সরবরাহ ও হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল সাবান বা সাধারণ সাবানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

পশুর হাটের সঙ্গে জড়িত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও হাট কমিটির সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। হাট কমিটির সবার ব্যক্তিগত সুরক্ষা জোরদার করা এবং মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক ছাড়া কোনো ক্রেতা-বিক্রেতা হাটের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন না। প্রতিটি হাটে সিটি করপোরেশন কর্তৃক ডিজিটাল পর্দায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করতে হবে। পশুর হাটে প্রবেশের গেট (প্রবেশপথ ও বের হওয়ার পথ) নির্দিষ্ট করতে হবে। পর্যাপ্ত পানি ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পশুর বর্জ্য পরিষ্কার করতে হবে। কোথাও জলাবদ্ধতা তৈরি করা যাবে না। 

মেডিক্যাল টিমের কাছে তাপমাত্রা মাপার জন্য ডিজিটাল থার্মোমিটার রাখা যেতে পারে যাতে প্রয়োজনে হাটে আসা সন্দেহজনক কোনো আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিহ্নিত করা যায়। এ ছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে রোগীকে আলাদা রাখার জন্য প্রতিটি হাটে একটি আইসোলেশন ইউনিট (একটি আলাদা কক্ষ) রাখা যেতে পারে।

একটি পশু থেকে আরেকটি পশু এমনভাবে রাখতে হবে যেন ক্রেতারা কমপক্ষে দুই হাত দূরত্ব বজায় রেখে পশু ক্রয় করতে পারেন। ভিড় এড়াতে মূল্য পরিশোধ ও হাসিল নেওয়া কাউন্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মূল্য পরিশোধের সময় সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়ানোর সময় দুই হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়াতে হবে। প্রয়োজনে রেখা টেনে বা গোল চিহ্ন দিয়ে দিতে হবে।

ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। সর্দি, কাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্ট নিয়ে কেউ হাটে প্রবেশ করবেন না। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থরা হাটে আসতে পারবেন না। পশুর হাটে প্রবেশের পূর্বে ও বের হওয়ার সময় তরল সাবান বা সাধারণ সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধৌত করতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের উদ্বেগ 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্রিভেনটিভ মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে কোরবানি ও কোরাবানির পশু বিক্রি বাদ দেওয়া যাবে না; কিন্তু হাট বসিয়ে পশু বিক্রির ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সোনার পাথর বাটির মতো। এটি যদি করা হয়, তাহলে পশুর হাটেই সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হবে বলে আমি মনে করছি। রোজার ঈদেও দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়েছিল শর্ত সাপেক্ষে; কিন্তু এসব শর্ত শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষই মানেনি।’

পশুর বর্জ্য সরাবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন

করোনাকালীন নাগরিকদের সুরক্ষায় পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দ্রুততর সময়ে নগর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে মাঠে নামছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২৪ ঘণ্টার আগেই কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ করা হবে বলে তারা দাবি করেছে।

দরদাম নিয়ে ব্যাপারীরা শঙ্কায়

ধুপখোলা খেলার মাঠ পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে পর্যপ্ত পশু রয়েছে। ক্রেতা আসছেন কম। অনেকের মুখেই মাস্ক বা হাতে গ্লাভস নেই। ব্যাপারীরা গরুর ন্যায্যমূল্য নিয়ে শঙ্কায় আছেন। সিরাজগঞ্জ থেকে আব্দুল মান্নান প্রতি বছর এখানে তার গরু নিয়ে আসেন। বন্যা সত্ত্বেও তিনি এবার এসেছেন। তবে ক্রেতার এত কম উপস্থিতি তিনি এর আগে দেখেননি।

তিনি জানান, ‘এবার কেনাবেচা নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছি। করোনাভাইরাসের কারণে ক্রেতা যেমন কম, তেমনি পশুর দামও কম। গত বছর ছোট গরু ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, মাঝারি গরু ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা এবং বড় আকৃতির গরু ৯০ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি; কিন্তু এখন যে অবস্থা দেখলাম, তাতে মনে হচ্ছে এবার গতবারের অর্ধেক দামে গরু ছেড়ে দিতে হবে।’

একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পোস্তগোলা-শ্মশান ঘাট হাটের আরেক ব্যাপারী পাবনার জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবার হয়তো ক্রেতা কম আসবেন। অনেকে এবার কোরবানি নাও দিতে পারেন। তাই আশঙ্কাটা বেশি কাজ করছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //