করোনা কেলেঙ্কারির গডফাদার কারা?

মহামারি করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) ব্যবস্থাপনায় জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারি যেন পিছু ছাড়ছেই না স্বাস্থ্য বিভাগের। একের পর এক জালিয়াতির কথা বেরিয়ে আসছে। তার মধ্যে রয়েছে করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার ঘটনাও।

র‌্যাবের অভিযানে ধরা পড়ে ভয়াবহ জালিয়াতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র। আর এ পর্যন্ত জালিয়াতির যে চিত্র সবাইকে আবার চমকে দিয়েছে তা হলো মোহাম্মদ সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। কভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতাল করোনার টেস্টের নামে রোগীদের থেকে নমুনা নিয়ে টেস্ট না করেই রিপোর্ট দিয়ে দিতো। সে টেস্টের জন্য একদফা রোগীদের থেকে ফি নিত। আবার সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী রোগীদের ফ্রি টেস্ট করিয়েছে দেখিয়ে সরকারের থেকে টাকা নিত। র‌্যাবের অভিযানে বেরিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির এমন আরো বহু কেলেংকারির চিত্র।

করোনার টেস্ট নিয়ে বড় ধরনের জালিয়াতি করে জুনের শেষ সপ্তাহে ব্যাপক আলোচনায় আসে জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার (জেকেজি) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভের মুখে পড়েন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল চৌধুরী ও তার স্ত্রী ডাক্তার সাবরিনা।

জেকেজি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে করোনার টেস্টের জন্য রোগীদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে অনেকগুলো বুথ স্থাপন করে। হাজার হাজার নমুনা সংগ্রহ করে তার টেস্ট না করেই রোগীদের রিপোর্ট দিয়ে দেয়া হতো। এরাও সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী রোগীদের থেকে টাকা না নেয়ার কথা থাকলেও তিন থেকে পাঁচ হাজার বা তারও বেশি করে টাকা নিয়েছে প্রতি রোগীর কাছ থেকে।

স্বাস্থ্য খাতে ভয়াবহ সিন্ডিকেটের প্রধান মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু, রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মহা প্রতারক শাহেদ করিম এবং জেকেজি হেলথ কেয়ারের বিতর্কিত ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী কী করে নানামুখী অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন, কারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন, এ নিয়ে সব মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরাও। প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আড়ালের গডফাদারদের চিহ্নিত করে তাদের মুখোশ উন্মোচন করার দাবি তুলেছেন সবাই।

বিশিষ্টজনেরা বলেন, এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মূলে আঘাত করতে হবে। বিচারের আওতায় আনতে হবে গডফাদারদেরও।

জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতাল করোনা টেস্টের জন্য সংগৃহীত নমুনা মহাখালী ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ (জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এই তিনটি প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে পরীক্ষা করানোর কথা। কিন্তু নমুনা না পাঠিয়েও এই প্রতিষ্ঠানের নামে রোগীদের করোনা টেস্টের রিপোর্ট দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল।

এছাড়াও এই হাসপাতালটি আইইডিসিআর ও নিপসমের প্যাড-সিল জালিয়াতি করেও রিপোর্ট দিয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কয়েকজন কর্মচারী অভিযোগের বিষয়ে র‌্যাবের কাছে স্বীকারও করেছেন। র‌্যাবের অভিযান চলাকালে জালিয়াতির অনেক রিপোর্ট, কাগজপত্র এবং রোগীদের কাছ থেকে সংগৃহীত নমুনা রিজেন্টের ওই অফিসে দেখা গেছে।

সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি করা যাবে এবং চিকিৎসার সব খরচ সরকারের। পরীক্ষার জন্য কোনো টাকা নেয়ারও কথা না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষার জন্য টাকা নেয়। হাসপাতালটি করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের সময় প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে নিত। অথচ কোনো ধরনের পরীক্ষা না করেই তারা রোগীদের মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে দিত। তারা করোনা নেগেটিভ, কারোনা পজিটিভ রিপোর্ট দিত। এভাবে ভুয়া পরীক্ষা থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল।

প্রতারণা আর চাপাবাজি দিয়েই উত্থান হয়েছিল রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের। একসময় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন। কিন্তু তার টিকিটির নাগালও পায়নি কেউ। কারণ তিনি নিজেকে কখনো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনো গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টকশোতে অংশ নেয়াও শুরু করেছিলেন তিনি। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তারা প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন। এর বেশির ভাগই প্রতারণা মামলা।

জানা গেছে, রিজেন্টের বিতর্কিত সাহেদকে নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। সাহেদ ঢাকার বাইরে গিয়ে পুলিশ প্রটোকল নিতেন। তার এক কর্মী চাকরি ছেড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দূতাবাসের সহায়তায় তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। যথারীতি ব্যবসা করেছেন মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী দুটি হাসপাতাল ও একটি হোটেল থেকে।

অবৈধ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা দিতে আবার চুক্তিও করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে। তার এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি নয়, উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে এলজিআরডি সচিবসহ আরো অনেক প্রভাবশালী আমলাকেও। রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে সাহেদকে নিয়মিত দেখা যেত। সাহেদের এই বিশাল ক্ষমতার পেছনের গডফাদারদের নাম প্রকাশেরও দাবি জানিয়েছেন অনেকে।

প্রশ্ন উঠেছে, স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর এ বিশাল সাম্রাজ্য কীভাবে তৈরি হলো। ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে গত ১১ বছরে মিঠু হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। মিঠু ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করে। সেজেছেন স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া। দাবি উঠেছে মিঠুর আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও মুখোশ উন্মোচন করার।

করোনাকালে আরেক বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা আরিফ ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী। দুজন মিলে গড়ে তুলেছেন জিকেজি হেলথ কেয়ার নামে করোনার ভুয়া রিপোর্ট তৈরির কারখানা। এক ল্যাপটপ থেকেই তারা দিয়েছেন করোনা টেস্টের ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া রিপোর্ট। ন্যূনতম একটি ট্রেড লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও কী করে এই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর চুক্তি করল? কারা তাদের এই সুযোগ তৈরি করে দিলেন? কী কারণেই বা তাদের এমন সুযোগ দেওয়া হলো? এসব নিয়েও প্রশ্ন সব মহলে।

গডফাদারদের বিষয়ে বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেন, মিঠু, সাহেদ বা ডা. সাবরিনারা কিন্তু নিজে নিজে গড়ে ওঠেনি। তাদের পেছনের শক্তি হিসেবে সব সময় কেউ না কেউ কাজ করেছেন। বর্তমানে নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই কেউ পেছন থেকে এদের মদদ দিয়ে আসছেন। আবার অন্য সরকারগুলোর সময়ও কেউ না কেউ তাদের মতো অপরাধীদের মদদ দিয়েছেন। তাই শুধু তাদের বিচার করলেই চলবে না। এসব অপরাধের মূলোৎপাটন করতে হবে। আঘাত করতে হবে গোড়ায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, করোনাভাইরাস যেমন একটি শারীরিক ব্যাধি, তেমনি দুর্নীতিও একটি সামাজিক ব্যাধি। এখন যারাই ধরা পড়েছেন, তারা হচ্ছেন সেই ব্যাধির উপসর্গ। তারা কখনোই এসব অনিয়ম-দুর্নীতি একা একা করতে পারতেন না। তাদের পেছনে অবশ্যই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন।

তিনি বলেন, আমাদের শরীরে কোনো ব্যাধির উপসর্গ দেখা দিলে আমরা যেমন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হই এবং নির্মূল হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করি, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি বিতর্কিত ঘটনার মতো সব ধরনের দুর্নীতির ঘটনায়ই শুধু চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার করে বসে থাকলে হবে না, এদের পেছনে কারা আছেন, কারা তাদের মদদ দিয়েছেন, তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে যারা অভিযুক্ত হন, যাদের ধরা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান শুধু তাদের নিয়েই তৎপর হয়। দুর্নীতির ক্ষেত্রে কান টানলে মাথা আসা উচিত। কিন্তু আমাদের জবাবদিহির জায়গাটা এমন একপর্যায়ে আছে, মাথা আসছে না। অর্থাৎ চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হয়। কিন্তু ঘটনার পেছনের রুই-কাতলাদের কিছুই হয় না।

তিনি বলেন, এর কারণ হচ্ছে, প্রভাবশালীদের যারা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে, প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার একটা সূত্র পাওয়া যায়। এই যে রাজনৈতিক যোগসাজশ, এর সঙ্গে দুর্নীতির ক্ষেত্রে সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, অংশগ্রহণ ও সুরক্ষা যোগ হয়। প্রশাসনিক দিক থেকেও একই অবস্থা চলে আসছে। প্রশাসনও তাদের সুরক্ষা দেয়ার পথ বেছে নেয়।

দুর্নীতির মূল হোতা, সেই রাঘববোয়ালরা একটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। শুধু যারা সামনে আছেন বা গ্রেফতার হচ্ছেন, তাদের বিচার করে বসে থাকলে হবে না। প্রতিটি ঘটনার গভীরে গেলেই কেবল দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক প্রতারক শাহেদ করিম, জেকেজি হেলথ কেয়ারের বিতর্কিত ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলেও এখনো অধরা মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //