করোনাকালে ভুতুড়ে বিলের খড়গ

মো. আনিসুজ্জামান, রাজধানীর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। থাকেন দারুসসালাম এলাকায়। মহামারি কভিড-১৯ শুরুর পর থেকে কাজ বন্ধ, বেতন পাচ্ছেন অর্ধেক। তাতে নানারকম টানাপড়েনে জীবন চালাচ্ছেন। অভাব-অনটন আর করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে যখন দিন পার করছেন, ঠিক তখনই হাতে এসে পড়ে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ। ঘরে তিনটি ফ্যান, পাঁচটি এলইডি লাইট আর একটি ফ্রিজ। প্রতি মাসে এভারেজ বিল আসে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। গত মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ৮৫৫ টাকা। তাতে অবাক হননি তিনি। এবার তার হাতে এপ্রিল মাসের বিল এসেছে ২ হাজার ৩৫০ টাকা। 

সাম্প্রতিক দেশকালের এই প্রতিবেদককে বিলের কপি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ তো বিদ্যুৎ বিল না দিতে পেরে সুইসাইড করবে। মহামারিতে সাধারণ মানুষ যেখানে একটু সরকারি সাহায্য-সহানুভূতি পাবে, তা না উল্টো গলায় রশি দিয়ে যেন টাকা আদায় করে নেয়া হচ্ছে! কিন্তু কেন? এই শহরে এক যুগের বেশি সময় ধরে আছি, এমনটা আগে কখনো দেখিনি।’ আনিসুজ্জামান জানান, তার ফ্ল্যাটের ওপরের তলায় মাসুম বিল্লাহ নামের ব্যক্তির বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৪ হাজার ৪০০ টাকা, যা সাধারণত আসে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। 

সারাদেশে মহামারি পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে যেমন তোলপাড় চলছে, তেমনি রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের সাধারণ মানুষের মধ্যে তোলপাড় চলছে ভৌতিক বিদ্যুৎ বিল নিয়ে। রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ বিল এসেছে অনেক বেশি। অনেক জায়গায় মার্চ-এপ্রিলের বিলের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বিল এসেছে মে মাসে। কোথাও কোথাও এমনকি স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি বিল এসেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ভুতুড়ে বিল নিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশও অনেকাংশে উপেক্ষা করা হয়েছে। একদিকে বাড়তি বিল, অন্যদিকে চলতি জুন মাসে বিল পরিশোধের আলটিমেটাম। সব মিলিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন গ্রাহকরা।

কতটা ভোগান্তির স্বীকার হয়েছেন কে বা কারা- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করা হয়। সেখানে জমা পড়ে অসংখ্য অভিযোগ। রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার সুকন্যা আমিরের মে মাসের বিল এসেছে ১ হাজার ৫৭২ টাকা, সাধারণত তার বিল আসে ৬০০ টাকার মধ্যে। জান্নাতুল ফেরদৌস মানুর বিল এসেছে ৪ হাজার ১০০ টাকা, তার দাবি সর্বোচ্চ বিল আসে ৮০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘সবার কাছ থেকে এত বাড়তি বিল নিয়ে ওরা এই করোনাভাইরাস ক্রাইসিসকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।’

দারুসসালাম এলাকার আরেক বাসিন্দা নূরমহল বেগম রানি বলেন, তার বিল এসেছে তিনগুণ। বিলের কাগজে দেখা যাচ্ছে মে মাসে তার বিল এসেছে ৪ হাজার ১৫১ টাকা। তার দাবি, গড়ে ৫৬০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল হয়ে থাকে।

আকাশ ছোঁয়া বিল দিয়েছেন বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার রিফাত নিগার শাপলা। বিলের কপিতে দেখা যাচ্ছে মে মাসে তার বিল এসেছে ৩১ হাজার ৩১৩ টাকা। এমন আশ্চর্যজনক বিলের হিসাব দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন রিফাত নিগার। তিনি বলেন, ‘এটা কেমন হিসাব, কেমন করে এত টাকার বিল আসে? এসব দেখার কি কেউ নেই দেশে! বিলের তফাত এত কম-বেশি কীভাবে হয়! 

শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও এমন ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার লাবণী মণ্ডল জানান, যেখানে তাদের দুই মিটারে বিদ্যুৎ বিল আসতো যথাক্রমে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে, সেখানে এবার বিল এসেছে যথাক্রমে ১ হাজার ৭৫০ এবং ১ হাজার ৮৪৫ টাকা। একই রকম অভিযোগ জেলার অন্যান্য স্থান থেকেও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য তা তো বিলের কপি হাতে নিলেই বোঝা যাচ্ছে। 

কিভাবে এমন অসম্ভব বাড়তি বিল করা হলো? জবাবটা সহজ। অঘোষিত লকডাউন শুরু হলে পরপর দুই মাস কোনো মিটার রিডার কারো বাসায় গিয়ে মিটার পর্যবেক্ষণ করেননি। এ কারণে মার্চ মাসে গ্রাহকদের কোনো বিল পাঠানো হয়নি। মে মাসের মাঝামাঝি অনেকটা হঠাৎ করেই মার্চ ও এপ্রিল মাসের বিল একসঙ্গে গ্রাহকের কাছে পাঠানো হয়; কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে মিটার রিডাররা কোনো বাসায় না গিয়ে নিছক অনুমানের ভিত্তিতে এসব বিল তৈরি করেন। রাজধানীতে বিতরণকারী দুই সংস্থার মধ্যে ডিপিডিসির গ্রাহকদের অভিযোগ বেশি। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানিয়েছেন, কোথাও জরিমানা আদায় করা হলে সেটি সমন্বয় করা হবে। তিনি অনেকটা দায়সারা জবাব দিয়েছেন মিডিয়ার কাছে- বিল আসলে বেশি আসছে না। আগের দুই মাস রিডিং নেয়া হয়নি। এবার রিডিং নিয়ে আগের দুই মাস বাদ দিয়ে বিল করায় অনেকেরই মনে হচ্ছে বিল বেশি এসেছে। এর পরও কারো যদি কোনো বিলের বিষয়ে অভিযোগ থাকে, তিনি তা স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে জানাতে পারেন। ভুল থাকলে ঠিক করে দেয়া হবে। 

তবে বাস্তবে বাড়তি বিল নিয়ে মানুষের ভোগান্তি সহজে মিটছে না। গত তিন মাসের বাড়তি বিলের এই ধকল পোহাতে হচ্ছে অনেককেই। বিপাকে পড়েছেন আর্থিক টানাপড়েনে থাকা মানুষ। বাড়তি বিলের ভোগান্তি নিরসনে বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে চিঠি দিয়েছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংস্থাটির জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘যে কোনো পাবলিক বডির কাছে পেশ করা কোনো নাগরিকের আবেদন ৪৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হতে হবে, ক্যাবের দায়ের করা রিট মামলায় হাইকোর্টেও এমন আদেশ হয়েছে। ফলে কমিশন দ্রুত তাদের আবেদনের পক্ষে পদক্ষেপ নেবে।’ 

ক্যাবের চিঠিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে মিটার রিডিং নেয়া সম্ভব না হওয়ায় গত তিন মাসের বকেয়া বিল মনগড়া হিসাবের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে এবং একসঙ্গে তা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ওইসব বিলে দাবিকৃত অর্থের হিসাবের কোনো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য ভিত্তি নেই। অভিযোগের পক্ষে যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বকেয়া বিলের পরিমাণ সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিমাণের চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা সরকারের ভোক্তাবান্ধব ঘোষণাকে ভোক্তাবিরোধী ঘোষণায় পরিণত করেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //