বর্ধিত ভাড়ার পরেও গণপরিবহনে চলছে নৈরাজ্য

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে কম যাত্রী তুলতে হবে বলে মালিকদের ক্ষতি পোষাতে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লা এবং নগর পরিবহনের বাস ও মিনিবাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু ভাড়া বাড়ানো হলেও গণপরিবহনে নৈরাজ্য থেমে নেই।

সরকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া আদায় করছে বাস কোম্পানিগুলো। নিরুপায় যাত্রা পথে নির্বিচারে পকেট কাটা হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। কোথাও কোথাও বাসে আগের মতোই চলছে গাদাগাদি করে। বর্তমানে লঞ্চঘাট, বাস স্ট্যান্ড, টার্মিনাল এবং রাস্তাঘাটের দৃশ্য ভয়াবহ, অনেক স্থানেই স্বাস্থ্যবিধির ন্যূনতম বালাই নেই।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করলেও তা নিয়ে আপত্তি করেছিল ভোক্তা ও নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো। শেষ পর্যন্ত ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে শর্তসাপেক্ষে সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট সংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার চলাচলকারী (ঢাকা মহানগর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগর) বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হলো।

২০১৬ সালের মে মাসের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের প্রতি কিলোমিটারের সর্বোচ্চ ভাড়া ছিলো এক টাকা ৪২ পয়সা। ৬০ শতাংশ বাড়ায় তা ২ টাকা ২৭ পয়সা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগরীতে বাস ও মিনিবাসের চলাচলের ক্ষেত্রে ২০১৬ সালের প্রজ্ঞাপনে সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণ করা ছিলো এক টাকা ৭০ পয়সা এবং চট্টগ্রামে ও এক টাকা ৬০ পয়সা। ৬০ শতাংশ বাড়ায় এখন তা যথাক্রমে ২ টাকা ৭২ পয়সা এবং ২ টাকা ৫৬ পয়সা হচ্ছে।


এছাড়া ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) আওতাধীন জেলার (নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলা) অভ্যন্তরে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসের ভাড়া আগে ছিলো প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৬০ পয়সা। এখন তা ৬০ শতাংশ বেড়ে ২ টাকা ৫৬ পয়সা করা হয়।

ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে চারটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয় প্রজ্ঞাপনে। একজন যাত্রীকে বাস/মিনিবাসের পাশাপাশি দুইটি আসনের একটি আসনে বসিয়ে অন্য আসনটি অবশ্যই ফাঁকা রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে শারীরিক দূরত্ব বজার রাখতে হবে। কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটে উল্লেখিত মোট আসন সংখ্যার অর্ধেকের বেশি যাত্রী বহন করা যাবে না এবং দাঁড়িয়ে কোনো যাত্রী বহন করা যাবে না।

বিদ্যমান হারে প্রচলিত ভাড়ার চার্টে যে ভাড়া আছে, তার সাথে এবারের বৃদ্ধির হার যোগ করে নতুন ভাড়া নির্ধারিত হবে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে বাস ও মিনিবাস চালাতে হবে।

কিন্তু শুরু থেকেই প্রজ্ঞাপনের সেই শর্ত মেনে চলছে না অধিকাংশ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। গণমাধ্যমে অনিয়মের খবর আসছে প্রতিনিয়ত। কোথাও কোথায় জরিমানা দিচ্ছে পরিবহনগুলো। তবুও তাদের অনিয়ম থেমে নেই।

জানা যায়, শেরপুরে সোমবার (১ জুন) ভাড়া বৃদ্ধির পরও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ করেন উপস্থিত অনেক যাত্রীরা। যাত্রীরা উপস্থিত শ্রমিকদের সামনেই অভিযোগ করে বলেন, ভাংতি না থাকায় মাত্র ২০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। শেরপুর-ঢাকার বর্ধিত ভাড়া হয় ৪৮০ টাকা কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে কাউন্টারে ভাড়া নেয়া হয় ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। এ সময় স্বাস্থ্যবিধির জন্য কোনো প্রকার হ্যান্ড স্যানিটেশন বা জীবাণুনাশক স্প্রে না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীরা।


কুষ্টিয়ায় সোমবার (১ জুন) সরকারি নির্দেশনা না মেনে শ্যামলী পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার দায়ে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৬০% বৃদ্ধিসহ কুষ্টিয়া থেকে ঢাকার ভাড়া ৭২০ টাকা হলেও ৮০০ টাকা আদায় করছিলো, এছাড়াও কুষ্টিয়া থেকে চট্টগ্রাম ১২০০ টাকার স্থলে আদায় করেছিলো ১৫০০ টাকা, কুষ্টিয়া থেকে কক্সবাজার ১৯২০ টাকার স্থলে ২১০০ টাকা এবং কুষ্টিয়া থেকে সিলেটের ১২০০ টাকার স্থলে ১৪০০ টাকা আদায় করছিলো।

বরিশালে বৃহস্পতিবার (৪ জুন) ভাড়া বৃদ্ধির পরেও যাত্রীদের কাছ থেকে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগে ৩টি যাত্রীবাহী বাসে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। 

চট্টগ্রাম অভিমুখী এস এ পরিবহন ও অন্তরা পরিবহন এবং ঢাকা অভিমুখী দিদার ট্রাভেলস নামক তিনটি বাসের বেশ কয়েকজন যাত্রী নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ ও তিনগুণ ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন। এতে দেখা যায়, বাসগুলোতে ৫০০-৭০০ টাকার ভাড়া প্রায় ১৫০০-১৬০০ টাকা করে নেয়া হয়।

শুধু জেলা শহরগুলোতে নয়, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগের চিত্র রয়েছে ঢাকাতেও। গাবতলী, মহাখালী, সায়দাবাদসহ অন্যান্য টার্মিনাল থেকেও যাত্রীদের থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া নির্দেশনা থাকলেও নেয়া হচ্ছে দ্বিগুণ ভাড়া।

করোনা শঙ্কায়ও অফিস-আদালত, মার্কেট-দোকানপাট খুলে যাওয়া এবং গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে শুরু করেছে রাজধানীবাসী। যাত্রীদের অভিযোগ, নতুন নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও অনেক বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। লঞ্চ ঘাটেও রয়েছে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় বরিশালে একটি লঞ্চ জব্দও করে পুলিশ।

তবে রাজধানীর রেল স্টেশনগুলোতে অনেকটা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলেছে বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেন। অনলাইনে টিকিট পেতে জটিলতার অভিযোগ করেন কেউ কেউ।


বাস টার্মিনালগুলো ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাস কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন ধরে টিকিটের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গাদাগাদি করেই টিকিটের জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তারা। আর সংক্রমণ রোধে সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিকদের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়নি কোনো ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা।

এছাড়া, আগের মতোই যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হচ্ছে। চালকের সহকারী আর কনডাক্টর টেনে টেনে বাসে যাত্রী তুলছেন সেই পুরনো কায়দায়। আর যাত্রীরাও সব ভুলে যেন মেতেছেন ধাক্কাধাক্কি করে আগেভাগে ওঠা-নামার প্রতিযোগিতায়।

তবে করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচল ও মার্কেট খোলা হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য সরেজমিনে কাজ করছে পুলিশ। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের জন্য নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //