লোকসানের ফাঁদে আটক কৃষক

ফের আশাহত কৃষক। গত জুলাই-আগস্ট মাসে বোরো ধানের দাম পায়নি কৃষক। উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক মূল্যে ধান বিক্রি করতে হয়েছিল। মাঠের পাকা ধান ঘরে না তুলে টাঙ্গাইল জেলার কৃষক মালেক সিকদার ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এ খবর টেলিভিশন, খবরের কাগজে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল।

গাইবান্ধার কৃষক নকুল বোরো ধান আবাদ করে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভেঙে পড়েননি। আমন ধানে লাভ হবে এমন আশা করেছিলেন (ত্রৈমাসিক দেশকাল, জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। কিন্তু আমন ধান কাটা সারা, তবুও অধরাই রয়ে গেল; কৃষকের আশা। বাজারে ধানের দাম নেই।

রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নে বাড়ি কৃষক রবিউলের। ধানের দাম প্রসঙ্গে তার সঙ্গে কথা হয় জানুয়ারি ২০২০-এর প্রথম সপ্তাহে। তিনি জানালেন, ‘বোরো ধান আবাদ করে পানির দামে বিক্রি করেছিলাম। আশা ছিল আমন ধানে লাভ হবে। আমার নিজের তিন একর জমিতে আমন ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হয়েছে। সরকার প্রতি মণ ধান ৯৭৫ টাকায় কিনবে জেনে ভেবেছিলাম এবার দাম পাবো। কিন্তু আমন ধানের দামও আমাকে হতাশ করল। লাভ তো দূর, প্রতি মণ উৎপাদন খরচের চেয়ে ২০০-৩০০ টাকা লোকসান। আমি খুব হতাশ! ধানি জমিতে ধান ছাড়া অন্য কিছু আবাদ করার উপায়ও নেই। পাঁচ জনের সংসার; ছেলে-মেয়ের লেখা-পড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি’ (রবিউলের সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত)। 


বস্তুত ধান উৎপাদন ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ফারাক বিশাল। কৃষক ধান উৎপাদন করে বছরের পর বছর লোকসান গুনছে। গত বোরো মৌসুমে (জুলাই-আগস্ট, ২০১৯) কৃষক বোরো ধানের দাম পায়নি। এবার আমনেও একই দশা। কেন এমন হচ্ছে? কোথায় গলদ? ধানের দামের এমন দশা হলে কৃষক বাঁচবে কি করে? আগামীতে ধান নিয়ে কৃষকের ভাবনা কি? রাষ্ট্র এবং সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। সর্বোপরি কৃষকের পক্ষ নিয়ে কিছু দিক নির্দেশনাও আছে। 

তথ্যের উৎস

প্রতিবেদনটি তৈরিতে ৩টি উৎস থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। সরকারি তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অফিস ও অধিদপ্তর থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, মাঠ পর্যায়ের কৃষি ও খাদ্য সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস, উপজেলা কৃষি অফিস, উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রকের কার্যালয় ও উপজেলা খাদ্য পরিদর্শকের অফিস থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের কৃষক (বড়, মাঝারি ও ছোট কৃষক) থেকে পাওয়া তথ্যগুলোই মূলত এ প্রতিবেদনের মূল শক্তি। রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সরাসরি কৃষক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। 

সরকারি অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও পর্যালোচনা

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও উপজেলা পর্যায় থেকে ধান ও কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রাপ্ত তথ্যের আলোচনা থাকছে এ অধ্যায়ে। 

আমন ধান সংক্রান্ত তথ্য

সারাদেশে ২০১৯-২০ সালে আমন ধান আবাদ হয়েছে ১৪৫ লাখ একর জমিতে। মোট আমন ধান উৎপাদন হয়েছে ২৩১ লাখ টন অর্থাৎ ৬২ কোটি মণ (৩৭.৫ কেজি = ১ মণ)। প্রতি একরে গড় ফলন হয়েছে ১.৫৯ টন অর্থাৎ ৪২ মণ (সূত্র : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)। সরকার (খাদ্য মন্ত্রণালয়) সারাদেশে মোট ৬ লাখ টন অর্থাৎ ১ কোটি ৬০ লাখ মণ ধান ক্রয় করছে এবার। সারাদেশের মোট উৎপাদিত আমন ধানের ২.৫৮ শতাংশ মাত্র ক্রয় করছে সরকার । সারাদেশে ১ কোটি ৬৯ লাখ নিবন্ধিত কৃষক আছে। অর্থাৎ প্রতিটি কৃষক পরিবার থেকে সরকার ৩৬ কেজি ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। আর হাসকিং মিল মালিকদের মাধ্যমে ৪ লাখ টন অর্থাৎ ১ কোটি ৭ লাখ মণ চাল ক্রয় করেছে।

বোরো ধান সংক্রান্ত তথ্য

২০১৯-২০ সালে বোরো ধান আবাদ হয়েছে ১২০ লাখ একর জমিতে। মোট বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে ৩০৬ লাখ টন। প্রতি একরে গড় ফলন হয়েছিল ২.৫৫ টন (সূত্র: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)। সরকার সারাদেশে মোট ৪ লাখ টন অর্থাৎ ১ কোটি ৭ লাখ মণ বোরো ধান ক্রয় করেছিল, যা সারাদেশের মোট উৎপাদিত বোরো ধানের ১.৩০ শতাংশ মাত্র । সারাদেশে ১ কোটি ৬৯ লাখ নিবন্ধিত কৃষকের মাঝে ভাগ করলে প্রতিটি কৃষক পরিবারের ভাগে পরে ২৪ কেজি। 

উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বরে ঘুর্নিঝড় বুলবুলে আমনের ক্ষতি হয় ৪৬৭৯ হেক্টর জমি অর্থাৎ ১১৫৬২ একর জমি। ধান উৎপাদনে ক্ষতি ১৯৬৫১ টন অর্থাৎ ৫ লাখ ২৪ হাজার মণ। উপরোল্লেখিত আমন ধানের হিসাবে বুলবুলের কারণে ধানের ক্ষতি ধরা হয়নি। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় ধানের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে। আমন ধান একর প্রতি ৪২ মণ এবং বোরো ধান একর প্রতি ৬৮ মণ ফলেছে। কিন্তু সরকার নির্ধারিত ধানের দাম উৎপাদন খরচের প্রায় সমান। আবার ধানের সরকার নির্ধারিত দামও পাচ্ছে না কৃষক। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের চিত্র হতাশাজনক।


উৎপাদিত আমন ধানের মাত্র ২.৫৮ শতাংশ সরকার ক্রয় করেছে। আর বোরো ধানের মাত্র ১.৩০ শতাংশ ক্রয় করেছে সরকার । যে পরিমাণ ধান সরকারিভাবে ক্রয় করা হয় তা অতি নগন্য। ধানের নায্যমূল্য কৃষককে দিতে হলে সরকারি পর্যায়ে ক্রয় সম্প্রসারিত ও ধানের মূল্য বৃদ্ধি করা একান্ত জরুরী। সরকার যদি মোট উৎপাদিত ধানের ২৫-৩০ শতাংশ ক্রয় করার ব্যবস্থা করে তাহলেই কেবল কৃষক ধানের ভালো দাম পেতে পারেন। নিঃসন্দেহে সরকারি পর্যায়ে এমন উদ্যোগ একটি বিশাল যজ্ঞ। কিন্তু একটি বড় উদ্যোগ ছাড়া কৃষকের ধানের নায্যমূল্য নিশ্চিত করা যাবে না। 

দেশের উত্তরাঞ্চলের ধান উৎপাদন চিত্র

ধান নির্ভর অর্থনীতি দেশের উত্তরাঞ্চলে। ভৌগলিক অবস্থাটা ধান উৎপাদনের জন্য অনুকূল। কৃষক ব্যাপক ধান উৎপাদন করলেও দাম নেই ধানের। বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট আমন উৎপাদন ২৩১ লাখ টন অর্থাৎ ৬২ কোটি মণ। ২০১৯-২০ সালে শুধুমাত্র রাজশাহী বিভাগে আমন ধান উৎপাদন হয়েছে ৩৩ লাখ টন অর্থাৎ ৯ কোটি মণ। রংপুর বিভাগে আমন উৎপাদনের পরিমাণ ৪৯ লাখ টন অর্থাৎ ১৩ কোটি মণ। দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে মোট আমন ধান উৎপাদন ৮২ লাখ টন অর্থাৎ ২২ কোটি মণ। যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের ৩৬ শতাংশ। 



বাংলাদেশে জাতীয় মোট বোরো ধান উৎপাদন ছিল ৩০৬ লাখ টন অর্থাৎ ৮২ কোটি মণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শুধু রাজশাহী বিভাগে ৫৩ লাখ টন অর্থাৎ ১৪ কোটি মণ উৎপাদন হয়েছে। আর রংপুর বিভাগে বোরো ধান উৎপাদনের পরিমাণ ৫০ লাখ টন অর্থাৎ ১৩ কোটি মণ। দেশের ৮ বিভাগের মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে মোট বোরো ধানের উৎপাদন ২৭ কোটি মণ। যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের ৩৩ শতাংশ। 

উপরোক্ত তথ্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেই মোট উৎপাদিত ধানের এক তৃতীয়াংশ ধান উৎপাদন হয়। অতিমাত্রায় কৃষি নির্ভর অর্থনীতি হওয়ায় ন্যায্য দাম না পেয়ে এখানকার কৃষক চরম হতাশা। ধান উৎপাদনে কৃষকের অনিহা এবং হতাশা দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। 

সরকারি ধান ক্রয় শুভঙ্করের ফাঁকি

বাংলাদেশে ১ কোটি ৬৯ লাখ নিবন্ধিত কৃষক আছে। একটি কৃষক পরিবারের জন্য একটি কৃষি কার্ড। যদি প্রত্যেক কৃষক থেকে সরকার ধান ক্রয় করে তাহলে একজন নিবন্ধিত কৃষকের ভাগে পড়ে ৩৬ কেজি। এটা একেবারেই হাস্যকর। যেহেতু অল্প পরিমাণ ( উৎপাদিত আমন ধানের ২.৫৮ শতাংশ) ক্রয় করেছে সরকার, তাই লটারীর মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করা হয়। একটি উপজেলা (ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল) ও এর একটি ইউনিয়নের ধান ক্রয়ের চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হলো:

উপজেলায় মোট কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা ২৬৯৮১ জন। লটারীর মাধ্যমে ২৫৩৮ জন কৃষককে নির্বাচন করা হয়। লটারীতে নির্বাচিত প্রত্যেক কৃষক থেকে ১ টন অর্থাৎ ১০০০ কেজি শুকনা ধান (আদ্রতা ১৪%) ২৬ টাকা কেজি দরে সরকার ক্রয় করেছে। কৃষকের নিজস্ব চাতাল না থাকায় খাদ্য গুদামের উপযোগী করে ধান শুকাতে পারছেন না। আবার ব্যাংকে একাউন্ট করে ধান বিক্রির টাকা নিতে হয় । খাদ্য গুদামে ধান দেয়ার সময় ঘুষও দিতে হবে। ঘুষ না দিলে ধান নেয় না। কৃষক এতো ঝামেলায় যেতে চায় না। তাই লটারিতে বিজয়ী কৃষক কার্ডগুলি ব্যবসায়ী/মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। 

রানীশংকৈল উপজেলার ৫ নং বাচোর ইউনিয়নের চোপড়া গ্রামের ধান ব্যবসায়ী মোঃ আবু তাহের জানান, তিনি তার ইউনিয়নে লটারিতে বিজয়ী ৩০ জন কৃষকের কৃষি কার্ড প্রতিটি ২০০০-৫০০০ টাকায় কিনে নিয়েছেন। বাজার থেকে ধান ক্রয় করে শুকিয়ে খাদ্য গুদামে দিয়েছেন। বাজারে প্রতিকেজি শুকনা ধানের মূল্য ১৫ টাকা। বাজার থেকে কেনা ধান চাতালে শুকানোর পর কিছুটা কমে যায়। ১০০০ কেজি ধানের ক্রয় মূল্য ১৫০০০ টাকা। আর খাদ্য গুদামে ১০০০ কেজি ধানের বিক্রয় মূল্য ২৬০০০ টাকা।


খাদ্য গুদামের অফিসারকে প্রতি কেজিতে ১ টাকা দিতে হয় অর্থাৎ ১০০০ কেজি ধানে ১০০০ টাকা দিতে হয়। প্রতি কার্ডে চার-পাঁচ হাজার টাকা লাভ হয়। মোদ্দা কথায় কৃষক সরাসরি ধান দিতে না পেরে লটারিতে পাওয়া বরাদ্দ বিক্রি করে দেন মধ্যসত্বভোগী ও ফড়িয়াদের কাছে। ফড়িয়ারা ব্যবসায়ী, তবে তারা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আবু তাহের বলেন, “কৃষক প্রতি মণ ধান ৮০০ টাকা পেলেও মোটামুটি খুশি হতো। ফড়িয়ারা ঠিকই ৯৭৫ টাকা মণ পাচ্ছে খাদ্য গুদামে ধান সরবরাহ করে। ’’ 

পঞ্চগড় জেলার বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার দায়িত্বে থাকা খাদ্য পরিদর্শক বলেন, ‘কোন কৃষক ১৪% আদ্রতায় ধান দিতে পারে না। কারণ চাতালে শুকানো ছাড়া ১৪% আদ্রতা আসবে না। কৃষক চাতাল ছাড়াই প্রচলিতভাবে ধান শুকান। তাই সর্বনিম্ন ১৭% আদ্রতা থাকে কৃষকের ধানে। সরকার আদ্রতার নীতিমালায় পরিবর্তন এনে ১৭% করলে কৃষক খাদ্য গুদামে ধান দিতে পারবে। আর সরকারিভাবে ধান কেনার পরিমাণ বাড়াতে পারলে কৃষক ধানের দাম পেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ‘এই এলাকার প্রায় দুই শতাংশ কৃষক ধান আবাদ ছেড়ে দিয়েছেন।’

মাঠ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের চালচিত্র

এ অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্তরের কৃষক থেকে পাওয়া তথ্যগুলো আলোচনা করবো। ধানের নায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক যে সংকটে আছে তার চিত্র তুলে ধরা হবে এখানে। 

মাঝারি ও বড় কৃষক বেশি সংকটে

বাংলাদেশে কৃষক পরিবার বা খানা আছে ৩ ধরনেরঃ ছোট, মাঝারি ও বড় কৃষক। এখানে আমরা মাঝারি এবং বড় কৃষকের কথা বলবো। যাদের মালিকানায় ২০-২২ বিঘা (১ বিঘা= .৩৩ একর) আবাদযোগ্য জমি আছে তারাই মাঝারি কৃষক (কৃষি শুমারী, বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো, ২০১১)। বাংলাদেশের মোট ১০.৩৮% হচ্ছে মাঝারি কৃষক (বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো, ২০০৮)। বড় কৃষক তারা যাদের ৭.৫ একর বা তার অধিক জমি আছে (বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো, ২০১১)। বাংলাদেশে বড় কৃষক আছে ১.৭%। উল্লেখ্য, দেশে বড় কৃষক পরিবারগুলোর মালিকানায় আছে চাষযোগ্য জমির ৬৩.৩৭%।

মাঠ পর্যায়ে নিবিড় আলোচনা থেকে উঠে আসে মাঝারি এবং বড় কৃষকরা ধান আবাদ করে লাভবানতো হচ্ছেনই না, বরং ধান চাষ করে প্রতি বছর লোকসান গুণছেন। জমি চুক্তিতে আবাদ করার জন্য চুক্তি-বর্গা দিয়েও লাভবান হচ্ছেন না। ধান চাষে জমি ও উপকরণ মিলে বিনিয়োগ হচ্ছে ব্যাপক। কিন্তু দিনের শেষে লোকসান হচ্ছে। নিজের মালিকানায় ধানি জমি নিয়ে কোন পথে এগুনো যায় ভেবে পাচ্ছে না তারা। বগুড়ার একজন বড় কৃষকের কথা থেকে বোঝা যায় অবস্থাটা। 

কেস স্টাডি- এক: বড় কৃষক কেমন আছেন?

বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার একটি গ্রামের নাম উচরং। উচরং গ্রামটি “শাহ্ বন্দেগি” ইউনিয়নে। প্রায় সাড়ে তিনশত পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। গ্রামের চারিদিকে ধানি জমি। গ্রামের সবকটি পরিবার কৃষির সঙ্গে যুক্ত। বলা যায় গ্রামের লোকজনের প্রধান পেশা কৃষি। 

ইসমাইল। বয়স ৫০ বছর। বাবার একমাত্র সন্তান। পৈত্রিক সূত্রে ৯ একর জমির মালিক। তার জমিগুলো উর্বর এবং দুই ফসলি। কৃষি তার প্রধান পেশা। জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার আছে, সেচ যন্ত্রও আছে ইসমাইলের। প্রায় ৭ একর জমিতে এবার আমন ধান চাষ করেছেন। দুই একর জমি চুক্তি বর্গা দিয়েছেন।

ইসমাইল বলেন, “এবার তিন জাতের আমন ধান লাগিয়েছিলাম। ১০% জমিতে বিরি-৫১, বিরি- ৪৯ ধান প্রায় ৮০% জমিতে আর ১০% জমিতে স্বর্ণা-৫ (এটা ইন্ডিয়ান জাত) ধান আবাদ করেছি। সবগুলো ধান মোটা ধান নয়। কিছু মাঝারি চিকন। প্রতি একরে প্রায় ৪৮ মণ ধান হয়েছে। প্রায় অর্ধেক ধান বিক্রি করা হয়ে গেছে। প্রতি মণ (৩৭.৫ কেজি) ধান বিক্রি করেছি ৬০০-৬৫০ টাকা। ধান আবাদ করতে খরচ অনেক। প্রতি একর ধান রোপন করতে খরচ হয়েছে ৩০০০ টাকা, আর প্রতি একর ধান কাটতে লেগেছে ১২ হাজার টাকা। প্রতি মণ ধানের দাম ৮৫০-৯০০ টাকা হলে খরচটা উঠে আসতো।


আমার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কলেজ - ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। এদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। বাবার অসুস্থতা, চিকিৎসা বাবদ প্রতিদিন খরচ আছে। ইলিশ মাছ প্রতি কেজি ১০০০ টাকা। এক মণ ধানেও একটা ইলিশ হয় না। অথচ পরিবারে মাসে ৭ কেজি পেয়াজ লাগে। পেয়াজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সংসারের খরচ চালানোও বড়ই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এক বিঘা জমি (.৩৩ একর) বিক্রি করার জন্য এক মাস ধরে চেষ্টা করছি, গ্রাহক নাই। ৪/৫ বছর আগে এক বিঘা জমি ৭/৮ লাখ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এখন আমি ৬ লাখ টাকা দাম চাই কিন্তু গ্রাহক পাচ্ছি না। ৫ লাখ টাকা হলেও ছেড়ে দেবো জমিটা। মজুর শ্রেণির লোকজন ভালো আছে। তাদের কাজের অভাব নেই।

এই গ্রামের বশির, আমার প্রতিবেশী। শেরপুরে একটা দোকানে কাজ করে, জমিজমা ছিল না। দুই বছরের মধ্যে দুই বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছে। আবাদও করছে। গ্রামের একজন বড় কৃষক শোয়েব। এই শোয়েবের জমি বন্ধক নিয়েছে বশির। ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এক বিঘা জমির বন্ধকী মূল্য। জমির মালিক যখন টাকা ফেরত দেবেন তখন জমি ফেরত পাবেন - এই শর্তে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে কৃষক জমি বন্ধক দিচ্ছে, সে আর ফেরত নিতে পারছে না। মাঝারি এবং বড় কৃষকরা জমি বিক্রি এবং বন্ধক দিচ্ছে। জমি বন্ধক দেয়া-নেয়া বেশ চলছে এ এলাকায়। দিন মজুর শ্রেণির লোকজন জমি বন্ধক নিচ্ছে। তারা ভালো আছে, ভালো নেই মাঝারি ও বড় কৃষক’। 

অনুপস্থিত জমির মালিক ও বর্গাদার দু’পক্ষই সংকটে

অনুপস্থিত জমির মালিক হলেন তারা, যারা পৈতৃক বা ক্রয় সূত্রে ফসলি জমির মালিক। কিন্তু জমি নিজে আবাদ করে না। কর্মসূত্রে বা নানা প্রয়োজনে শহরে বসবাস করে, গ্রামে জমি জমা আছে। জমিগুলো বর্গা চুক্তিতে আবাদ হয়। ধানের দাম কম হওয়ায় জমির বর্গাচুক্তি মূল্য কমে যাচ্ছে। বর্গাদার চুক্তিভিত্তিক জমি আবাদ করতে আগ্রহ হারাচ্ছে। অনুপস্থিত জমির মালিকের জমি থেকে আয় কমে যাচ্ছে। আর এসবের মূলে আছে ধানের উৎপাদন খরচের তুলনায় বিক্রয় মূল্যের নিম্নগতি। 

দিনাজপুরের পার্বতীপুর শহরে একজন অনুপস্থিত জমির মালিকের সংগে নিবিড় আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য। 

কেস স্টাডি: দুই, আবেদ আলীর জমি থেকে আয় কমে যাচ্ছে

আবেদ আলির বয়স ৫৮ বছর। স্থানীয় একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক তিনি। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে বসবাস করেন। গ্রামের বাড়ি পার্বতীপুর শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে, ভবানীপুর গ্রামে। পৈতৃক সূত্রে আবেদ আলীর ২ একর ধানি জমি আছে। দুই ফসলি জমি। ভবানীপুর গ্রামের দু’জন প্রান্তিক কৃষক আবেদ আলীর দুই একর জমি চাষাবাদ করেন। চুক্তি-বর্গা শর্তে। কাসেম আলী ও মিজানুর এক একর করে জমি চাষ করেন। কাসেম আলী প্রায় ১০ বছর এবং মিজানুর গত ৫ বছর ধরে চুক্তি বর্গায় আবেদ আলীর জমি চাষ করে। প্রতি বছর আমন ধান কাটার পর অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে প্রতি একর জমি ২৮হাজার টাকায় চুক্তি বর্গা দেন আবেদ আলী।

চুক্তির শর্ত এক বছর বোরো এবং আমন ধান আবাদ করবে চুক্তি বর্গাদার। আবেদ আলী বলেন, ‘গত বছর বোরো ধানের দাম পায়নি কৃষক। চুক্তি বর্গাদার এবং নিজ জমিতে যারা ধান আবাদ করেছিলেন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। আমার জমিতে চুক্তি নেওয়া বর্গাদাররা প্রতি একরে প্রায় আট হাজার টাকা লোকসান গুণেছেন। আমন ধান আবাদ করে লাভের আশা করেছিলেন, কিন্তু আমন ধানেও লাভ হয়নি তাদের। মোটা ধান স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা, পাইজাম ইত্যাদি প্রতি মণ ( ৩৭.৫ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ৫৬০-৬০০ টাকায়। সরকার প্রতি মণ ধানের দাম নির্ধারণ করেছে এবং ক্রয় করছে ৯৭৫ টাকা মণ দরে। প্রতি কেজি ২৬ টাকা। কৃষক প্রতি মণ ধানের দাম ৮৫০ টাকা পেলেই খুশি, কিন্তু তা পাচ্ছে না কৃষক’। 

আবেদ আলী আরো কিছু তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য দিলেন। পার্বতীপুর এলাকার প্রায় ৬০ শতাংশ জমি আবাদ হয় চুক্তি বর্গায়। এ এলাকায় বড় কৃষকের সংখ্যা কম। অনুপস্থিত জমির মালিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই জমি বর্গা দেয়া ছাড়া উপায় নেই অনুপস্থিত জমি মালিকদের। 

আবেদ আলী বলেন, ‘কাশেম এবং মিজানুর দু’জনেই আমার বিশ^স্ত বর্গাদার। কিন্তু এবার দুজনেই আমার জমি আবাদ করতে চাচ্ছে না। কারণ তাদের লোকসান হচ্ছে। প্রায় ২০ দিন ধরে তারা একই কথা বলছে। আজ জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ (২০২০)। আজকেও তাদের সঙ্গে কথা হলো। কাশেম এবং মিজানুর দুজনেরই কথা- গত বছরের তুলনায় অর্ধেক টাকায় জমি পেলে তারা বর্গা-চুক্তি করবেন, না হলে না। আমি গত বছর ২৮ হাজার টাকা প্রতি একরে নিয়েছিলাম। এবার ২০ হাজার টাকা প্রতি একর চাচ্ছি, কিন্তু তারা রাজি হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমার মতো যারা কৃষি জমির মালিক এবং যারা চুক্তি-বর্গাতে জমি আবাদ করছে- দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত। আর সবকিছুর মূলে আছে ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া”।

ছোট ও প্রান্তিক কৃষকেরা কেমন আছেন ?

যে কৃষকের ২.৪ একর পর্যন্ত জমি আছে তাকে বলা হয় ছোট কৃষক। আর প্রান্তিক কৃষক হলো যাদের সামান্য জমি আছে এবং অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। প্রান্তিক চাষির সংখ্যা বিশাল। এই প্রান্তিক ও ছোট চাষিরা কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছে। ছোট ও প্রান্তিক চাষিরা সরকারি অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে এমন পরিসংখ্যান সরকারি পর্যায়ে থাকলেও বাস্তবে তা নেই। ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই)। বর্গাচুক্তিতে অন্যের জমি আবাদ করেও বিপদে আছে তারা। ধানের নায্যমূল্য না পাওয়াটাই একমাত্র কারণ। একজন ছোট চাষির জবানীতেই বাস্তব অবস্থাটা অনুধাবন করা যেতে পারে। 

কেস স্টাডি: তিন, ছোট কৃষক কেমন আছেন?

ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার রানীভবানীপুর গ্রামের কৃষক বিজয় কুমার। ধান আবাদ ও ধানের বাজার নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। বিজয় কুমার বলেন, ‘আমার ৬ বিঘা জমি আছে। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আমন ধান কাটা মাড়াই করে ৬৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করি। ২০ মণ ধান রেখে দিয়েছিলাম বেশি দামে বিক্রি করার আশায়। দিন যতই যায় ধানের দাম কমতে থাকে। আর রাখতে না পেরে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ৫২৫ টাকা মণ দরে বিক্রি করি। ৬৫০ টাকা বিক্রি করেও আমি ধানে লাভ করতে পারিনি, আবার বেশি দাম পাবার আশায় যে ধানগুলো রাখলাম- তারপর আরও দাম কমে গেল।


এবারও ধানের দাম নেই। আমরা কৃষক ধান আবাদ করে কখনো লাভের মুখ দেখতে পাবো কিনা তা জানি না। কমপক্ষে ৮০০-৯০০ টাকা মণ দাম পেলে ভালো হয়। শুধু ধানের আবাদ করে টিকে থাকতে পারছি না। তাই পাশাপাশি গরুর ব্যবসা করছি। মোটামুটিভাবে টিকে আছি। আবার গত ৩ মাস ধরে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ১৫০-২০০ টাকা। আমার মাসে ৪ কেজি পেঁয়াজ লাগে। বর্তমানে ১ কেজি আধা কেজি পেঁয়াজে সারা মাস চালাতে হচ্ছে। এক কেজি ইলিশ মাছ কিনতে গেলে প্রায় ২ মণ ধান বিক্রি করতে হবে। তাই এবার ইলিশ মাছও খেতে পারিনি।’ 

দিনমজুর শ্রেণির লোকজন অভাবে নেই। দিন মজুরির পাশাপাশি অকৃষি কাজও করে তারা। মাঝারি ও বড় কৃষক থেকে জমিও বন্ধক নিচ্ছেন এরা।

কেস স্টাডি: চার, আয় বেড়েছে কৃষি মজুরের

ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার রানীভবানীপুর গ্রামের বীরেন চন্দ্র রায়। পেশায় তিনি একজন কৃষি মজুর বা দিন মজুর। বলেন, ‘এই আমন মৌসুমে আমি ৬ জনের একটি দল নিয়ে কৃষকের ধান কাটি। ধান পাকা শুরু হলেই আমরা ঠিক করি কে কে মিলে দল গঠন করবো। এলাকায় এমন বেশ কয়েকটি কৃষি শ্রমিকের দল আছে। একেকটি দলে সর্বোচ্চ ১০-১২ জন পর্যন্ত লোক আছে। এবার আমন ধান ‘মুলান’ (স্থানীয় ভাষা) হিসেবে কাটা ও মাড়াই করছি। অর্থাৎ প্রতি মণ ধানে কৃষক কত কেজি ধান শ্রমিককে দিবে এই হিসাবকেই মুলান চুক্তি বলে। এবার কৃষককে প্রতি মণ ধান কেটে মাড়াই করে দিয়ে আমরা ১০-১১ কেজি ধান পাই প্রতি মণ ধানে। তবে মুলান চুক্তি হিসাব একেক মৌসুমে একেক রকম হয়।

ধানের দামের ওপর নির্ভর করে মুলান রেট। ধানের দাম বেশি হলে মুলান রেট কম হয়। ধানের দাম কম হলে মুলান রেট বেশি হয়। এবার সবচেয়ে বেশি রেটে মুলান ধান কাটা-মাড়াই করেছি। ১০-১১ কেজি করে নিচ্ছি প্রতি মণ ধান কাটা ও মাড়াই করে দিয়ে। এবার আমন মৌসুমে আমার দল নিয়ে ১ মাস ধরে কৃষকের ধান কাটা-মাড়াই করে প্রতি জন ১৫ মণ করে ধান পেয়েছি। তাছাড়া আমি নিজে দেড় বিঘা জমি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বন্ধক (চুক্তি) নিয়ে আমন আবাদ করেছি। দেড় বিঘা জমিতে ২৬ মণ ধান পেয়েছি। এবার কৃষকের বাড়ি থেকে ১৫ মণ আর আমার চুক্তি নেওয়া জমিতে ২৬ মণ; মোট ৪১ মণ ধান পেয়েছি। তার মধ্যে ১৫ মণ ধান সেদ্ধ করে চাউল করব ভাতের জন্য। আর বাকিটা বিক্রি করব। আমি সারাবছর কৃষকের জমিতে কাজ করি। অকৃষি কাজও করি। দৈনিক মজুরি ৩০০-৪০০ টাকা। আমার তিনটি গরু আছে। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, ছেলেটি ফার্নিচারের কাজ করে আর ছোট মেয়েটা স্কুলে যায়। সবমিলে আমি ভালোই আছি।’ 

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ কি? বিশেষজ্ঞ মতামত

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ কি-না এ বিতর্ক এখন বিদ্যমান। কোটি কোটি মণ ধান উৎপাদন হচ্ছে প্রতি বছর। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ এ বিষয়ে লিখেছেন, কৃষক ধান উৎপাদনে উৎসাহ পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রধান কৃষিজাত পণ্য ধান উৎপাদন নিয়েও শঙ্কা আছে। কোনো একটি দুর্যোগ হলে এবং ২ থেকে ৫ শতাংশ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলেই দেশে খাদ্য সংকট শুরু হয়ে যায়। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে ২০ লাখ টন ধানের উৎপাদন কম হয়। ২০১৭ সালে হাওড়ে হঠাৎ বন্যায় ৬ থেকে ১০ লাখ টন ধানের উৎপাদন কমে যায়। তখন বিশে^র খাদ্যঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম ঢুকে পড়েছিল। (প্রথম আলো, ৪ নভেম্বর ২০১৯) 

ধান উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলে কৃষক ধানের আবাদে লোকসান গুনছে। কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে কৃষকের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলে ধান/চালের দাম বাড়বে। কৃষকের লাভ হবে দুর্যোগ হলে। এমন সমীকরণ ভয়াবহ। ধান আবাদে কৃষক কিছুটা হলেও উৎসাহ হারাচ্ছে। এই প্রবণতা বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সরকারি আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। বাংলাদেশের কৃষক ধান আবাদে উৎসাহ হারালে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির চোরাবালিতে আটকে যাবে। প্রাসঙ্গিকভাবে রাখাল ছেলে ও বাঘের গল্পটা উল্লেখ করা যায় এখানে। 


এক রাখাল বালক কয়েকটি গরু নিয়ে মাঠে চড়াচ্ছে। এ সময় তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলো একটা। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল বাঘ! বাঘ!! বাঘ!!! তার চিৎকারে আশপাশের গ্রাম থেকে লোক ছুটে এলো। কিন্তু বাঘ নেই। রাখাল বালক হেসে কুটি কুটি। রাখাল বালক বার বার একই কান্ড করে। লোকজন বুঝতে পারে বালকের দুষ্টমি। ক’দিন পর সত্যিই গরুর পালে বাঘ পড়ল। আবার রাখাল চেঁচিয়ে উঠল বাঘ! বাঘ!! বাঘ!!! কিন্তু এবার গ্রামের লোকজন আর আসে না। বাঘ তার স্বভাবসিদ্ধ কাজটি করল। গরু আর বালককে খেয়ে চলে গেল। 

কৃষক ধান উৎপাদন বিমুখ হলে সত্যিই বাংলাদেশে খাদ্য সংকট হবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ এমন সংকটে যেন না পড়ে সেজন্য ধানের নায্যমূল্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্যোগ হলে কৃষকের ধান নষ্ট হয়। মাথায় হাত কৃষকের। আবার ধান উৎপাদন ভালো হলে, বাম্পার ফলন হলে দাম পায় না কৃষক। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। সরকার প্রতি বছর ধানের ভালো দাম দেওয়া জন্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না। আশায় আশায় বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। সরকার যেনো কৃষকের মুখে হাসি ফোটানোর পণ করে, তা ভাঙবার জন্যই। 

ধানে আনন্দ, ধানে বিষাদ

এবার আমন ধান উৎপাদন হয়েছে ৬২ কোটি মণ। পদ্ধতি হিসেবে ২৩১ লাখ টন। ধানের কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ ২১.৫০ টাকা (গওহার নঈম ওয়ারা, প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৯)। অর্থাৎ এক মণ (৩৭.৫ কেজি) ধান উৎপাদন করতে খরচ ৮০৬ টাকা। প্রতি মণ ধানের বাজার দর ৬০০ টাকা। যদিও চিকন এবং সুগন্ধি ধানের দাম বাজারে ভালো। কিন্তু এসব ধানের উৎপাদন খরচও বেশি; আবাদও হয় কম। মোটা ও মাঝারি চিকন চালের উৎপাদন দেশে ৮০%। অর্থাৎ ৮০% ধানি জমিতে মাঝারি চিকন ও মোটা ধানের চাষ হয়। ৬০০ টাকা মণ দরে বাজারে আমন ধান বিক্রি হচ্ছে এই ভরাট মৌসুমে। উৎপাদন খরচের চেয়ে ২০০-৩০০ টাকা কমে কৃষক ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। 

‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা’। দিজেন্দ্রলাল রায় রচিত কবিতা/গান। কালজয়ী দেশাত্মবোধক এ গানে বাংলার আপামর জনতা ও কৃষক আবেগে আপ্লুত। সবুজ সোনালি ধান ক্ষেতের মোহনীয় আকর্ষণে কৃষক-কিষানি আনন্দে মুখর। পৌষের পিঠাপুলির উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল অংশজুড়ে আছে; গ্রাম-শহর, নগর-বন্দরে সর্বত্র। কৃষকের ধান, কৃষকের আনন্দ- একই সূত্রে গাঁথা। 

কিন্তু ধানে কৃষকের আনন্দ যেন আজ সুদূর পরাহত। প্রতি মণ ধান ৮০০ টাকা উৎপাদন খরচ; আর বিক্রি ৬০০ টাকা। এ রকম একটি অবস্থায় কৃষকের হাসি কি থাকতে পারে? পিঠা-পুলির উৎসব-আনন্দে কি সে উদ্বেলিত হতে পারে? লাভের খাতায় শূন্য হলেও ‘আসলে আসল’ কথাটা বলা যায়। কিন্তু মণ প্রতি ২০০-৩০০ টাকা লোকসান ধানে। অর্থাৎ যে যত বেশি জমিতে ধান আবাদ করছে, লোকসানের ভার তার তত বেশি। এমন বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশের কৃষক। ধানের দামের এমন দশা কৃষক বস্তুতই দিশেহারা। 

ধানের ভালো দাম পাওয়ার স্মৃতি ভুলতে বসেছে কৃষক। ধানের ভালো দামের স্মৃতির কথা জানতে চাইলে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ধানের খুব ভালো দাম পাওয়ার কথা জানায় কৃষক। এ প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার বাডডাঙ্গী গ্রামের কৃষক খেজমত আলী বলেন, ‘২০০৭ ও ২০০৮ সালে প্রতি মণ ধানের দাম ছিল ৮০০ টাকা (আমন ও বোরো ধান দুটির ক্ষেত্রেই) । ওই সময় ধানের উৎপাদন খরচ ছিল বর্তমান খরচের অর্ধেক। ওই সময় সার-কীটনাশকসহ ধান উৎপাদনের প্রতিটি উপকরণের দাম কম ছিল।

এক বিঘা (.৩৩ একর) জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ হতো প্রায় ৫ হাজার টাকা। আর গত পাঁচ বছর ধরে ধান উৎপাদনে প্রতি বিঘায় খরচ হচ্ছে প্রায় ৮-৯ হাজার টাকা। ২০০৭-২০০৮ সালে প্রতি বিঘায় উৎপাদিত ধান বিক্রি করে লাভ হয়েছিল ৪০০০-৪৫০০ টাকা। আর এ বছর আমন (২০১৯-২০) আবাদ করে (স্বর্ণা ধান আবাদ করেছি) প্রতি বিঘায় প্রায় ৩ হাজার টাকা লোকসান। ধান আবাদ করতে ভয় লাগছে। কিন্তু ধানি জমিতে ধান না আবাদ করে কি করবো? ধানে আনন্দ নেই আর, আছে বিষাদ।’

পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা

যে কৃষক সবজি চাষ করেন, ফলের বাগান করেন এবং মাছ চাষ করেন তার- আয় আছে; লাভ হয়। কিন্তু এ সংখ্যাটা খুবই কম। কৃষকের মধ্যে যারা মূলত ধান চাষ করেন তারা সবাই বিপদে আছেন। আর ধান আবাদ করেন বাংলাদেশে প্রায় ৯৮ শতাংশ কৃষক। বাংলাদেশের কৃষি মূলত ধান নির্ভর। আর ধান চাষের সংগেই কৃষকের জীবন-জীবিকা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের (রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ) কৃষকেরা আছেন মহাবিপদে। যেহেতু ধানই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর।

শুধু উত্তরবঙ্গ নয় বাংলাদেশের কোনো কৃষকই বলেন না ধান আবাদ করে তার লাভ হয়েছে। সব কৃষকেরই একই কথা- ‘ধান আবাদ করে লাভ নেই; শুধুই লোকসান’। বাংলাদেশে বড় কৃষকের সংখ্যা কম। মাঝারি কৃষকও খুব বেশি আছে তা নয়। তবে জমি আছে তাদের। জমি নিজে চাষ করেন এবং বর্গা দেন। ফসলের আধা-আধি ভাগ বা তে-ভাগা ধরনের বর্গা-চুক্তির বিবর্তন হয়েছে। আজকাল নানান ধরনের বর্গাচুক্তির প্রচলন হয়েছে অঞ্চলভেদে। তবে বেশিরভাগ চুক্তি বছর ও ফসলভিত্তিক। সারা বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকার বিনিময়ে শুধু বোরো ধান বা আমন ধানের জন্যও বর্গাচুক্তি হয়। মাঝারি কৃষক ও বড় কৃষকের জমি বর্গা নেয় প্রান্তিক ও ছোট চাষিরা। ধানের দাম কম হওয়ায় ধান আবাদ করে জমির মালিক ও বর্গাদার কোন পক্ষই লাভ করতে পারছেন না। 

অন্যদিকে শ্রমিক-মজুর শ্রেণির লোকজনের আয় বেড়েছে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মজুরি যা ছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল এর কৃষক খেজমত আলী স্মৃতি হাতরিয়ে বলেন, ১৯৯৫-৯৬ সালে একজন কৃষি মজুরের দৈনিক মজুরি ছিল সর্বসাকুল্যে ১৫ টাকা। ওই সময় ১ কেজি চালের দাম ছিল ১০ টাকা। তখন এক দিনের মজুরির টাকা দিয়ে একজন দিনমজুর ১.৫ কেজি চাল কিনতে পারতেন। আর এখন একজন কৃষি মজুরের মজুরি কমপক্ষে ৩৫০ টাকা। বোরো বা আমন ধান কাটার সময় দৈনিক মজুরি বেড়ে ৫০০-৫৫০ টাকা হয়। বর্তমানে মোটা চাল প্রতি কেজি ২৫ টাকা।

এখন একদিনের মজুরির টাকা দিয়ে একজন দিনমজুর ১৪ কেজি মোটা চাল কিনতে পারেন। কৃষিমজুর অকৃষি কাজও করছে (রিকশা, ভ্যান চালায়)। তারা মাঝারি ও বড় কৃষক থেকে জমি বন্ধক নিয়ে আবাদ করছে। বগুড়া অঞ্চলে কৃষি-মজুরি বছরের কোনো সময়ে ৪৫০ টাকার নিচে থাকে না। আর ধান কাটা মৌসুমে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮০০-৯০০ টাকায় (সূত্র : বড় কৃষক ইসমাইল)। 


বস্তুত জমিতে ধান আবাদ করতেই ভয় পাচ্ছে কৃষক। কিন্তু ধানি জমি তো ধানে আবাদের জন্যই। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ যদি হয়েই থাকে, তা শুধু কৃষক এবং কৃষির অবদানের কারণে। ডালে-ভাতে বাঙালি কে না জানে। ধান উৎপাদন করে কৃষক খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে বাংলাদেশকে। অথচ বছর বছর ধানের দরপতন কৃষকের মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে। এমন অবস্থা সুখকর নয়। সরকারি ধান ক্রয় নীতিমালা ধান উৎপাদনকারী কৃষককে কোনোভাবেই সহায়তা করছে না। 

কৃষক যেন ধানের ভালো দাম পায় তার জন্য সরকার বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সংসদেও সংসদ সদস্যরা কথা বলেছে কৃষকের পক্ষে। কিন্তু বাস্তবে ওই সব আলোচনার প্রতিফলন নেই। এবার (২০১৯-২০) আমন ধান উৎপাদন হয় ৬২ কোটি মণ। সরকার কিনেছে মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ মণ। যা উৎপাদিত আমন ধানের ২.৫৮ শতাংশ। ধানের দামের ক্ষেত্রে এর প্রভাব মোটেও নেই। খোলা বাজারে ধান ৬০০ টাকার মধ্যে। উৎপাদন খরচের তুলনায় ২০০-৩০০ টাকা কম দাম প্রতি মণ ধানের। বাগাড়ম্বরপূর্ণ সরকারি ধান কেনা কর্মসূচীর মাধ্যমে কৃষকের কোন লাভ হচ্ছে না। কৃষির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশে; বাস্তবে কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে দিন দিন। 

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারে সরকারের শক্ত নিয়ন্ত্রন থাকে না এটা সত্য। কিন্তু কৃষকের উৎপাদিত ফসল/ধান আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার সোপান। তাই কৃষকের উৎপাদিত ধানের ভালো দাম নিশ্চিত করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। সরকার ধানের উৎপাদন, বিপণন ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ধান ক্রয় নীতি-কাঠামোতে পরিবর্তন এনে কৃষকের ধানের ভালো দাম নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি পর্যায়ে ধান ক্রয় সম্প্রসারিত করা একান্ত জরুরি। উৎপাদিত ধানের ২৫-৩০ শতাংশ সরকারিভাবে কেনার প্রস্তুতি থাকলে খোলা বাজারেই ধানের দাম বেড়ে যাবে। কৃষক আরও বেশি ধান উৎপাদন করবে। উৎপাদিত ধান থেকে চাল বানিয়ে বিদেশে রফতানি করা যেতে পারে।

সরকার ২৬ টাকা কেজি দরে ধান ক্রয় করছে। অথচ প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ২১.৫০ টাকা। ছোট, বড় ও মাঝারি সর্বস্তরের কৃষক ধান উৎপাদনে অনীহা প্রকাশ করছে। শতকরা ২/৩ জন কৃষক ধান আবাদে বিমুখ। কৃষক ধান আবাদে আস্থা হারালে মহাসংকটে পরবে দেশ। খাদ্য ঘাটতির অবস্থা সামাল দেয়া কঠিন হবে। তাই সর্বাগ্রে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। কৃষককে সব সময় জিতিয়ে দিতে হবে। বোরো এবং আমন ধানের ভালো দাম নিশ্চিত করার জন্য সরকারি পদক্ষেপই কৃষককে জিতিয়ে দিতে পারে। প্রতি কেজি ধানের দাম ৩৫ টাকা সরকারি মূল্য হলে কৃষক লাভবান হবে। কৃষক ধানের দাম পাবে। 

যে কৃষক ধান চাষ করছে তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে হবে। কারণ সে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। কৃষক যেন তার ধান উৎপাদন খরচের দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি করতে পারে; সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার। পাশাপাশি নাগরিক সমাজেরও জোড়ালো ভূমিকা থাকতে হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //