ড. আনিসুজ্জামান, এক বাতিঘরের মহাপ্রয়াণ

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লেখক, জাতীয় অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান আর নেই। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

বৃহস্পতিবার (১৪ মে) বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। তাঁর প্রতি রইলো  বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতাল পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম এটিএম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন, গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। বলা যায়, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ছিলো তাঁদের পরিবার।

কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু করেন আনিসুজ্জামান। ওখানে পড়েছেন তৃতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। পরে এদেশে চলে আসার পর অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। কিন্তু বেশিদিন এখানে পড়া হয়নি। এক বছর পরই পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় ভর্তি হন প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রিয়নাথ স্কুলের শেষ ব্যাচ। কারণ তাঁদের ব্যাচের পরেই ওই স্কুলটি সরকারি হয়ে যায় এবং এর নাম-পরিবর্তন করে রাখা হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে।

জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি অনার্স পাস করলেন এবং ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে এমএ পাস করার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীর প্রথম গবেষণা বৃত্তি পেলেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শূন্যতায় বাংলা একাডেমীর বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। সে সময়ে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শহীদ মুনীর চৌধুরীকে।

১৯৫৬ ও ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ “নীলকান্ত সরকার” বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ড. আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য যোগদান করেন। বিষয় ছিলো ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারায় ১৭৫৭-১৯১৮’। ১৯৬২ সালে তাঁর পিএইচডি হয়ে গেলো। তাঁর পিএইচডির অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিলো ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’। ১৯৬৪ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন ডক্টরাল ফেলো হিসেবে বৃত্তি পেয়ে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিলো ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস।

কর্মজীবনে আনিসুজ্জামান ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি ছিলেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষক। বাংলা একাডেমীর বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে আনিসুজ্জামান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। প্রথমে অ্যাডহক ভিত্তিতে চাকরি হলো তিন মাসের। চাকরি চলে যাওয়ার পর কয়েক মাস কর্মহীন থাকলেন। তারপর পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি পেলেন। এর কয়েক মাস পর অক্টোবর মাসে আবার যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। ১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন।

১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অবস্থান করেছিলেন। পরে ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন।

জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।তিনি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বোর্ড অব ট্রাস্টি।

অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান ২০১২ থেকে বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন।
তরুণ বয়সে আনিসুজ্জামান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এ ছাড়া শহীদজননী বেগম জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণ-আদালতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের গবেষণা, মৌলিক প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও সম্পাদিত বহু গ্রন্থ রয়েছে। এগুলো হলো- মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮) ও কাল নিরবধি (২০০৩)।

এছাড়া বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ অস্কার ওয়াইল্ডের An Ideal Husband এর বাংলা নাট্যরূপ ‘আদর্শ স্বামী’ (১৯৮২), আলেক্সেই আরবুঝুভের An Old World Comedy এর বাংলা নাট্যরূপ ‘পুরনো পালা’ (১৯৮৮)।

বেশ কিছু গ্রন্থ একক ও যৌথ সম্পাদনা করেছেন তিনি। সেগুলো হলো- রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮), বিদ্যাসাগর-রচনা সংগ্রহ (যৌথ, ১৯৬৮), Culture and Thought (যৌথ, ১৯৮৩), মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (১৯৮২-১৯৮৬), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (যৌথ, ১৯৮৭), অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ (১৯৯০), স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন (১৯৯২), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৩), নজরুল রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (যৌথ, ১৯৯৩), SAARC : A People’s Perspective (১৯৯৩), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা (১৯৯৫), নারীর কথা (যৌথ, ১৯৯৪), ফতোয়া (যৌথ, ১৯৯৭), আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী (১ম খণ্ড, যৌথ ২০০১), ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দসংগ্রহ (যৌথ ২০০৩), আইন-শব্দকোষ (যৌথ, ২০০৬) ইত্যাদি।

সাহিত্য কর্মে বিশেষ অবদান রাখার জন্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দেশে-বিদেশে বহু পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে আছে- ১৯৫৬ সালে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ১৯৬৫ সালে দাউদ পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি.লিট, এবং এ বছর শিক্ষা ও সাহিত্যে পদ্মভূষণ পেয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে এটি ঘোষণা করা হয়। ‘পদ্মভূষণ’ ভারতের তৃতীয় বেসামরিক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদক।

প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও প্রখ্যাত এ লেখকের জন্মদিন উপলক্ষে নির্মাতা শ্যামল চন্দ্র নাথ আনিসুজ্জামানের জীবন ও কর্মের ওপর ‘আলোকযাত্রা’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। এদিকে, আনিসুজ্জামানকে নিয়ে ‘বাতিঘর’ নামে আরো একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন মাসুদ করিম। ইতিমধ্যে কলকাতা, খুলনা ও লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে এর চিত্রায়ন করা হয়েছে।

ড. আনিসুজ্জামান আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ ও গবেষণায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। দুই হাত উজাড় করে তিনি আমাদের দিচ্ছেন, স্বার্থপরের মত আমরা নিচ্ছিও। কিন্তু এ যেন অফুরন্ত ভান্ডার। তাকে নিঃশেষিত করা যাচ্ছে না। বিস্ময়কর তার বাড়-বাড়ন্ত। এখনো সনিষ্ঠ জ্ঞান-তপস্যা তাকে পরিপূর্ণ করে রাখছে। বিদ্বৎসমাজে তার সচলতা, নিরলস পাঠদান, ক্রান্তি-মুহূর্তে সশরীর উপস্থিতি, নতুন প্রতিভার আবাহনে এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণ বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে সমুজ্জ্বল করে তুলছে। জ্ঞান চর্চায় তিনি আমাদের গর্বিত দিশারী।

ড. আনিসুজ্জামানের নিকট থেকে আহরণের কোনো শেষ নেই। এ আহরণের অন্যতম প্রক্রিয়া হলো তাকে, তার জীবন ও কর্ম নিয়ে অব্যাহত চর্চা করা। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে পাঠ করা। সে প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তিনি নিজে সবাইকে প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন, প্রচেষ্টা চলছে তার গভীরে ঢুকেও প্রেরণা নিজেদের ভেতর সঞ্চারিত করার। এ জন্য তাকে কেন্দ্র করেই কিছু প্রকাশনা বেরুচ্ছে। তার প্রতিভার ও কর্মক্ষেত্রের বহুমাত্রিকতা আবিষ্কারের চেষ্টা হচ্ছে। এ শুধু তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নয়, সৃজনশীলতা, গবেষণা, শিল্পধর্ম, মানবিক মূল্যবোধ ও প্রগতিশীলতার রসদ সংগ্রহের জন্য; তার ভিতর দিয়ে নিজেদেরকে আবিষ্কারের জন্য।

ইতোমধ্যে তাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রকাশনা হয়েছে- আনিসুজ্জামান: সংবর্ধনা-স্মারক, আনিসুজ্জামান: বাঙালি মনীষার প্রতিকৃতি আনিসুজ্জামান দীপ্র মনীষা। প্রকাশিত হয়েছে তার কর্মমুখর জীবন নিয়ে চন্দ্রাবতী একাডেমীর দুটি আলোকচিত্র গ্রন্থ সেলিনা হোসেন সম্পাদিত: আলোয় ভুবন ভরা’ এবং মাহফুজুরর রহমান সম্পাদিত ‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়’। তাকে নিয়ে সর্বশেষ প্রকাশনাটি হলো খুলনা কবিতালাপ প্রকাশিত মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সম্পাদিত ‘আনিসুজ্জামান: বাঙালির শেকড়সন্ধানী’। এ ছাড়া ড. আনিসুজ্জামানের স্মৃতিচারণ গ্রন্থ দুটি রয়েছে ‘কাল নিরবধি’ ও বিপুলা পৃথিবী’।

আনিসুজ্জামানকে নিয়ে যারা লিখেছেন, কথা বলেছেন, স্মৃতিচারণ করেছেন, তারা তাদের দৃষ্টি থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন, আবিস্কার করতে চেয়েছেন। কেই দেখেছেন তাকে সম্মানিত শিক্ষক স্যার হিসেবে-বিমোহিত হয়েছেন তার ক্লাস-লেকচারে কিংবা বক্তৃতায়। কেউ দেখেছেন বন্ধু বৎসল সহপাঠি সজ্জন। কেউ বলেছেন বিজয়ী বোধসত্ত্ব। বাঙালি মনীষা, জ্ঞানী ও গুণি, অকৃত্রিম বাঙালি, সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রিয় মানুষ, শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়, এ প্রজন্মের অনুপম প্রতিনিধি, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, ভাব-শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তচিন্তার প্রবক্তা, বাঙালির বিবেক, প্রদ্যোত, দিশারী, বাতিঘর-শ্রদ্ধার নানান প্রকাশ।

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ তাকে উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের সময়ের চিন্তা চেতনার বাতিঘর, অনুপম আদর্শে ভাস্বর এক আলোকোজ্জ্বল প্রতিভা। তিনি একাধারে গবেষক, ভাবুক, প্রজ্ঞাবান প্রশাসক। তিনি বাঙালির সমাজ দর্শন নিয়ে চিন্তাচর্চা করেন আবার সেই ভাবনার সূত্রকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণে ব্যবহারিকভাবে বাস্তবায়নের সচেষ্ট হন। বাঙালির শেকড় সন্ধানি প্রায় অশতিপর এই প্রজ্ঞাবান মনীষী আমাদের জাতীয় জীবনে অভিাবকতুল্য একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব’।

আনিসুজ্জামান বহুমাত্রিক কর্মতৎপরতায় নিয়োজিত থাকতে দ্বিধা করেন না। যে কোনো শত উদ্যোগকে তিনি সমর্থন করেন এবং ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেন। আবার কোনো উদ্যোগই বাহুল্য বক্তব্য দিয়ে বিড়ম্বিত করেন না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন, আনিস খুবই ব্যস্ত মানুষ কিন্তু তাকে সবকিছুতেই পাওয়া যায়। এমন মেধাবী ও বহুগুলো গুণান্বিত ব্যক্তি নানা উদ্যোগে শামিল। সে কাজে ব্যস্ত থাকে বলে সময়ও তাকে সাহায্য করে, অবশ্য তার কাজে কর্মে একটি অন্তর্নিহিত, শৃঙ্খলা বিদ্যমান, এই শৃঙ্খলা তার জীবনীশক্তির চাবিকাঠি।

ড. আনিসুজ্জামান শিক্ষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এক সময় করেছিলেন, এখনো করছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এর পরও বলতে হয়, তার অনন্য শিক্ষকতা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি সবার শিক্ষক হয়ে উঠেছেন। শিক্ষা ও পাঠদানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকেই তা হয়েছে। ড. মসিউর রহমান বিষয়টিকে তুলে ধরেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তাকে শিক্ষা বিভাগের সচিব পদে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন।.....জনাব আনিসুজ্জামান অতি নম্রভাবে বঙ্গবন্ধুকে তার অক্ষমতা জানান। আমাকে অনুরোধ করেন আমি যেন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে বলি যে আনিসুজ্জামান শিক্ষক, শিক্ষার প্রতি তার অনুরাগ, সরকারি পদে যোগ দিতে তিনি আগ্রহী নন।’

হাসান আজিজুল হকের এ কথাটি যথার্থ: যদি বলি আমরা আনিসুজ্জামানে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাহলে খুব বেশি ভুল বলা হবে না। ‘আনিসুজ্জামানের মধ্যে দেখি বুদ্ধি আর কল্যাণবোধ এক সঙ্গে মিলেছে। এর পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় ড. রফিকুল ইসলামের মন্তব্য, ‘প্রফেসর আনিসুজ্জামানের যে গুণকে আমি ঈর্ষা করি তা হচ্ছে যে কোনো জটিল ও কঠিন বিষয়কে যুক্তিসঙ্গত অথচ সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করার স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষমতা।’ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের এ মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্য ‘তার সান্নিধ্য সততই অনুপ্রেরণাদায়ী ও শিক্ষামূলক।’

আনিসুজ্জামান একনিষ্ঠ গবেষক। গবেষণায় তার সৃজনশীলতা, পাণ্ডিত্য ও মৌলিকত্ব সর্বজনবিদিত। জনতার কাতারে মিশে যাওয়া আনিসুজ্জামানকে সবসময় দেখে বোঝা যায় না নিভৃত গবেষণায় তিনি কত গভীর অন্তর্গামী, নিপুণ বিশ্লেষক, প্রতিপাদ্য নির্ধারণে দক্ষ। তার এই দুই ধরনের সত্ত্বাকে বিভাজিত করা সম্ভব নয়। ফারুক চৌধুরীর কথায় পরিস্ফুটিত হয়, ‘জ্ঞানসাধনার নিভৃতলোকে তিনি জনতার কোলাহলকে সাদরে আমন্ত্রণ জানান, দেশ ও জাতির যে কোনো দুর্যোগে এগিয়ে যান যোদ্ধার মতো। জ্ঞান ও মনীষার অঙ্গনেই যে তার মূল পদচারণা, তখন যে কথা হয়তো তিনি নিজেই ভুলে যান। তিনি তখন হয়ে উঠেন শতভাগ সমাজকর্মী।’

গবেষণা কর্মে তিনি শিক্ষানবিস জ্ঞানপিপাসু অন্বেষকদের জন্য গাইড, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চলমান অভিধান। অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের ভাষায়, ‘কোনো আলোচনার তথ্য বা তত্ত্ব কোন্ বইতে পাওয়া যাবে তার জন্য আনিসুজ্জামানের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সাহিত্য ও সংস্কৃতির রেফারেন্সে তিনি শিক্ষকের শিক্ষক। সমকালীন ঘটনার তিনি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসকার।

সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক গাঢ় আবেগে চিহ্নিত করেছেন, ‘.... শব্দটা-মনীষী-আজ ও আমি জাজ্বল্য দেখে উঠি যখনই আনিসুজ্জামানের মুখোমুখি হই। আর কোনো বিশ্লেষণে তাকে আমি ধরে উঠতে পারি না এই বাংলাদেশে, আমাদের কালে মনীষী যদি কেউ এখনও ঘাসের উপরে আছেন এবং আমাদের যাত্রাপথের কাঁটাগুলোকে সনাক্ত করে দিয়ে চলেছেন অবিরাম--তিনি আনিসুজ্জামান। আমি যে তাকে সেই বাহান্ন থেকে দেখে এসেছি। তার বন্ধুত্ব পেয়েছি সেই সেকাল থেকেই। এর জন্য আমি সমৃদ্ধ বোধ করি।’

ড. আনিসুজ্জামান মৌলিক গবেষক; তিনি গবেষণাকে নিরসতা থেকে সৃজনশীলতায় উন্নীত করেছেন। কখনো তিনি সখে গল্প লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন দুই একটা। জীবনী গ্রন্থ লিখেছেন। সুযোগ পেলেই করেছেন অনুবাদ, এমনকি নাটকেরও। কিন্তু রক্তে মিশে রয়েছে মনস্বিতা, চিন্তামূলক লেখা ও গবেষণা। ১৯৫২ সালে স্কুলের সীমানা মাত্র ডিঙ্গিয়েছেন, বয়স মাত্র পনেরো, ভাষা আন্দোলনের তরঙ্গে আলোড়িত হয়ে লিখলেন যুবলীগের প্রকাশনায় পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি ও কেন?’ পরবর্তী তার শিক্ষা জীবন ও শিক্ষকতা তাকে ব্যাপৃত করে গবেষণায়।

বাঙালি মুসলিম মানসের অনুসন্ধান ও সাহিত্য তার প্রভাব বিবেচনা দিয়ে শুরু করলেও তিনি ঢুকে পড়েন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুদূর প্রসারমান দিগন্তে। বাংলাভাষার আদি রূপ রূপান্তর ও গদ্যের প্রকৃতিতে অনুসন্ধিতসুক গবেষণায় নিবিষ্ট হন। পাশাপাশি সমকালীন সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্যকেও ধারণ করেন। তার গবেষণা হয়ে ওঠে বিচিত্রমুখী। আমাদের জন্য তিনি খুলে দেন চিন্তার খোলা আকাশ। ভাষার সরসতা এবং বিষয়বস্তুর বোধগম্যতা সৃষ্টির কারণে তার প্রবন্ধ গ্রন্থগুলো হয়ে ওঠে পাঠক-প্রিয়।

ড. আনিসুজ্জামানের জীবনের বিভিন্ন পাঠ আমরা পেয়েছি-তাকে শ্রদ্ধা জানানোর গ্রন্থ ও প্রকাশনাগুলো থেকে। জানতে পেরেছি তার সর্বমুখী তৎপরতা। তাকে আরো গভীরভাবে জানা প্রয়োজন। তার চিন্তা দর্শন ও ভাব-জগতকে জানতে তার সাহিত্য পাঠ প্রয়োজন। বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেখানেই আমরা পুরো আনিসুজ্জামানকে পাই।

শিক্ষক হিসেবে ড. আনিসুজ্জামানকে তুলে ধরেছেন কবি শামসুর রাহমান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ক্লাসে/সেই অধ্যাপক ধীরে প্রবেশ করলে/ ক্লাস মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত বক্তৃতা তার সারাক্ষণ।’ ছাত্রছাত্রী সবাই সাজাত মনে শ্রদ্ধার মঞ্জরি। /আত্মভোলা নন তিনি, নন অচেতন সমাজের/ কল্যাণ কি অকল্যাণ বিষয়ে কখনও যতদূর/জানি দৃষ্টি তার সদা মানবের প্রগতির দিকে/ প্রসারিত। কী প্রবীণ, কী নবীন, সকলের বরেণ্য নিয়ত।

কবি সৈয়দ শামসুল হক বলছেন: ‘মানুষ নেয় জন্ম এবং মানুষ বড় হয়-বয়সে বড় হয় সকলে, কর্মে কতিপয়। /এক জীবনের অর্জন ঠিক এক কথাতে বলা যায়?/ প্রতিদিনের চিত্রলেখা দিনের শেষে মুছে যায়। ‘সবটাই কি মুছতে পারে কালের হাত চলমান?/ অলোচ্য যে নামগুলো তার একটি আনিসুজ্জামান।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে একটি জাতির শেকড় সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। জাতীয় জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে তিনি আমাদের বাতিঘর।

যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতেন অথচ তা চিন্তার খোরাক যোগাতো। উত্তম শব্দচয়নে তিনি বিষয়বস্তুকে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ইতিহাস নির্মাণ করে নিজেই ইতিহাস হয়ে গেছেন। উপমহাদেশে সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি একটি জাতি নির্মাণে অংশ নিয়েছেন। এমন বর্ণাঢ্য জীবনের দেখা মেলে না সচরাচর। সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে তিনি শেকড়ের সন্ধান করেছেন। তিনি ছিলেন জাতীয় জীবন, ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে আমাদের বাতিঘরের মহাপ্রয়াণে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //