মে মাসজুড়ে অশনিসংকেত

সংক্রমণ ঠেকাতে কোন পথে দেশ

দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মোট শনাক্তের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিদিন নতুন রোগীর সন্ধান ও রেকর্ড ভেঙে রেকর্ড গড়ছে। 

এখন পর্যন্ত লাখের কাছাকাছি নমুনা পরীক্ষায় সাড়ে ১১ শতাংশের দেহেই জীবাণু মিলেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য। মৃতের সংখ্যাও প্রায় দুইশ’। আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার হার অন্যান্য দেশের তুলনায় নগণ্য। 

হাসাপাতালের সেবা নিয়ে রয়েছে হাজারো অভিযোগ। সুরক্ষা সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা তো শুরু থেকে বিদ্যমান। আর এতেই ফুটে ওঠে এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্রটা। তবে বড় শঙ্কা হলো- করোনাভাইরাসে আক্রান্ত উপসর্গহীন রোগী। তারাই সবচেয়ে বেশি মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। এতে করে সামনের দিনগুলো হয়ে উঠতে পারে আরো ভয়ংকর। 

চলতি মাসে আক্রান্ত লাখের কোটা ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিষয়টি গত ২১ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়ও আলোচিত হয়। সংখ্যাটা যে আদৌ স্বস্তিদায়ক নয়, তা বুঝেই পর্যায়ক্রমে কঠোর লকডাউনের পক্ষেই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের বেহাল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নেমে কোনোভাবেই হটস্পট জোনে ছাড় না দিতে বলা হচ্ছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। গার্মেন্টসের পর এখন  শপিংমল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

গত ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও দেশে এ ভাইরাস শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। প্রথমদিকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুরকে ‘ক্লাস্টার এরিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংক্রমণ রোধে ওইসব এলাকা কার্যত লকডাউন করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। 

এতে মাদারীপুরে ভালো ফল এলেও চিন্তা বাড়ায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সংক্রমণ। এর মধ্যে আবার এ দুই জেলা থেকে মানুষ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় করোনাভাইরাস আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। মার্চে শনাক্তের হার কম হলেও এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে টেস্ট বাড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শনাক্তের সংখ্যা। 

আইইডিসিআরের তথ্যমতে, আক্রান্তের প্রথম মাসে ৫১ রোগীর সন্ধান মিলে ও মারা যান পাঁচজন। আর এপ্রিলে শনাক্ত হয় ৭ হাজার ৬১৬ জন রোগী; মৃত্যু হয় ১৬৩ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, করোনাভাইরাস বিস্তারের ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা দুটি সিনারিও প্রস্তুত করেছেন। এর মধ্যে প্রথমটি একটু রক্ষণশীল বা কনজারভেটিভ। সে অনুযায়ী, ৩১ মে পর্যন্ত দেশে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার লোক আক্রান্ত হতে পারেন; মৃত্যু হতে পারে ৮০০ থেকে এক হাজার রোগীর। আর দ্বিতীয় প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, এক লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। 

অবশ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মে মাসের প্রথম দিকে সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যাটা (পিক) পাওয়া যাবে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পরিবহন ব্যবস্থা যখন সচল হবে তখনই আসলে বোঝা যাবে সংক্রমণ কতটুকু বাড়ছে। মূলত একটি দেশের জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য সুবিধা ও মহামারি-বিদ্যার তথ্যের ভিত্তিতে একটা কার্ভ তৈরি করা হয়; যার মাধ্যমে জানা যায় রোগের পিকটা কখন হবে। যাবতীয় বিবেচনায় মে মাসটি খুবই শঙ্কাপূর্ণ। এ অবস্থায় যাচাই-বাছাই না করে ও কোনো কার্যকর স্বাস্থ্য সুরক্ষা না নিয়েই পোশাক কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁর পর শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

এ বিষয়ে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ওরস্ট কেস সিনারিও বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ সক্ষমতা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যদিও এই সিনারি মডেলিংয়ের ক্ষেত্রে লকডাউন, অ্যাওয়ারনেস, সোশ্যাল ডিসট্যান্সসহ অনেক ফ্যাক্টর বিবেচনা ও ব্যবহার হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ২০ শতাংশের হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। সে অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে প্রস্তুত করা হচ্ছে ২০ হাজার শয্যা।’

রানা প্লাজার চেয়েও ভয়াবহতার আশঙ্কা

করোনাভাইরাস ঝুঁকি মাথায় রেখে সরকারের সাধারণ ছুটি কয়েক দফায় বাড়ালেও ব্যতিক্রম দেশের উৎপাদনমুখী কলকারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্প। পূর্বনির্ধারিত ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি শেষে রাজধানীসহ বেশ কিছু এলাকার কারখানা খুলে দেয়া হয়। এমনকি লকডাউন পরিস্থিতিতে যেসব শ্রমিক আশপাশে অবস্থান করছেন, তাদের দিয়েই উৎপাদনে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত ছিল, তা মানা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়লেও মালিকপক্ষের দাবি, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই নাকি কারখানা খুলেছেন তারা!  

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশু বলেন, ‘সরকার যে উদ্দেশ্যে লকডাউন করেছে, সেই পরিস্থিতির কি উন্নতি হয়েছে? দিনদিন অবনতিই হচ্ছে। তাহলে কেন লকডাউন উপেক্ষা করে আবার শ্রমিকদের ডেকে জীবননাশের মধ্যে ফেলা হয়েছে?’

বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, ‘কারখানা খোলার আগে এক্সপার্টদের নিয়ে কমিটি করার প্রয়োজন ছিল, যারা করোনাভাইরাস বিশেষজ্ঞ। তাদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ করলে ভালো হতো। কারখানা মালিকরা তো জীবনে অনেক লাভ করেছেন। এখন শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে আরো কয়েকটি দিন অপেক্ষা করাই ছিল ভালো। এবার যদি কোনো ধরনের সমস্যা হয়, তাহলে সেটা হবে রানা প্লাজা ধসের চেয়েও ভয়াবহ।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের আর বিদেশি শিল্পকারখানা এক না। আমাদের শ্রমিকও তাদের মতো না। কয়েকদিন পরে ঈদের ছুটি। তখন শ্রমিকরা আবারো গ্রামে ছুটবে। এতে করে পুরো দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়বে।’ 

তবে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের দাবি, ‘সরকারি নির্দেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই গার্মেন্টস চালু করা হয়েছে। নির্দেশনার প্রথমেই ছিল- আশপাশে যেসব শ্রমিক রয়েছে, তাদের নিয়েই প্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে। কোনোভাবেই যেসব শ্রমিক জেলার বাইরে চলে গেছে, তাদের ডেকে আনা যাবে না। সেটিই করা হয়েছে।’

গার্মেন্টস মালিক নেতাদের সাথে বৈঠক করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘কোনো কারখানায় করোনাভাইরাসে বেশি শ্রমিক আক্রান্ত হলে সেটি কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হবে। এছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে যেসব শ্রমিক এসে গেছে, লকডাউন সময়ে অবশ্যই তাদের ওইসব এলাকায় থাকতে হবে। তাদের আনা-নেওয়া ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার পরামর্শ দেয়া হয়েছে মালিকদের। কারণ সংক্রমণ বেড়ে গেলে জায়গা দেয়া যাবে না।’

গণপরিবহন চালু হলে সাড়ে সর্বনাশ!

সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে যে কোনো সময়ই সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা আসতে পারে। তবে এতে করে কতটা স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে- এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। 

তারা মনে করেন, এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন হবে না, যাতে করে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যায়। 

এ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘যানবাহন চালুর আগে সব কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। কারণ দীর্ঘদিন উপার্জন বন্ধ থাকার কারণে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব মানার প্রবণতা থাকবে কম। গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা পরিবহন শ্রমিকদের পুরনো অভ্যাস।’ 

ঈদ মার্কেটে দূরত্ব মানাই চ্যালেঞ্জ

রমজানের শুরু থেকেই ঈদের কেনাকাটায় সরগরম হয়ে উঠতো দেশের অনেক পাইকারি মার্কেট। তবে এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে অঘোঘিত লকডাউনে পাল্টে গেছে সে চিত্র। মার্কেট বন্ধ রয়েছে এক মাসেরও বেশি। থমকে গেছে ঈদ বাজার। বাড়তি বিক্রির আশায় আগেই কোটি কোটি টাকার পোশাক স্টক করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তাদেরও এখন মাথায় হাত। তাই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই সীমিত আকারে মার্কেট খুলে দেয়ার দাবি ব্যবসায়ীদের। 

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখন অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে। কোথায় গিয়ে শেষ হবে জানি না। করোনাভাইরাস সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। এখন অন্তত টিকে থাকার জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খোলা রাখতে চাই। এতে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারব। তাছাড়া বাংলা নববর্ষের আয়োজন বন্ধ থাকায় বিশাল একটা মার্কেট হারিয়েছি।’ 

ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ১০ মে থেকে মার্কেট খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মার্কেট খুলে দেয়াটা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো অবস্থা। কেননা ঈদ উপলক্ষে সাধারণত মানুষজন অধিকমাত্রায় কেনাকাটা করে। এর মধ্যে যদি হঠাৎ ভিড় বাড়ে, সেক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এতে সংক্রমণের ক্ষেত্র যে আরেক দফা বাড়বে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //