কতোটা ঘাতক করোনাভাইরাস

২৫ টাকা পাঁচজনকে ভাগ করে দিলে সবাই কীভাবে ১৪ টাকা করে পাবে? হিসাবটা খুব সহজ, ছোটবেলায় করা যোগ অংকের মতোই ১৪-কে নিচে নিচে পাঁচবার বসান। এবার দেখুন ডানের পাঁচটা চার যোগ করলে হয় ২০, আর বাঁয়ের পাঁচটা এক মিলে হয়ে গেল ২৫! গোঁজামিলের এমন হিসাব দেখে যতই মেজাজ গরম করুন না কেন, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নিয়ে কিন্তু এমনভাবেই অংক কষে সবার সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।

ভাইরাসটি এরই মধ্যে মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে। হানা দিয়েছে বাংলাদেশেও। রীতিমতো আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। তবে করোনাভাইরাস নিয়ে যেভাবে ভয়াবহতার খবর ছড়িয়ে পড়ছে, সেভাবে যদি সংক্রমণ এবং মানুষ মারা যেত, তাহলে আজ দেশে দেশে থাকত লাশের পাহাড়। অথচ মাস দুয়েকে দেড় শতাধিক দেশে এ পর্যন্ত রোগটির লক্ষণ মিলেছে পৌনে দুই লাখ মানুষের মধ্যে। অধিকাংশ পরিসংখ্যানই বলছে, আক্রান্তদের ৯৮ ভাগ রোগীই সুস্থ হচ্ছেন। প্রাণহানি হয়েছে ছয় সহস্রাধিকের মতো। এর সিংহভাগই আবার বৃদ্ধ। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন- করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক নয়, জরুরি সতর্কতা। 

করোনারও আছে করুণা

করোনাভাইরাস নিয়ে যখন সারাদেশ আতঙ্কগ্রস্ত, তখনই এর সহজ সমাধান দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজির হন ডা. জাকির হোসাইন সবুজ। করোনাভাইরাস নিয়ে ভয়ের কিছু নেই- এমনটি জানিয়ে এর পক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছেন এ চিকিৎসক। ডা. জাকির বলেন, ‘বিশ্বে ইবোলা ভাইরাসে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ, মার্স ভাইরাসে ৩০ শতাংশ এবং সার্সে ১০ শতাংশ; কিন্তু করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার মাত্র ১.৫ শতাংশ (যদিও কেউ কেউ দাবি করছেন হারটা হবে তিন শতাংশের আশপাশে)। নতুন এ ভাইরাসে আক্রান্ত ৮১ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এটি সর্দি-জ্বরের চেয়ে মারাত্মক কিছু না, যা মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সেরে যায়। ১৪ শতাংশ রোগীর বেলায় কিছুটা বিপজ্জনক। আর মাত্র ৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়ে আঘাত করে করোনাভাইরাস। তবে এ সংখ্যাটা হলো- বয়স্ক এবং যারা ইতিমধ্যেই হার্ট, লিভার, কিডনি কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভুগছেন। সে হিসেবে তারা করোনাভাইরাস ছাড়াও ঝুঁকির মধ্যে আছেন।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন হৃদরোগে। স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ লাখের মতো। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে বিশ্বে প্রতি বছর মৃত্যৃ হয় ৩৫ লাখ লোকের। ডায়রিয়ায় মারা যান ২০ লাখের বেশি মানুষ। এ ছাড়া যক্ষ্মা ও এইডসে মৃত্যুর সংখ্যাও ২০ লাখের কাছাকাছি। আর মৌসুমি ফ্লুতে (এক প্রকার ছোঁয়াছে জ্বর) আক্রান্ত হয়ে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ মারা গেছেন এই শীতে। দেশটিতে মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে এ জ্বরটি রয়েছে আট নম্বরে। আর করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত বিশ্বের দেড় লাখের বেশি আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয়েছে প্রায় ছয় হাজার জনের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন পৌনে এক লাখ রোগী। পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাসে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৫০ ভাগের বয়সই ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। আর ৩০ ভাগের বয়স ৬০ থেকে ৬৯ বছর। অর্থাৎ মৃত্যু হওয়া ৮০ শতাংশ লোকেরই গড় বয়স ৬০ বছরের বেশি। শুধু তা-ই নয়, করোনাভাইরাসে মৃত্যু হওয়া বৃদ্ধদের প্রায় সবাই আগে থেকে কোনো না কোনো বড় রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন- সুস্থ কিংবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকিব অবশ্য করোনাভাইরাসকে মৃত্যুহার নয়, আক্রান্তের ভয়াবহতা দিয়ে বিচার করতে চান। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুহারের ভেতর সান্ত্বনা থাকতে পারে; কিন্তু একইসঙ্গে আছে স্বার্থপরতা। বিশেষ করে শিশু ও তরুণদের কথা ভেবে দেখুন, তাদের মৃত্যুঝুঁকি কম কিন্তু একই সঙ্গে তারা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য আদর্শ হোস্ট। পার্সোনাল হাইজিনের দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। হাত ধোয়ার অভ্যাস নেই বললেই চলে। এক কথায় করোনাভাইরাস ঠেকাতে আমাদের সামর্থ্য ও প্রস্তুতি অত্যন্ত নিচু স্তরের।’

ভাইরাসের বাঁচা-মরা

কম তাপমাত্রা করোনাভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে উল্লেখ করে ডা. জাকির বলেন, ‘যেসব এলাকার তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে সেখানে ভাইরাসটি ছড়ায় না। আর ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মারা যায়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারেÑ ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কী করে নিরাপদ হয়? উত্তরটি হচ্ছে- ভাইরাসটি নাক-মুখ থেকে বের হওয়া হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। তাই আবহাওয়া ২৩ ডিগ্রির ওপর হলে হাঁচি-কাশির কণাগুলো বাতাসেই শুকিয়ে যায় এবং ভাইরাসটির মৃত্যু হয়। আরও প্রশ্ন উঠতে পারে- উষ্ণ দেশ ইরানে কেন এই ভাইরাস ছড়ালো? এর জবাব হচ্ছে- দেশটিতে এ মুহূর্তে শীতকাল চলছে, যেখানে গড় তাপমাত্রা ১৪ কিংবা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’ ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি তাপমাত্রার দেশেও করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের বিষয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘যাদের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে, তারা সেটি অন্য দেশ থেকে নিয়ে এসেছে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে গিয়েছিল; কিন্তু গরমের দেশে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে যায়নি।’

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘অনেকেই বলছেন- সামার (গরম) আসছে ভাইরাস চলে যাবে। অথচ করোনাভাইরাসের সঙ্গে সামার কিংবা শীতের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ভাইরাস ও তাপমাত্রা নিয়ে অতিউৎসাহী হওয়ার কিছু নেই। আমরা যেটা জানি, ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩০ মিনিট ফোটালে ভাইরাস মারা যায়। তাহলে এখন কী নিজেকে এই তাপমাত্রায় ফোটাতে থাকব? আর যদি করোনাকে মারতেই চাই, তাহলে লাগবে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস; এর নিচে এক ডিগ্রিও না, ৬৯.৯৯ ডিগ্রিও না। ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া যখন আমরা মারি, তখন সব মারতে হবে। মানুষের শরীরে যদি একটি ব্যাক্টেরিয়া কিংবা একটি ভাইরাসও বেঁচে থাকে, তাহলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রি-প্রোডাকশন করে মিলিয়ন-ট্রিলিয়ন তৈরি করে ফেলবে। তাই তাপমাত্রা নিয়ে যে কথাগুলো হয়, সেগুলো ঠিক না। অনেকে নিজস্ব ধারণা থেকে এগুলো বলেন।’

নিয়ম রক্ষার কোয়ারেন্টিন

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনেই সীমাবদ্ধ দেশের কার্যক্রম। সেটিতেও আবার কঠোর নজরদারি নেই। কুয়ার‌্যান্টিনে থাকা লোকজন প্রয়োজন ছাড়াই বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন, আশপাশের মানুষের সঙ্গেও পাচ্ছেন মেলামেশার সুযোগ। অনেকে আবার স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের পাত্তাই দিচ্ছেন না। বরিশালে হোম কুয়ার‌্যান্টিনে থাকা এক ব্যক্তিকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকজন পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক হন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে মুখ খুলেছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাও। অনেকটা কঠিন ভাষাতেই তিনি বলেন, ‘বিদেশফেরতরা ১৪ দিন ঘরে থাকুন; কিন্তু আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখছি, তারা কোয়ারেইন্টাইনে থাকছেন না। এতদিন তাদের অনুরোধ করেছি; কিন্তু সরকারের সহানুভূতিশীল পদক্ষেপ তারা মানছেন না। তাই ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে আইনের সংশ্লিষ্ট শাস্তিমূলক ধারা প্রয়োগ করা হবে।’ 

ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশ থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন তাদের হোম কুয়ার‌্যান্টিনে থাকতে হবে; কিন্তু বিদেশ থেকে এসে অনেকেই আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন। হাটবাজারে যাচ্ছেন, আশপাশের মানুষের সঙ্গে মিশছেন। তাদের কেউ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে থাকলে তার সংস্পর্শে যারা আসবেন তারাই সংক্রমিত হবেন। আসলে আমাদের দেশে কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। এর ফলে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।’

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মো. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কার্যক্রম চলছে এডহক ভিত্তিতে। কিছু কিছু চলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে। তাই ভাইরাসটি ঠেকানোর জন্য কৌশলপত্র প্রণয়ন জরুরি। যদি হয়েও থাকে আমরা জনসাধারণ এখনো সরকারের সেই কৌশলপত্র সম্পর্কে কিছুই জানি না। অথচ দেশের ১৬ কোটি মানুষকে তাদের করণীয় জানানো হলে জনগণ সরকারকে সহায়তা করত এবং নিজেরাই সেগুলো মেনে চলত।

আর এটি হলেই কেবল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কার্যক্রম সবচেয়ে সহজ হবে।’ তিনি আরো  বলেন, ‘বিদেশ থেকে যারা আসছেন তাদের ঢাকার বাইরে না পাঠিয়ে আশকোনার মতো বিশ্ব ইজতেমার মাঠে, আর্মি স্টেডিয়ামে বা অন্য কোনো স্থানে মেকশিপট হসপিটাল তৈরি করে কুয়ার‌্যান্টিনে রাখতে হবে।’ এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা আইইডিসিআরে রাখতে যাচ্ছে যেন এটি ল্যাবরেটরি থেকে না ছড়ায়; কিন্তু কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়লে তখন আর একটি ল্যাবরেটরির পক্ষে রোগী শনাক্ত সম্ভব হবে না। তাই দেশের জেলা পর্যায়ে থাকা মেডিকেল কলেজগুলোতে ল্যাবরেটরি প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন।’ 

চিলের পিছে আর দৌড় নয়

এনাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘প্রযুক্তির কল্যাণে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত নানা ধরনের ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্যও ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে তাই না বুঝে, না জেনে শেয়ার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। বলা হচ্ছেÑ মানবদেহের বাইরে করোনাভাইরাসের জীবাণু সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা এবং সর্বনিম্ন ১০ মিনিট জীবিত থাকতে পারে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ইউনিসেফ কেউই এভাবে বেঁচে থাকার সময় নির্দিষ্ট করে দেয়নি। ফলে ইউনিসেফের বরাত দিয়ে যে প্রচার চলছে সেটা প্রপাগান্ডাজাত মস্তিষ্কপ্রসূত। মনে রাখতে হবে, যে কোনো অবস্থায়ই সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়াটাই হচ্ছে সঠিক উপায়। জীবাণুনাশকের ক্ষেত্রে অ্যালকোহলের মাত্রা কমপক্ষে ৬০ ভাগ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটা কিনতেও আলাদা টাকা খরচ হবে। তাই সেটা না করে সাবান-পানি দিয়েই বরং হাত ধোঁয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। হাত চোখে, মুখে, নাকে ছোঁয়ানোর যে স্বাভাবিক অভ্যাস সেটি থেকেও বিরত থাকুন। কাপড়ের ক্ষেত্রে নিয়মিত ডিটারজেন্ট বা সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। তাহলেই হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //