আইন রক্ষার হেলমেটে প্রাণশঙ্কা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম। ঢাকায় চলাফেরা করেন নিজের মোটরসাইকেলে চড়েই। কখনো-সখনো চলার পথে সঙ্গী হন বন্ধু-বান্ধবরা। নিজের মাথায় হেলমেট থাকলেও পেছনের আরোহীরা না পরায় ট্রাফিক পুলিশ তাকে জরিমানা করেন। তাই আরেকটি হেলমেট কিনতে মোটরসাইকেল যন্ত্রাংশের অন্যতম বাজার বাংলামটরে আসেন রেজা। বিভিন্ন মডেল ও দাম যাচাইয়ের পর শেষমেশ সস্তা হেলমেটটাই কিনলেন।

তার কাছে প্রশ্ন রাখতেই হাস্যরসে বললেন, ‘মাথায় যদি থাকে গামলা, দিতে পারবে না কোনো মামলা। আসলে মামলা না খাইলেই হয়, পেছনের আরোহীর জন্য অত টাকা খরচ করবে কে?’ অথচ বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে মাথায় ভালোমানের হেলমেট ব্যবহার অপরিহার্য।

মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর হেলমেট ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আগেও ছিল। কিন্তু মানতেন না কেউই। আবার রাজধানীতে চালকরা ব্যবহার করলেও আরোহীদের বেশির ভাগই এড়িয়ে যেতেন। গত বছর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় হেলমেট ছাড়া আরোহীদের মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে দিতে দেখা যায়। বিষয়টি নিয়ে পুলিশও নড়েচড়ে বসে। আরোহীর হেলমেট না থাকলে মামলা দেওয়া হচ্ছে চালককে।

নতুন আইনে জরিমানা বৃদ্ধি ও সড়কে কড়াকড়িতে সতর্ক হয়ে উঠেছেন সবাই। এসব কারণেই মূলত হেলমেটের বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজার সয়লাব হয়ে গেছে নিম্নমানের হেলমেটে। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হেলমেটগুলোরও একই হাল। ফলে প্রাণরক্ষার সরঞ্জামটি উল্টো প্রাণঘাতকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে!

খালি মাথায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা

বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এ কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সব ধরনের সাজা। হেলমেট না পরলে জরিমানা ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে নতুন আইনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বললে চালককে গুনতে হবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা জরিমানা। ট্রাফিক সংকেত ভঙ্গের জরিমানা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। অবশ্য আইনটি প্রসঙ্গে বিআরটিএ চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘ঢালাও সাজা দেওয়া নয়, আইনের উদ্দেশ্য সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা।’

সম্প্রতি পুলিশের তৎপরতায় পেট্রোল পাম্পগুলোতেও হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল চালকদের তেল দেওয়া হয় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণে। আমদানিকারকদের তথ্যানুযায়ী, হেলমেট সাধারণত একটি ‘স্লো আইটেম’। তবে গত দু’বছরে এর আমদানি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

বংশাল, বাংলামটর, ইস্কাটন, মালিবাগ, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, রামপুরা এলাকা মিলিয়ে রাজধানীতে বর্তমানে ১৫টি প্রতিষ্ঠান হেলমেট আমদানি করছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই এ বছর ছয় থেকে আট কনটেইনার (প্রতিটিতে ৩ হাজার পিস) পণ্য এনেছে। সে হিসাবে, রাজধানীতে পাঁচ থেকে ছয় লাখ পিসেরও বেশি হেলমেট আমদানি করা হয়েছে।

অন্যান্য বছরে যেখানে দুই থেকে তিন লাখের বেশি করা হয় না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মোটরসাইকেল পার্টস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ জানান, মূলত দেশব্যাপী নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিলে বাজারে হেলমেটের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে আমদানিও বাড়তে থাকে। বর্তমানে নতুন ট্রাফিক আইন কার্যকর হওয়ায় তা আরও বেড়েছে।

এ যেন প্লাস্টিক টুপি

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগেরই প্রাণ ঝরেছে মাথায় আঘাতজনিত কারণে। তাই চালক ও আরোহীদের হেলমেট ব্যবহারে রয়েছে কড়াকড়ি। অবশ্য জরিমানার ভয়ে এর ব্যবহার বাড়লেও তাতে যেন শুভঙ্করের ফাঁকি। এর বেশিরভাই মানসম্মত নয়; কোনোটি কর্কশিটের তৈরি, কোনোটি প্লাস্টিকের।

হেলমেট নামের এসব টুপি পরা অবস্থায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়লে উল্টো মাথায় আঘাত পেয়ে মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি পর্যাপ্ত প্রতিরোধ স্তর না থাকায় এর হালকা প্লাস্টিক আবরণ ভেঙে মাথা, চোয়ালের মধ্যে ঢুকে জীবনহানির শঙ্কাও অমূলক নয়।

বুয়েটের এক গবেষণা বলছে, গত ১৫ বছরে সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে। এ ছাড়া নিহত ৮৮ শতাংশেরই হেলমেট পরা থাকে না। আবার দেশে ব্যবহৃত হেলমেটের বেশিরভাগই দুর্ঘটনায় সুরক্ষা দেবে না।

বাংলামটরের ব্যবসায়ী আওলাদ হোসেনও জানালেন, ‘ফুল’ কিংবা ‘হাফ ফেইজ’ হেলমেটের চেয়ে বর্তমানে ‘ক্যাপ’ আইটেমের বিক্রি বেড়েছে বেশি। চালকরা নিজেদের জন্য ভালোটা কিনলেও যাত্রীর জন্য কম দামের ক্যাপটাই কেনেন। এগুলোর দাম ২০০ থেকে ৪০০ টাকা মাত্র। দৈনিক ২৫ থেকে ৩০টি ক্যাপ হেলমেট বিক্রি হচ্ছে তাদের দোকানে। অন্যদিকে, বিদেশি হেলমেট বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫টি।

ইউনাইটেড ন্যাশনস ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ (ইউএনইসিই) হেলমেট সমীক্ষা শীর্ষক একটি গবেষণা করে বছর তিনেক আগে। এতে বলা হয়, অন্যান্য যাত্রীবাহী গাড়ির চেয়ে দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালকের মৃত্যুর আশঙ্কা ২৬ গুণ বেশি। তবে সঠিকমানের একটি হেলমেট ব্যবহার করলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ৪২ শতাংশ।

অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় উঠে এসেছে, নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহারের কারণে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে চলতি বছরের মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৬৩ হাজার থেকে ২ লাখ ১৪ হাজারে। শুধুমাত্র ভালোমানের হেলমেট ব্যবহার করেই ৬৯ থেকে ৯০ হাজার আরোহীকে বাঁচানো সম্ভব। এতে করে দেশগুলোর সাশ্রয় হবে ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘মূলত চালক ও আরোহীর মাথার সুরক্ষার জন্য হেলমেট ব্যবহার হয়। এটি বাইরের আঘাত থেকে মাথাকে রক্ষা করে। কিন্তু টেকসই হেলমেট ছাড়া দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়ানো অসম্ভব। কেননা এটি ঢাল হিসেবে মাথাকে দু’ভাবে রক্ষা করে। প্রথমত ধারালো কিছু ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়, দ্বিতীয়ত মাথাকে রাস্তা বা অন্য বস্তুর আঘাত থেকে বাঁচায় এবং সম্ভাব্য ক্ষতের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তাই একটি ভালো হেলমেটের ভেতরের দিকের ফোমের লাইনিং মসৃণ ও কোমল হওয়া জরুরি।’ 

আছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

সাধারণত সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি হয় আধুনিক হেলমেট। এর ডিজাইনের সময় চলার গতি ও বাইরের বাতাসের সঙ্গে সংযোগের বিষয়টি লক্ষ্য রাখা হয়, যাতে জমে থাকা ঘাম সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে। আর হেলমেটে চোখের দিকে লাগানো কাচকে বলা হয় ভিজর, যা দুই চোখকে বাইরের বাতাস, ধুলোবালি ও উড়ন্ত পোকার আঘাত থেকে রক্ষা করে।

এ ছাড়া রাইডশেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে একই হেলমেট প্রতিদিন অসংখ্য আরোহীর ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। একজনের ব্যবহারের পর ঘামে ভেজা ওই সরঞ্জামটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্যজনকে পরতে হয়। আর এতে ফাঙ্গাল ইনফেকশন, খুশকি ও এলার্জিসহ নানা চর্মরোগ সংক্রমিত হতে পারে বলে চিকিৎসকদের মত। আবার কারো মাথার ত্বকে সমস্যা থাকলে সেটি অন্যের মাথায়ও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

যদিও রাইড শেয়ারিং বাইক চালকরা বলছেন, ভালোমানের এবং নিরাপদ হেলমেট যাত্রীদের দিলে পরতে চান না। কারণ একাধিক যাত্রী ব্যবহার করায় ওগুলো ঘেমে যায়। এ জন্য উল্টো আমাদের মামলা খেতে হয়। তাই বাধ্য হয়েই টুপির মতো হালকা হেলমেট ব্যবহার করতে হচ্ছে। 

পরিবহন বিশেষজ্ঞ মারুফ রহমান বলেন, “বিএসটিআইর বাধ্যতামূলক মান পরীক্ষার তালিকায় ১৪০ নম্বর পণ্য মোটরসাইকেলের হেলমেট। ১৯৮৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ৩৩ বছরেও এর মান পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই প্রতিষ্ঠানটির। এর বাইরেও বাংলাদেশে এমন কোনো কর্তৃপক্ষ নেই যে, এর মান নির্ধারণ করে দেবে। দেশে তৈরির পাশপাশি অধিকাংশ হেলমেটই আসে ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে। তবে আমেরিকান মান অনুসারে, সব মোটরসাইকেল হেলমেটে ‘ডিওটি’ (ডিপার্টম্যান্ট অব ট্রান্সপোর্ট) এর স্টিকারসহ বিক্রি করা বাধ্যতামূলক। আর এটির অর্থ হলো নিরাপত্তার জন্য এটি উত্তীর্ণ। যদিও দেশে এটি তদারকি করার কেউ নেই।” 

একই কথা জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত অনুমোদনবিহীন হেলমেট কোথায় তৈরি এবং কীভাবে বাজারজাত হচ্ছে, তার ওপর নজরদারি রাখা। একই সঙ্গে চালকদেরও হেলমেটের গুণগত মান সম্পর্কে সচেতন করতে ট্রাফিক পুলিশকে প্রচারণা চালাতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //